ধানি জমিতে মৎস্য খামার

খাদ্য নিরাপত্তা অনিরাপদ

ড. আবুল হোসেন ও হুমায়ূন কবীর

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:৫৫ পিএম

ধানি জমিতে মৎস্য খামার। ফাইল ছবি

ধানি জমিতে মৎস্য খামার। ফাইল ছবি

‘ধানের দাম কমলেও চালের দাম বাড়তি’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় (প্রথম আলো, ৩০ জুন ২০২২)। অর্থাৎ ধানের দাম কমলে চালের দাম কমবে- এ সরল হিসাবটা মিলছে না। বরং উল্টো হিসাব।

মে-জুন মাসে বোরো ধান কাটা মৌসুমে কৃষক ধান বিক্রি করছে। আর বড় বড় চাল-কল মালিক তথা চাল ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কিনে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি করছে বাজারে। লাভ কার, ক্ষতি কার? এ উত্তর সবার জানা। কৃষকের ক্ষতি। কৃষক ধান উৎপাদন করে বছরের পর বছর দামে ঠকে- এ সত্যটা মিথ্যে হয় না কখনো। ধান চাষে আগ্রহ কমছে কৃষকের। আলু চাষেও লাভ নেই। লাভ আছে মাছ চাষে!

কিন্তু বাংলাদেশের মাঝারি, ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষির পক্ষে ধানি জমিকে পুকুরে রূপ দিতে যে অর্থ এবং আনুষঙ্গিক আয়োজন প্রয়োজন তা তাদের সাধ্যের বাইরে। তাছাড়া জমিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে মৎস্য খামার গড়ে তোলা ধানচাষি কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয় না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ধানি জমিকে পুকুরে রূপান্তর করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।

গত ১০-১৫ বছর ধরে এ প্রবণতা চোখে পড়ার মতো। কার জমি, কে মাছ চাষ করছে? ধানি জমি কীভাবে মৎস্য খামারে রূপান্তর হচ্ছে? ধানের বদলে মাছ চাষের ফলে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোর জনজীবনে কী প্রভাব পড়ছে, এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা একটি গবেষণা পরিচালনা করছি। গবেষণাটি চলমান। গবেষণার কিছু ফলাফল পাঠকের কাছে উপস্থাপন করাই এ লেখার উদ্দেশ্য। 

উত্তরবঙ্গের রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার একটি গ্রাম কমলপুর (ছদ্মনাম)। এই কমলপুরে আমরা গবেষণা কাজটি পরিচালনা করছি। কমলপুর গ্রামের জমি, জলাশয় এবং গ্রামীণ জীবনে গত দশ-পনেরো বছরে নানামুখী পরিবর্তন দেখা আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য। আগেই বলেছি গবেষণা কর্মটি চলমান। এ পর্যন্ত যেসব আকর্ষণীয় তথ্য আমাদের হাতে এসেছে তা উপস্থাপন করছি :

কমলপুর গ্রামে ৩ হাজার লোকের বাস এখন। গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। গ্রামে বিদ্যুৎ আসার ১৫ বছর হলেও রাস্তা পাকা হয়েছে ৪ বছর আগে। সম্পদের নিরিখে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত- এ তিন শ্রেণির মানুষের বসবাস। দশ বছর আগে নব্বই শতাংশ বাড়ি-ঘর ছিল মাটির। বর্তমানে নব্বই শতাংশ পাকা বাড়ি কমলপুরে এবং মাত্র দশ শতাংশ মাটির ঘর আছে। অর্থনীতির বিচারে কমলপুর গ্রামের মানুষের সম্পদ বেড়েছে। দশ বছর আগে কমলপুরে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) মাঠের ফসলি জমি ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন এক বিঘা জমির দাম ৩ লাখ টাকা। সহজে জমি বিক্রি করতে চায় না কেউ। কমলপুর গ্রামে ফসলি জমির পরিমাণ কম-বেশি ৩০০ একর। এই ৩০০ একরের মধ্যে ৩০ ভাগ জমি দো-ফসলি। আর ৭০ ভাগ জমি এক ফসলি। অর্থাৎ কমলপুরের ৭০ ভাগ জমি নিচু বা বিল।

