গাড়ি ব্যবসার নামে প্রতারণা

ড্রাইভার থেকে ইউপি চেয়ারম্যান, ৬ বছরের শত কোটি টাকার মালিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:০৬ পিএম

প্রতারক জাকির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

প্রতারক জাকির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

মাত্র ছয় বছর আগেও ছিলেন প্রাইভেটকারের চালক, আর এখন তিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান। রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, প্রাইভেট কারসহ শত কোটি টাকার সম্পদ।

৩৪ বছরের এই যুবকের নাম জাকির হোসেন, তিনি কুমিল্লার মেঘনা থানার ২ নম্বর মানিকারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। নিজেকে পরিচয় দেন সফল ব্যবসায়ী ও তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে।

জানা যায়, অল্প টাকায় গাড়ি কিনে সেই গাড়ি ভাড়ায় খাঁটিয়ে মাসে ৭০ হাজার টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখাতেন চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। কম বিনিয়োগে বেশি টাকা আয়ের লোভে পরে অনেকেই নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করেন সেখানে। প্রথম দুই-এক মাস প্রতিশ্রুত লাভের টাকা দিয়ে আস্থা অর্জন করলেও পরে আর টাকা দিতেন না। এভাবে অন্তত ৩ শ মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে জাকির। এ তালিকায় রয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তা, বাদ যায়নি সংসদ সদস্যরাও। এই প্রতারককে গ্রেপ্তারের পর বেড়িয়ে এসেছে তাক লাগানো এসব তথ্য।

ঢাকা টেক সেন্টারে নিজের একমাত্র উপার্জনের অবলম্বন দোকান ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা গাড়ি কেনার জন্য বিনিয়োগ করেন মুন্সিগঞ্জের ভুক্তভোগী মো. সায়েম। চেয়ারম্যান জাকিরের সঙ্গে তার চুক্তি হয় মাসে ৭০ হাজার টাকা পাবেন। এক মাস পেয়েও ছিলেন কিন্তু তারপর থেকেই মাসিক ভাড়ার টাকা আর পাননি। এরপর ঘুরে ঘুরে কিস্তি তো দূরের কথা আসল টাকা কিংবা গাড়ি কোনোটাই ফেরত পাননি সায়েম।

সায়েম বলেন, ‘সাড়ে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কেনার পরে তার কাছে থেকে আমি এক মাসের ভাড়া পাইছি। এরপর এক বছর ভাড়া দেয় নাই। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে ৭ লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেয় আমাকে। বাকি টাকা চাইলে মামলার হুমকি দেখায়।’

একই গাড়ি প্রতারক জাকির ২৫ জন ক্রেতার কাছে বিক্রি করেছে উল্লেখ করে আরেক ভুক্তভোগী সোহেল মোল্লা বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন ও কয়েকজন সংসদ সদস্যও এই জাকির চেয়ারম্যানের ক্লায়েন্ট। এসব হোমরাচোমরা মানুষ দেখেই আমরা সাধারণ মানুষ আস্থার নিয়ে তার সঙ্গে রেন্ট-এ-কার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলাম।’

সোহেল মোল্লার মতো আরও অনেকেই মিন্টো রোডে এসেছেন। তারা বলেন, ‘পুলিশের অনেক এসআই, ওসি দেখে আমরা আস্থা পাই। বেশি মুনাফার লোভে সেখানে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে গাড়ি কিনি। গাড়ি কেনার পর কয়েক দফায় কিছু টাকা পাই। বাকি টাকা আজকে দিচ্ছি, কালকে দিচ্ছি করে আর দেয় নাই ওই প্রতারক।’

মুন্সিগঞ্জের আরেক ভুক্তভোগী মাসুম মোল্লা। তিনি রাজধানীর চাঁদনি চকে মার্কেটে থ্রি-পিসের ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যবসার টাকায় তাঁকে ১৫ লাখ টাকায় একটা হায়েস গাড়ি কিনে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসায় চুক্তি করি মাসে ৭০ হাজার টাকায়। এক বছরে মাত্র এক মাসের টাকা দিয়েছে। এরপর টাকাও নাই, গাড়িও নাই।’

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত। 

আজ শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোড ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার আড়ালে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন জাকির নামে এক ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি দুই তিন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বল্পমূল্যে গাড়ি ব্যবসার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কাউকে আবার গাড়ি রেন্ট-এ-কারে ভাড়া দেওয়ার কথা বলে মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলে ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে কারও টাকা, কারও গাড়ি হাতিয়ে নেন তিনি।’

হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘গত কয়েক দিনে ডিবি অফিসে দুই শতাধিক ভুক্তভোগী ভিড় করেছেন। আমরা তদন্ত করতে দিয়ে জানতে পারলাম, শুধু মুন্সিগঞ্জের একটি গ্রাম থেকেই দেড় শ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক জাকির।’

হারুন বলেন, ‘তার গাড়ি ২০ থেকে ২৫টি। সেসব গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। তিনি কয়েকজন এমপি, প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য মাসের কিস্তির টাকা ঠিকই মাসে মাসেই পরিশোধ করেছেন।’

তথ্যের প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে ও রাজধানীর মুগদা থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (তেজগাঁও) বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে রেন্ট-এ-কার ব্যবসার আড়ালে ভয়ংকর প্রতারক জাকির চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানা এলাকা তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় দুটি মাইক্রোবাসও উদ্ধার করা হয়।

হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন গ্রামের বাড়িতে প্রতারণার টাকায় আলিশান বাড়ি করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে নমিনেশন পেতে কাউকে প্রাডো গাড়ি, নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচা করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। ঢাকা শহরে তিনি গাড়ি ও গাড়ি, ফ্ল্যাট-প্লট ক্রয় করেছেন। প্রতারণার টাকায় তিনি নিজের ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। আগামী নভেম্বর মাসেই তারও আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। আমরা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরতের চেষ্টা করা হবে। নইলে তাঁর সম্পদ জব্দের জন্য প্রয়োজনে সিআইডিতে মামলা হস্তান্তর করা হবে। আমরা এর আগেও তাঁকে গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকে বলেছেন, তিনি গ্রেপ্তার হলে মাসিক কিস্তির টাকা পাবেন না। কিন্তু তিনি অধিকাংশ ভুক্তভোগীর মাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ করেননি। মূল টাকা তো নেই, গাড়িও মেরে দিয়েছেন।’

প্রতারণা সম্পর্কে ডিএমপি ডিবি প্রধান বলেন, ‘গ্রেপ্তার জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেয়। ক্রয় করা গাড়ি রেন্ট-এ-কারের মাধ্যমে মাসিক ভাড়ায় পরিচালনা করার জন্য চুক্তি করে। একই গাড়ি দেখিয়ে তিনি একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্রে চুক্তি সম্পাদন করেন। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর সংবলিত গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রয় করে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে শুধু ইঞ্জিন নম্বর দিয়ে মাসিক কিস্তি পরিশোধের ভিত্তিতে কিছুদিন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ করে পরবর্তীতে কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh