বিশ্ব নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

‘যুদ্ধ বন্ধ করুন, সবার কাছে খাবার পৌঁছে দিন’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০৫ পিএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও খাদ্য নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করে সবার কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের ৮০ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরো খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে বলেও জানান তিনি।

আজ সোমবার (১৭ অক্টোবর) গণভবন থেকে ইতালির রোমে শুরু হওয়া ‘বিশ্ব খাদ্য ফোরাম ২০২২’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে ভার্চুয়ালি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি যুদ্ধ বন্ধ করতে, খাদ্য নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে এবং খাদ্যের অপচয় বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অনুরোধ করছি। পরিবর্তে, খাদ্য ঘাটতি এবং দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করুন। মানুষ হিসাবে, আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, প্রত্যেকেরই খাদ্য নিয়ে বেঁচে থাকার এবং একটি সুন্দর জীবন যাপনের অধিকার রয়েছে।

তিনি বলেন, যদি অস্ত্র তৈরিতে বিনিয়োগ করা অর্থের একটি ভগ্নাংশ খাদ্য উৎপাদন এবং বিতরণে ব্যয় করা হয় তবে এই পৃথিবীতে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না।

ভার্চুয়ালি ফোরামে যোগ দিতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ ফোরাম এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা, কোভিড-১৯ মহামারী এবং আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে খরার কারণে বিপর্যস্ত। 

তিনি বলেন, আমি আশা করি, এটি কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমাধানগুলো অগ্রসর করতে মূল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সংলাপকে উৎসাহিত করবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ বা বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বরাবরই ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় যায় এবং ইউক্রেন যুদ্ধ, পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে পরিস্থিতি এখন আরো খারাপ হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করেছে এবং খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। 

তিনি বলেন, বিশ্বে সম্পদের প্রাচুর্য্য রয়েছে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য অবদানের ফলে তা আরো বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও এই বঞ্চনা আমাদের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রকৃত অর্থে আমাদের গ্রহে খাদ্যের কোনো অভাব নেই। অভাব কেবল মানবসৃষ্ট। খাদ্য নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসায়িক স্বার্থ, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের আক্রমণ সবই আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

বিদেশিদের বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আমি বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে চাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে এফএও-তে যোগদানে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, জাতিসংঘের এই আন্তর্জাতিক সংস্থা নতুন দেশটির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী উদ্যোগের মধ্যে ছিল কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সবুজ বিপ্লবের ডাক দেওয়া।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কৃষি উন্নয়নের জন্য দেশের উন্নয়ন বাজেটের পঞ্চমাংশ বরাদ্দ করেন এবং কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুতে কৃষি কর্মসূচি এবং অন্যান্য সকল উন্নয়ন উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়ে।

তিনি আরো বলেন, তারপরে, কয়েক দশক অগ্রগতি ছাড়াই অতিবাহিত হয়। তারপরে গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের জন্য ২১ বছর সংগ্রামের পর, ১৯৯৬ সালের জুন মাসে, তিনি একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত হন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা দেশটিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন, অবিলম্বে, আমি সেখান থেকে শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করেছিলাম এবং বিশেষ করে কৃষিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি অন্যান্য সকল প্রয়োজনের আগে প্রথম স্থান পেয়েছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন চালের ঘাটতি ছিল এবং তার প্রথম মেয়াদ শেষে ২.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন চালের উদ্বৃত্ত ছিল।

তিনি বলেন, বর্তমান মেয়াদে, তারা আবার ধান উৎপাদনে উল্লেযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। মোট চাল উৎপাদন ২০০৮ সালে ছিল ২৮.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন তা থেকে গত বছর উৎপাদন ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বাস্তববাদী নীতি, শক্তিশালী প্রণোদনা এবং বিশেষ করে আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।

তার সরকারের নীতিতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যান্ত্রিকীকরণ এবং নতুন প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতিতে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হারে ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তাদেরকে ৭১ হাজারের বেশি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া, ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তার দ্বিতীয় মেয়াদে পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ২০ মিলিয়ন কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কার্ডধারীদের ফসল উৎপাদনের জন্য সরাসরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঋণ দেওয়া হয় এবং কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, এছাড়াও, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য একটি কৃষি ও গ্রামীণ ঋণ নীতি গ্রহণ করেছে। ২০২০-২০২১ সময়কালে, ২.২৫ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, কৃষকদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটাতে সারাদেশে ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং মোবাইল ও ওয়েব-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে কৃষি সংক্রান্ত তথ্য সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওয়েব পেজ ‘কৃষি বাতায়ন’ তৈরি করা হয়েছে যাতে কৃষকদের কাছে কৃষি সংক্রান্ত তথ্য ও  সেবা সহজে পাওয়া যায়।

তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের কৃষি খাত জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বলে, এবং জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই কৃষির জন্য একটি বড় হুমকির সম্মুখীন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষি পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ শাকসবজি, মাছ এবং অন্যান্য কৃষিভিত্তিক পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সফল হয়েছে, যার বেশিরভাগই রপ্তানি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বে বাংলাদেশ আজ পাট ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, চাল ও সবজিতে ৩য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ এবং এগারোটি ইলিশ মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে। 

তিনি বলেন, আগামীকালের ইনভেস্টমেন্ট ফোরামে যে ২০টি দেশের প্রদর্শনী হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ হবে অন্যতম। আমরা বাংলাদেশের জন্য মূল্য শৃঙ্খলসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো উপস্থাপন করব। আমরা আমাদের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার দিকেও নজর দেব এবং অন্যান্য ব্যবসার সুযোগ তুলে ধরব।

শেখ হাসিনা খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে উন্নীত করতে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য এফএওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আমি আশা করি, এফএও বিশেষ করে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর, পুষ্টি এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবিকা ব্যবস্থার স্বার্থে তা অব্যাহত রাখবে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh