কোন পথে জাতীয় পার্টি

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৩৪ পিএম

রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ফাইল ছবি

রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ফাইল ছবি

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করেছে। দিন দিন বাড়ছে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের দ্বৈরথ। আর এর নেপথ্যের কারণ হলো ক্ষমতার লড়াই। মূলত আসছে নির্বাচনে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে কে থাকবেন তা নিয়ে যেমন চলছে স্নায়ুযুদ্ধ; ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগ না বিএনপি- কোন জোটের সঙ্গে নির্বাচন করবেন, নাকি এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিবেন এসব নিয়ে চলছে মতানৈক্য।

দলীয় সূত্র জানায়, রওশন এরশাদের হঠাৎ ‘রাজনৈতিক তৎপরতা’ নিয়ে নানামুখী সংশয়-সন্দেহ আর ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে দলে। গুরুতর অসুস্থ রওশন এরশাদ বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকলেও তার নামে বিভিন্ন বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি তার নামে দলের জাতীয় কাউন্সিলও ডাকা হয়ে গেছে। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের পক্ষ থেকেও তার অনুসারীরা দিচ্ছেন জবাব। এর মধ্য দিয়ে দলের টানাপড়েন দৃশ্যমান। যদিও বিরোধের বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন চেয়ারম্যান, কিন্তু সিনিয়র একাধিক নেতা দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের ইঙ্গিত দিচ্ছেন বরাবরই। একই সঙ্গে মহাজোটের সঙ্গে জাতীয় পার্টির থাকা না থাকা নিয়েও নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। জি এম কাদেরের তরফ থেকে বলা হচ্ছে- জাতীয় পার্টি জনগণের পাশে থাকতে চায়। মানুষ যে দুর্ভোগ-দুর্গতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে একাত্ম হতে চায়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কর্মসূচি পালন করার চিন্তা করছে। এর অংশ হিসেবে বিএনপি বা সমমনা দলের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ হচ্ছে।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জি এম কাদেরসহ শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেছেন। আর এমন খবরে রওশন এরশাদ খুব বিরক্ত। এই নিয়ে ‘দ্বিধা-বিভক্ত’ জাপা। তবে রওশনপন্থিরা এবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চাইছে। তারা মনে করেন, এবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সরকার গঠন হবে। ফলে তিনি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চান। তবে আগামী কাউন্সিলে নেতৃত্ব বদল হলেও জাপার উভয়পক্ষ (রওশন-কাদের) বিগত দিনের মতোই ক্ষমতায় থাকার পক্ষপাতী। জাতীয় পার্টি কোনো বড় জোটে যোগ দেবে কিনা- এমন প্রশ্নে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩শ আসনে প্রার্থী দেবে এমনটাই সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ লক্ষ্যে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে সারাদেশে কাজ চলছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনো সময় আছে। নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি কী হবে সেটার উপর নির্ভর করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির জোট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের আগে ডিগবাজি দিয়ে আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থেকে যায় কি না সেটাও দেখার বিষয়। তবে সরকারের কাছে আস্থার ‘প্রতীক’ হিসেবে কার্যত রওশন এরশাদই এগিয়ে রয়েছেন। তাই দিন যতই গড়াবে জাপাতে রওশন এরশাদপন্থিদের পাল্লা ভারী হতে থাকবে। কারণ হিসেবে দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমানে জি এম কাদেরের বক্তব্য ও চলাফেরা সন্দেহজনক! সরকার ও বিএনপির ‘দুই নৌকা’য় পা দিয়ে চলতে চাইছেন তিনি। যদিও জিএম কাদের এরই মধ্যে বলেছেন তারা সরকারের সঙ্গে বা জোটে নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, জাতীয় পার্টিতে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূল জাপার দূরত্ব অনেক দিনের। এমন পরিস্থিতিতে জাপা বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে রংপুর অঞ্চলের দু-একটি আসন ছাড়া একক নির্বাচনে আর কোথাও জিততে পারবে না। ফলে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এবং কোন জোট ক্ষমতায় আসবে, তা স্পষ্ট হলে দলটি সিদ্ধান্ত নেবে।

আশির দশকের শেষ দিকে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রীতিমতো টেক্কা দিয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা)। তবে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনে ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। কেউ যান বিএনপিতে, কারও ঠাঁই হয় আওয়ামী লীগে। একপর্যায়ে জাপা ভেঙে হয় চার ভাগ। তবে রাজনীতির মাঠে বরাবরই দাপট দেখিয়েছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন মূল জাপা। ১৯৯১, ৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদীয় আসনে জয়ের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে ছিল জাপা। ২০০৮ সালে দলটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন করে। আর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় জাপা। ২০১৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যান। তার মৃত্যুর পর রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের নেতৃত্বে চলছিল পার্টি। তবে এখন এককভাবে দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় দুজনই। এক পক্ষ সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়। অন্য পক্ষ বলছে সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে তবেই তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যম সারির দুই নেতা বলেন, ভাবি রওশনের সঙ্গে দেবর জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। জি এম কাদের চাকরিজীবন ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে আসার পর থেকেই রওশন বিরক্ত। এ বিরক্তির ছাপ বিগত নির্বাচনে ও দলের নেতৃত্বের পালাবদলের সময়েও ছিল। কিন্তু বর্তমানে সংকট বা দ্বন্দ্ব দুজনের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নয়; এ দ্বন্দ্ব ক্ষমতায় থাকা না-থাকার দর্শন নিয়ে। তবে রওশন এরশাদ দেশে না আসা পর্যন্ত এ দ্বন্দ্বের পরিণতি পরিষ্কার হবে না।

জি এম কাদেরের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এখন কথা বলছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। দলের মধ্যে ভিন্ন তৎপরতায় নেপথ্যে ভূমিকা রাখছেন তিনি। সরকারের সুদৃষ্টিতে থাকায় তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে তিনি দলের কয়েক সিনিয়র নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন। ওই নেতারা এখন জি এম কাদেরপন্থি নেতাদের সন্দেহের তালিকায় আছেন। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে রওশন এরশাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।

অন্যদিকে, রওশনের অনুসারীদের উদ্দেশে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলে আসছেন, কেউ দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। ‘শৃঙ্খলা ভাঙার’ অভিযোগে ইতোমধ্যে পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে আবারও ভাঙনের মুখে জাপা। এবার ভাঙনের শুরু জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে রওশনের পার্টির দশম সম্মেলনের আয়োজনের ঘোষণা এবং রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বসানোর চেষ্টা থেকে। এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে মন্তব্য করায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর মসিউর রহমান রাঙ্গাকে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে তাকে অব্যাহতি দেন। সেই আদেশ এরই মধ্যে কার্যকরও হয়েছে। অথচ রাঙ্গা বর্তমানে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ। তিনি দলটির সাবেক মহাসচিব ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। ফলে রাঙ্গার অব্যাহতি ঘিরে চলছে দুই পক্ষের কথা চালাচালি। এরই মধ্যে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও অব্যাহতি পাওয়া রাঙ্গা।

মুজিবুল হক চুন্নুর অভিযোগ, সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমের কারণে রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন ধরে তিনি জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন ফোরামে দলের স্বার্থবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দু-তিন মাস আগেও রাঙ্গাকে দল থেকে অব্যাহতির কথা চিন্তা করেছিলেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তবে সেসময় ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান রাঙ্গা।

অপরদিকে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলছেন, রওশন এরশাদকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করতে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এমন বক্তব্য দেওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও রওশনের ডাক দেওয়া পার্টির দশম সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বিশ্বাস করে প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কেউ দায়িত্ব নিলে সংগঠন আরও ভালো চলবে। তাতে সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও সময়ের ব্যবধানে ঠিক হয়ে যাবে। সেদিক বিবেচনায় রওশন এরশাদই পারফেক্ট। যেহেতু তার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে।

তিনি বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান (জিএম কাদের) পার্টিকে ভাঙনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি শিক্ষিত মানুষ আশা করি শুভবুদ্ধির উদয় হবে। জাতীয় পার্টি আরও শক্তিশালী হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh