বিক্রি বন্ধ ‘মিনিকেট’

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০১ এএম

দেশে মিনিকেট বলে কোনো চাল নেই। প্রতীকী ছবি

দেশে মিনিকেট বলে কোনো চাল নেই। প্রতীকী ছবি

বাজার সয়লাব মিনিকেট চালে। সরু ও সাদা ভাত হয় বলে গত দুই দশক ধরেই খাবার টেবিলে তা শোভা বাড়াচ্ছে। তবে এ ধান কোথা থেকে আসে, কীভাবে চাল হয়- কিছুই জানেন না ভোক্তারা।

এমনকি ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীদের কাছেও বিষয়টি অজানা। অথচ বাস্তবতা হলো মিনিকেট নামের কোনো ধানের আবাদ যেমন দেশের কোথাও হয় না, তেমনি এগুলো আমদানিও করা হয় না। বরং দেশের ফসলের মাঠ আর বাজার সয়লাব থাকে ব্রি ধানে; কিন্তু বাজারে এ নামে কোনো চালেরই অস্তিত্ব নেই। মূলত মোটা চালকে কেটে সরু করে মিনিকেট নাম দিয়েছে অসাধু চাতাল মালিকরা। আর এতে করে ভোক্তা একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে অতিমাত্রায় ছাঁটাইয়ের ফলে চালের পুষ্টিমান কমে শরীরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই বাজারে মিনিকেট নামে আর কোনো চাল বিক্রি করা যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার।

বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে ধান নেই, তাহলে এ নামে চাল এলো কীভাবে- তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, মিনিকেট শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘মিনি’ ও ‘কিট’ থেকে। ভারত সরকার নতুন উদ্ভাবিত কোনো ধানের বীজ ছোট বা মিনি প্যাকেটে কৃষকদের দেয়, তা কথ্য ভাষায় বলা হতো ‘মিনিকিট’। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ধানের জাত বাংলাদেশেও আসে মিনি বা ছোট প্যাকেটে করে। সেই ধান কেটে যে চাল হতো তারই নাম দেয় মিলগুলো ‘মিনিকেট’। বিশেষ করে কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় এর ব্যাপক প্রচলন হয়ে পরে তা ব্যক্তির নামেও বাজারজাত হতে শুরু করে। ভারত সীমান্তের কুষ্টিয়া জেলার ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ ঢাকার বাজারে মিনিকেট চালের বাণিজ্যিক প্রচলন ঘটিয়েছেন বলে ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে এ চালের বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মাঝে এক ধরনের ধানের বীজ ও কীটনাশকসহ একটি প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছিল। তখন এটাকে মিনিকিট বা মিনিকেট নামেই ডাকতে শুরু করেন কৃষকরা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের দিকে ভারত থেকে যশোরে আসে ওই ধান। পরে পাশের জেলাগুলোতেও ছড়ায়। তবে সেই ধানের আবাদ বাংলাদেশে খুব বেশি একটা হয় না। মূলত ব্রির উদ্ভাবিত বিভিন্ন উচ্চফলনশীল ধান থেকে চাল তৈরি করে সেটাই মিনিকেট হিসেবে বিক্রি করছেন মিল মালিকরা। এখন এমন আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে যে, যে কোনো ধানকে কেটে যে কোনো আকৃতি দেওয়া সম্ভব। ফলে ধান যা-ই হোক, মিনিকেট চাল তৈরিতে মিলগুলোর কোনো সমস্যা হয় না।

নওগাঁর একজন মিল মালিক জানান, কৃষকের কাছ থেকে ধান নিয়ে তারা সেগুলো প্রথমে খোসা ছাঁটাই করে অটোমেটিক ড্রায়ার মিলে দেন। তাপে সেদ্ধ হয়ে এগুলো কালার সর্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ঝকঝকে চাল হিসেবে বের হয়ে আসে। পরে পানি মিশিয়ে আরও তাপ দিয়ে চালের উপরের আবরণ তুলে ফেলা হয়। এরপর হোয়াইটনারে দিয়ে করা হয় সাদা চকচকে। বাজারের চাহিদার কারণে বাড়তি প্রযুক্তি ও শ্রম ব্যবহার করে চালকে আরও উজ্জ্বল করা হয় বলে জানান তিনি।

বর্তমানে দেশে ১৯ হাজার ৭৩৪টি চালকল বা চাতাল রয়েছে। এদের মধ্যে যারা বৃহদাকারে চালের আন্তঃজেলা বাণিজ্য করে থাকেন, তারা সবাই মিনিকেট ব্র্যান্ডের চাল উৎপাদন করেন। এছাড়া মোজাম্মেল, বিশ্বাস, সাকি, ডলফিন, জোড়া কবুতরসহ আরও অসংখ্য ব্র্যান্ড সারা বছর বাজারে মিনিকেট চাল সরবরাহ করে থাকে। নতুন করে এর সঙ্গে দেশের নামি-দামি ব্র্যান্ডগুলোও যুক্ত হয়েছে।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষক দল গত বছর ১০ জেলা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, দেশে মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। বাস্তবতা হলো- বিশ্বের কোথাও এ নামে কোনো ধান নেই। আর ধান যেহেতু নেই, এ নামে কোনো চালেরও অস্তিত্ব নেই। মূলত আড়াই দশক ধরে ‘মিনিকেট’ নামে চাল বাজারজাত হচ্ছে। দেখতে সরু ও চকচকে হওয়ায় ভোক্তারা বাড়তি খরচ দিয়ে হলেও কিনে খাচ্ছেন মিনিকেট নামের এ চিকন চাল। মূলত বিআর-২৬, বিআর-২৮, বিআর-৩৩, ব্রি-৪৩, ৪৮ থেকে ৯৮ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান এবং কল্যাণী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, আইআর-৫০, জাম্বু ও কাজললতা ধানের চাল কেটে ও পালিশ করে মিনিকেট চাল হিসেবে চালানো হচ্ছে। 

কেমিক্যাল মিশ্রণ ও অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের কারণে মিনিকেট চালে শুধু শর্করা ছাড়া অন্যান্য পুষ্টিগুণ থাকে না বললেই চলে। ফলে এ চাল মানবশরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে ব্রির ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান গবেষক ড. মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের ফলে মিনিকেট চালে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, প্রোটিন, আঁশ- এসবের কিছুই থাকে না। শুধু থাকে কার্বোহাইড্রেট। ফলে এ চালের ভাতে অভ্যস্তদের নানা রকম অপুষ্টিজনিত রোগবালাই হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পলিশ করার কারণে মিনিকেট চালে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, চাল থেকে প্রোটিন বা আমিষও পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম চালে আমিষ থাকে ৬-৭ শতাংশের মতো। কিন্তু কলে ছাঁটার কারণে ১ থেকে ২ শতাংশ প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ফ্যাট বা অয়েল কমে যাওয়া। অয়েল কমে যায় ৬২ শতাংশ, ক্রুড ফাইবার কমে ৪০ শতাংশ এবং অ্যাশ হ্রাস পায় ১১৮ শতাংশ। এ ছাড়া ভিটামিন বি-১, বি-৬ প্রায় ৮০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ চাল উৎপাদন ও বিপণন তদারককারী সরকারি দপ্তরগুলোও মিনিকেট চালের নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে আট শতাধিক চালকল। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো ইতোমধ্যে একাধিক বৈঠক করে মিনিকেট চাল বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। বিষয়টি সুরাহা করতে সম্প্রতি চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

মূলত সেখানে চাল উৎপাদন বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও সুপারশপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বাজারের জনপ্রিয় চাল মিনিকেট তৈরি হয় অন্য চাল ছেঁটে- এমন অভিযোগ নাকচ করেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রাণ-আরএফএলের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, ‘অভিযোগ আছে মোটা চাল কেটে মিনিকেট চাল বানানো হয়। কিন্তু চাল ছেঁটে মিনিকেট চাল বানানোর কোনো যন্ত্র দেশে নেই। মিনিকেট একটি ব্র্যান্ড, এটি বাজারে অনেক দিন ধরে আছে। এখন এটা বন্ধ করা হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ 

ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের জবাবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সাধারণত ধানের নামেই চালের নাম হয়। মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই, তাহলে এই চাল এলো কোত্থেকে। আপনাদের (ব্যবসায়ী) কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনারা জানেনই না, এই চাল কীভাবে তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য আছে, মোটা চাল কেটে সরু করে সেটা মিনিকেট নামে বাজারে ছেড়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এখন আপনারা যেহেতু মানছেন না, আপত্তি তুলছেন, আমরা এ বিষয়ে চাল বিশেষজ্ঞ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসব। তারপর এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’

মিনিকেট প্রতারণা নিয়ে ২০১৫ সালেও নড়েচড়ে বসেছিল সরকার। সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ নিয়ে মুখ খুললে সেটি আবার আলোচনায় আসে।

সচিবালয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে মিনিকেট বলে কোনো চাল নেই। তবু ব্যবসায়ীরা মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত করছেন। যারা এটি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে প্যাকেটের গায়ে ধানের জাতের নাম লেখার কথা বলা হয়েছে। চালের বস্তায় ধানের জাতের নাম উল্লেখ করতে হবে। চালে বেশি পলিশ করা যাবে না।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh