আকবর আলি খানের জীবনানন্দ পাঠ

হামীম কামরুল হক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:৩৭ পিএম

আকবর আলি খান। ছবি: সংগৃহীত

আকবর আলি খান। ছবি: সংগৃহীত

৫২ বছর বয়সে লেখার কাজটি শুরু করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান। সজ্ঞানে তিনি লেখক হতে চাননি। আর তিনি নিজেকে বলতেন গ্রন্থকীট।

পড়ার আগ্রহ ছিল বিচিত্র বিষয়ে, তার ভাবনাকে  পাঠকদের নিকট জানানোর প্রয়োজন মনে করেছিলেন তিনি; সেইজন্য গ্রন্থরচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন। লিখেছেন বিচিত্র বিষয়েও- রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য কোনোটিই বাদ যায়নি তার লেখার তালিকা থেকে। তিরিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি নিয়ে লেখক আকবর আলী খান লিখেছেন। “চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’” গ্রন্থটি নিয়ে লিখেছেন হামীম কামরুল হক।

পরাবাস্তব কবি, দুর্বোধ্য কবি, অচেতনার কবি, নির্জনতম কবি, ইমপ্রেশনিস্ট কবি ইত্যাদি তকমা ছিল জীবনানন্দ দাশের। এভাবেই তাঁকে নানা সময়ে ‘ব্র্যান্ডিং’ করেছেন সমালোচকেরা। বোধ করি এই ছাপ্পা বা মার্কাগুলি খেলো হয়ে গেছে আকবর আলি খানের “চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’” বইটিতে। তিনটি পর্বে এ বইটি বিন্যস্ত। প্রথম পর্ব ‘পটভূমি’তে কে জীবনানন্দ, কী জীবনানন্দ, কোথায় জীবনানন্দ, কেমন জীবনানন্দ, কীভাবে জীবনানন্দ- এই প্রসঙ্গগুলোর জবাব মিলবে। ব্যক্তি ও পরিবেশ এবং ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের রচনাকাল ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে পাঠককে একেবারে চৌম্বকের মতো সেঁটে দিয়েছেন এই বইয়ের সঙ্গে।

অতঃপর দ্বিতীয় পর্বে ‘কবিতার নিবিড় বিশ্লেষণ’-এ ৩০টি কবিতার প্রথমে টেক্সট, মানে পুরো কবিতাটা, এরপর একে একে ‘রচনাকাল’, ‘টীকা’, ‘চাবিকাঠি’- যদি এক বা একাধিক  চাবিকাঠি থাকে তো সেগুলো কী কী, সেসবের উল্লেখসহ ব্যাখ্যা এবং শেষে ‘সামগ্রিক তাৎপর্য’তে হাজির করছেন কবিতার সারমর্ম। এবং শেষ পর্ব ‘সামগ্রিক বিশ্লেষণে’ কবির চেতনাজগতের যেদিকগুলো এই কাব্যগ্রন্থে কাজ করেছে তার পর্যালোচনা। এছাড়া ‘সারণি’ ও ‘মানচিত্র’ দিয়ে কবি ও তাঁর এই বইটিকে একেবারে ‘গ্রাফিকালি’ হাজির করা হয়েছে।

আবার একেবারে শেষে তাঁর কবিতাকে পিচ্ছিল তথা চ্যাং মাছের সঙ্গে তুলনা করা- বইটির তন্নিষ্ঠ বা সিরিয়াস মেজাজটিকে দুম করে ফাটিয়ে দিয়েছে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ৩০টি কবিতাকে বুঝে নেওয়ার চাবিকাঠিগুলো খুঁজে বের করেছেন জীবনানন্দের অন্যান্য লেখা, দিনপঞ্জি, জীবনানন্দ সম্পর্কে অন্যদের লেখা, পারিবারিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে। তাতে রহস্য ভেদ করেছেন, কিন্তু রোমাঞ্চটা কমেনি; বরং আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন আকবর আলি খান। অন্তত এই বই পড়ে  জীবনানন্দের বাদবাকি কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার দিকে যে কোনো পাঠকের আগ্রহ জেগে উঠতে পারে, তিনি পেয়ে যেতে পারেন আরও আরও রহস্য ও রোমাঞ্চের সন্ধান।

এক ‘বনলতা সেন’ কবিতার চাবিকাঠি ও এর ব্যাখ্যা যেভাবে এসেছে তা অনেককে চমকে দিতে পারে। ‘নাটোরের বনলতা সেন’, ‘দুদণ্ড শান্তি’, ‘অন্ধকার’, ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি’, ‘বিদিশার নিশা’। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় যেটি তা হলো বনলতা সম্ভবত একজন পতিতা নারীও হতে পারে, যে তাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল, তুলনীয় পটভূমিতে আছে বিদিশা, যে অঞ্চলটিতে প্রাচীন ভারতে প্রকট গণিকাবৃত্তির ছিল। তেমনি ছিল নাটোরে পতিতালয়। জীবনানন্দ দিল্লিতে বেশ্যালয়ে গিয়েছিলেন।

এসব প্রসঙ্গে তিনি অনেক পরে প্রকাশিত কবির ডায়েরি নানান ভুক্তি থেকে হাজির করেছেন। ‘কুড়ি বছর পর’ কবিতার চাবিকাঠি ‘মনিয়া’- কোনো পাখির নাম নয়, যা নিয়ে ভ্রান্তি ছিল পূর্ববর্তী প্রায় সব সমালোচকের, অনুবাদ করতে গিয়েও ‘মুনিয়া পাখি’ বলে ভুল করেছেন কেউ  কেউ। এই মনিয়া ছিল পর্তুগিজ পাদরি ও এক ভারতীয় নারীর অবৈধ সন্তান। এই নীলনয়না মেয়েটির প্রতি কবি টান বোধ করেছেন, যার মৃত্যু হয়েছিল জলে ডুবে। নিজের খুড়তুতো বোন বেবিকে ‘হাওয়ার রাত’ কবিতায় ‘বেবিলনের  রাণী’ শব্দে আড়াল দিয়েছেন কবি। যদিও এই কবিতার চাবিকাঠি হলো ‘মশারি’ শব্দটি।  

জীবনানন্দের কবিতায় সুস্পষ্ট বক্তব্য ও দর্শন আছে। তাঁর কাব্যভাষা, চিত্ররূপময়তা কেবল হেঁয়ালি দিয়ে পূর্ণ নয়। নিজের জীবনে ব্রাহ্মধর্মের নৈতিকতার বেড়াজাল ছেদ করতে পারেনি বলে নানান রূপক প্রতীক সংকেতের ব্যবহার করছেন। বৌদ্ধদর্শন এবং দ্বৈতবাদের আলোকে ভারতীয় ব্যক্তি-সমাজ-সভ্যতাকে দেখে নিতে কবিকে কীভাবে, কতটা তাড়িত করেছিল সেসব দিক পরিষ্কারভাবে তুলে এনেছেন আকবর আলি খান। 

কেবল তাই নয় এই একটি বইয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কিছুদিকের পাঠ হয়ে যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সি, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের নানান আচার বিশ্বাসে বেড়াল, শূকরের মতো পশু, নানান গাছপালা সম্পর্কে ধারণা যেমন- বটগাছ, সম্পর্কিত বিশ্বাস ও সংস্কারের কথা এসেছে। আরও কিছু দিক যেগুলো বিশেষভাবে এসেছে তা হলো জীবনানন্দের রূপবতী নারীপ্রীতি, প্রেমের ব্যর্থতা, অসুখী দাম্পত্য, প্রেমের জন্য আমর্ম হাহাকার এবং মৃত্যুবোধ। যেসব নারীর নামে কবিতা আছে সেগুলো কেবল নারী নয়, সমাজ সভ্যতা ও যুগের প্রতীক, ‘সবিতা’ ও ‘সুচেতনা’র মতো কবিতাগুলোকে সেই মতোই বুঝে নিতে হবে।

অন্যদিকে ‘শঙ্খমালা’, ‘শ্যামলী’, ‘সুরঞ্জনা’র মতো কবিতায় কেবল একক কোনো নারীর কথা বলেনি, তার গভীরে কাজ করছে কখনো যৌনতা, কখনো প্রাচ্যে নারীর প্রতিকৃতি, কখনো স্রেফ রূপবতী নারীরা- যারা ধর্ম সমাজ সংস্কারের সমস্ত বেড়াজাল সত্ত্বেও টিকে আছে। 

‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটিকে জীবনানন্দের অণুবিশ্ব বলা যেতে পারে, অন্তত আকবর আলি খানের এই বইটি পড়ার পর এ-নিয়ে আর কোনো দ্বিধা থাকে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh