দুই বাংলার পূজা

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১১:২৫ এএম | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১১:৪৬ এএম

বাংলাদেশের পুজোয় জাঁকজমক বেশি। ছবি: মামুন হোসাইন

বাংলাদেশের পুজোয় জাঁকজমক বেশি। ছবি: মামুন হোসাইন

আমার যতটুকু বিদ্যে, তাতে এটুকু বলতে পারি যে, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়েছিল তাহেরপুরে। কেন জানি না, অনেক দিন অবধি আমার ধারণা ছিল, তাহেরপুর হচ্ছে এ বঙ্গের নদীয়া জেলায়। হতে পারে যে, কেউ কেউ বলতেন হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়াতেই প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়েছিল। ফলে আমি ভাবতাম, প্রাচীনত্বের কম্পিটিশনটা মোটের ওপর কাছাকাছি দুই জেলাতেই থাকবে

সে যে একেবারে সীমান্ত অতিক্রম করে ভিনদেশে, তা ভাবিনি। এখন অবশ্য আর একটি বিষয়, ওই তাহেরপুর ওপারে তা মনে না আসার কারণ হিসেবে মনে হচ্ছে; বাংলাদেশ যে অখণ্ড ছিল, এই বোধটা মনে রাখিনি। যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ, সব এপারের, এরকম এক সাধারণ জ্ঞান নিয়ে অনেকের মতো আমিও বহু বছর কাটিয়ে দিয়েছি।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যাচ্ছি। ঢাকা যাবার পর পরই কোথা থেকে যেন তাহেরপুর জানতে পেরে, ঠিক করলাম সেখানে যাব। সুবিধেও একটু ছিল। তখন রাজশাহীতে আমার এক দাদা ছিলেন ভারতের সহকারী রাষ্ট্রদূত। ফলে ভিসাটিসা করে আমি আর আমার স্ত্রী সীমান্ত পার হয়ে ছোট সোনা মসজিদ দেখে, দাদার সৌজন্যে কানসাটের মুখুর্জী বাড়ির পুজো দেখে সোজা রাজশাহী সদরে। সেখান থেকে পরের দিন আমার বন্ধু অপুকে নিয়ে পুঠিয়া পার হয়ে তাহেরপুরে। মহারাজা কংস নারায়ণ, শোনা যায় সে সময় পুজোর পিছনে খরচ করেছিলেন আট লাখ টাকা। এ সেই মধ্যযুগের কথা।

এখন সে রাম নেই। অযোধ্যাও নেই। কংসনারায়ণের সাধের বসত এখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কাছারি বাড়ি মোটামুটি আছে। পলেস্তারা খসে পড়লেও বোঝা যায় পুরনো দিনের রমরমা। শোনা যায় যে রাজামশাই বছরে দুবার, দোলে আর দুর্গাপুজোয় তাহেরপুরে আসতেন। এসেই নায়েব আর খাজাঞ্চি বাবুর সঙ্গে কাছারিতে বসে সারা বছরের রাজস্ব কতটা এলো না এলো সেসব হিসেবনিকেশ করে সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ির অন্দরে ঢুকে পুজোর জাঁকজমক নিয়ে ব্যস্ত হতেন। অন্য সময় তিনি থাকতেন কলকাতায়। কংসনারায়ণের একটা বিরাট কাজের প্রশংসা উচ্চ বর্গীয় সুধীজনের মুখে আজও শোনা যায়।

নদীয়ার ফুলিয়ায় জন্মেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। তিনি রাজা কংসনারায়ণের উৎসাহে লিখেছিলেন রামায়ণ, ১৬৪০ সালে। ইতিহাসে রাজরাজড়ার মহৎ সব কাজের কথাই বলে যায়। তাদের দান খয়রাতির প্রশংসা করেন বড় মুখ করে। কিন্তু স্রেফ পুজোর জাঁকজমকের পেছনে যে লাখ লাখ টাকা খরচ হলো, তার উৎস নিয়ে কেউ কখনো জানতেও চান না।

পুজো এখনো রাজবাড়িতে হয়। তবে বলাবাহুল্য তা নামকাওয়াস্তে। পাড়ার লোকজন চাঁদা দিয়ে ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। পুজোর ভিড় থেকে বাঁচব বলে কলকাতা ছেড়েছিলাম। রাজশাহী শহরে দেখছি উন্মাদনা কোনো অংশে কম নয়। ষাট সত্তরের কমবেশি পুজো হচ্ছে। মাইকে বাংলা গান শুনছি। ঢাকের আওয়াজে মন ভালো করা সুর।

ওই সময়, প্রথম প্রথম বাংলাদেশকে দেখছি। যা দেখছি, তাই ভালো লাগছে। তখনো কিন্তু আজকের মতো ও দেশের প্রেমে পড়িনি। তাও রাজশাহী শহরের আনন্দ আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। পরে ঢাকার পুজো দেখেছি। নোয়াখালীতে লক্ষ্মীপুজোয় গেছি। ঢাকার সদর ঘাটে দুর্গা বিসর্জন দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু প্রথম প্রেমের মতো রাজশাহী কখনো ভুলব না। পদ্মার ধারে আলোর রোশনাই। জলে ছায়া পড়েছে। ওপারে, মুর্শিদাবাদ জেলার কাহার পাড়া, শেখ পাড়া এখন বড় চুপচাপ, একা। দেশভাগ আনন্দেও ভাগ বসিয়েছে। 

বাংলাদেশের পুজো আমার কাছে অনেক ঘরোয়া। জাঁকজমক, ঠাঁটঠমক আছে। কিন্তু অহংকার নেই। দেখনদারি কম। কলকাতা তো আমার শহর। আজন্ম আমি কলকাতার। শৈশব থেকে ধীরে ধীরে পরিণত বয়সে পৌঁছে যাওয়া। ছোটবেলায় টাকা ছিল না। একটা দুটো জামা হতো। তাতেই কত আনন্দ। মা-বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। ঠাকুরের চেয়েও ভালো লাগত প্যান্ডেল ও লাইট। দেখতে দেখতে তিন দিন কেটে গেলে, বিসর্জনের পরে ফাঁকা প্যান্ডেল দেখে বড় মন খারাপ হয়ে যেত। বড় হওয়ার পর বাগবাজার সার্বজনীন, কুমারটুলি, সঙ্ঘ শ্রী, কলেজ স্কোয়ার ইত্যাদি পুজো দেখতাম। তবে কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে ঠাকুর নয়, আড্ডা হয়ে উঠল পুজোর দিনগুলোতে প্রধান ব্যাপার। আর এক বিষয় পুজো আসতে না আসতেই অধীর হয়ে অপেক্ষা করার ছিল। তা হচ্ছে পুজা বার্ষিকী। কত কত স্পেশাল ইস্যু নিয়ে ঢাউস বই হতো। এখনো হয়। তবে ছোটবেলায় মায়ের দেওয়া ঝলমলে কোনো বই এলে নতুন জামা জুতো পাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দ হতো। স্কুল ছুটির দুপুরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা বা সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা পড়ার মজাটাই ছিল অন্যরকম।

এখন কলকাতার পুজোয় আড়ম্বর বেশি। প্রাণের স্পর্শ কম। দেখনদারি বড্ড চোখে পড়ে। কোটি কোটি টাকার বাজেটের পুজোর জাঁকজমক দেখলে কে বলবে এখানে এখনো ফুটপাতে লোকে রাত কাটায়। অমুক পুজো, তমুক পুরস্কারের হট্টগোলে শৈশবের সুখস্মৃতি কোথায় হারিয়ে যায়। স্বপ্নে মাকে দেখি। কবেই তিনি চলে গেছেন। যা যায় তা আর কখনো ফিরে আসে না। সে মা-বাবা, আপনজন, বন্ধু বা শৈশব যা-ই হোক না কেন।

লেখক : ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh