ফাতেমা তমা
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০৪:৩৩ পিএম
বিটকয়েন। ছবি: সংগৃহীত
লেনদেন এবং কেনাকাটায় ভার্চুয়াল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সির জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন এই ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবসায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও শেয়ারবাজার বা সোনার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থ লগ্নির পরিবর্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগকে তুলনামূলক নিরাপদ হিসেবে দেখছেন এবং এতে অর্থ লগ্নিতে উৎসাহী হয়ে উঠছেন।
এদিক থেকে ভারতের বিনিয়োগকারীরাও পিছিয়ে নেই। ভারতেও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ বাড়ছে।ভারতের এমনই একজন বিনিয়োগকারী স্বাতী দাগা। দিল্লির কাছেই তার একটি খাবারের দোকান রয়েছে। স্বাতী সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে বিটকয়েন ক্রয় করেন। সেসময় ক্রিপ্টোকারেন্সি তিন হাজার ডলারের নিচে লেনদেন করতো। অবশ্য তিনি যখন ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগ করেন বিষয়টি নিয়ে তার পরিবার বেশ শঙ্কিত ছিল। সে কথা স্মরণ করে স্বাতী বলেন, ‘পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাকে বলেছিলেন অর্থ জলে ফেলো না।’
কিন্তু ৩৩ বছর বয়সী স্বাতীর এখন ভার্চুয়াল মুদ্রায় বিনিয়োগ নিয়ে কোনো আফসোস নেই; বরং খুশি। এর অন্যতম কারণ ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বিটকয়েনের মূল্য ১৫ গুণ বেড়েছে। স্বাতী তার সঞ্চয়ের ১০ শতাংশ বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন। সিএনএন বিজনেসকে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে পাই শেয়ারবাজার ক্রমে একঘেয়ে হয়ে উঠছে। এর পরিবর্তে ভার্চুয়াল মুদ্রায় বিনিয়োগ করা বেশ রোমাঞ্চকর।’
শুধু স্বাতীই নয়। কোভিড মহামারি শুরুর পর থেকেই ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে। অথচ এশিয়ার এই তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি এতদিন ডিজিটাল ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে। এমনকি এই মুদ্রা নিষিদ্ধ করার বিষয়েও
চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ভারতের ক্রিপ্টো সুপারপাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইন্টারনেট বাজার এই ভারত। দেশটিতে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭৫০ মিলিয়ন। আরও কয়েক মিলিয়ন প্রথমবারের মতো অনলাইনে আসতে যাচ্ছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রহণের প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে গত বছর দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে ভারত। দেশটির আগে রয়েছে ভিয়েতনাম। তবে ভারতে বর্তমানে ঠিক কত মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা করছে সে বিষয়ে সরকারের কোনো হিসাব নেই। সংশ্লিষ্ট শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ক্রিপ্টো ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২০ মিলিয়ন হবে।
ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ কয়েনডিসিএক্সের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও সুমিত গুপ্তা বলেছেন, তরুণদের অনেকেই ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগ করে তাদের ব্যবসার যাত্রা শুরু করেছেন। ২০ বছর আগে এই তরুণদের মা-বাবারা সোনায় বিনিয়োগ করতেন। আর এই তরুণরা বিটকয়েনে বিনিয়োগে আগ্রহী। ভারতীয়রা সাধারণত সোনা অথবা ব্যাংকে সঞ্চয় হিসেবে তাদের অর্থ লগ্নি করে।
কিন্তু বর্তমানে এই ধারায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো ভার্চুয়াল মুদ্রায় বিনিয়োগের সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর মুম্বাইভিত্তিক কয়েনডিসিএক্স ভারতের প্রথম ক্রিপ্টো ইউনিকর্ন হয়ে ওঠে। কয়েনবেজ ভেঞ্চারস এবং বি ক্যাপিটাল গ্রুপের মতো বিনিয়োগকারীদের কল্যাণে কয়েনডিসিএক্সের মোট মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক এক বিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি জানিয়েছে তাদের ১০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের আরেক প্রতিষ্ঠান ওয়াজিরএক্সের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ মিলিয়ন। কোম্পানিটিকে ২০১৯ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জের একটি বিন্যান্স অধিগ্রহণ করে। কোম্পানিটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে ৬৫ শতাংশেরই বয়স ৩৫ বছরের নিচে।
পশ্চিমাঞ্চলীয় স্টেট রাজস্থানের একটি ছোট শহরের বাসিন্দা প্রিতিস কোমাওয়াত ক্রিপ্টোর ব্যবসা করে থাকেন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই কলেজের শিক্ষার্থী। গত বছর বিটকয়েনের বিশাল উল্লম্ফনের কারণে এখানে বিনিয়োগের আগ্রহ বেড়েছে। উল্লেখ্য, গত নভেম্বরে বিটকয়েনের মূল্য রেকর্ড সর্বোচ্চ ৬৮ হাজার ৯৯০ ডলারে পৌঁছে। বর্তমানে তা কিছুটা কমলেও ৪৩ হাজার ডলারে রয়েছে। ডগিকয়েন এবং শিবা ইনুর মতো মিমে কারেন্সিগুলোও ভারতীদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে নারীরা বিটকয়েনে বিনিয়োগের খুবই উৎসাহী। ওয়াজিরএক্স জানিয়েছে, তাদের প্লাটফর্মে নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা এক হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে। মোট ব্যবহারকারীর ১৫ শতাংশই এখন নারী।
তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার এই উত্থানে শঙ্কিত ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অর্থপাচার এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হতে পারে। গত বছর ভারতীয় পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিশে বলা হয় ‘সব ধরনের ব্যক্তিগত ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ’ করা নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তবে দেখা গেছে এ বছরের শুরুতেই ভারতে ক্রিপ্টো ব্যবসা বেশ জোরকদমে শুরু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভার্চুয়াল ডিজিটাল মুদ্রা থেকে আসা আয়ে ৩০ শতাংশ করারোপ করা হবে। আর এটিকে ক্রিপ্টো নিষিদ্ধ না হওয়ার আভাস হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গুপ্তা বলেছেন, ‘ক্রিপ্টো অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ভার্চুয়াল সম্পদে করারোপ করা সঠিক সিদ্ধান্ত। এর ফলে শিল্পটিতে আরও স্বচ্ছতা আসবে।’
তবে ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি এখনো বৈধ করা হয়নি। করহার ঘোষণার কিছুদিন পর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারাম বলেছেন, ‘আমি একে বৈধ অথবা নিষিদ্ধ করার জন্য কিছু করিনি। মূলত সার্বভৌম অধিকারের কারণেই করারোপ করা হয়েছে।’ সূত্র : সিএনএন