কমলপুরের আলিফ মোহাম্মদ (৬০ বছর বয়স) বলেন, ‘৮-১০ বছর আগেও বিলের জমিতে বর্ষাকালে প্রচুর মাছ হতো। গ্রামের সবাই বিলের মাছ খেতে পারত। মাছ ধরতে কেউ বাধা দিত না। বর্ষাকাল শেষে বোরো ধানের আবাদ হতো বিলের জমিতে। হাজার হাজার মণ ধান হতো। কিন্তু এখন বিলের জমিতে ধান চাষ হয় না, মাছ চাষ হয়। ৮-১০ জন মানুষ যারা কমলপুর গ্রামের বাসিন্দা না, তারাই এখন বিলের জমি লিজ নিয়ে মৎস্য খামারি। বিরাট বিরাট পুকুর খনন করা হয়েছে বিলের জমিতে। আমরা গ্রামের জমির মালিকরা মৎস্য খামারিদের কাছে জমি লিজ দিয়েছি। টাকা পাচ্ছি, কিন্তু জমির চালের ভাত ভাগ্যে জোটে না। চাল কিনে খাচ্ছি, মাছ কিনে খাচ্ছি।’ 

বিলের জমিতে ধান না হওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট হয়েছে। সবার বাড়িতে গরু-ছাগল-গাভী ছিল। কমলপুর গ্রাম এখন গাভী-গরু-ছাগল শূন্য বলা চলে। ধানি জমিতে এখন পুকুর তাই গ্রামের মানুষের কাজও নেই গ্রামে। কমলপুরের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে যাচ্ছে। প্রতি বিঘা জমি প্রতিবছরে ২০-২৫ হাজার টাকায় লিজ দিচ্ছে গ্রামের মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে জমি লিজ দিতে বাধ্য হচ্ছে। মৎস্য খামারিরা সাধারণত ৭-১০ বছরের জন্য জমি লিজ নিয়ে থাকেন। 

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে আমাদের গবেষণায়। তথ্যটি ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন সংক্রান্ত। ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আইন আছে বাংলাদেশে। সংক্ষেপে আইনটি হলো, কোনো জমির মালিক যদি তার আবাদি বা ধানি জমি পুকুরে বা বাগানে বা বসতবাটিতে রূপান্তর করতে চান তাহলে তিনি উপজেলা পর্যায়ে সহকারী ভূমি অফিসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করবেন। জেলা প্রশাসক যদি অনুমতি দেন তাহলে ধানি জমিকে পুকুরে বা বাগানে বা বসতবাটিতে রূপান্তর করতে পারবেন।

জমির, বিশেষ করে কৃষি জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতি পাওয়া সহজ নয়। ধানি জমিরক্ষার স্বার্থেই জেলা প্রশাসক সহজে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতি দিতে চান না। কমলপুরে মৎস্য খামারিরা লিজ নিয়ে ধানি জমিকে পুকুরে রূপান্তর করে ১০-১২ বছর ধরে মৎস্যচাষ করছেন জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন না করেই। অর্থাৎ যে জমি এখন জলাশয় এবং মৎস্য খামার উপজেলা কৃষি এবং ভূমি অফিসে সে জমি ধানি জমি হিসেবেই আছে। ওখানে ধানের বদলে মাছ চাষ হচ্ছে, প্রচুর মাছ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু জমির শ্রেণি ধানি রেখেই। সরকারি হিসাবে কমলপুরে প্রচুর ধান উৎপাদন হচ্ছে এখনো, অথচ ওখানে শুধুই মাছ উৎপাদন হচ্ছে।


লেখকদ্বয় : সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh