হুমকির মুখে খাদ্য নিরাপত্তা

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২২, ১০:২৩ এএম

 সংকটে খাদ্য নিরাপত্তা। ছবি: সংগৃহীত

সংকটে খাদ্য নিরাপত্তা। ছবি: সংগৃহীত

করোনার অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। মূল্যবৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক সরবরাহ ভেঙে পড়েছে। বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে সার ও কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে। সংকটে খাদ্য নিরাপত্তা।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর বিশ্বে মন্দার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বলা হচ্ছে- বিশ্বে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক মন্দা বর্তমানের তুলনায় আরও ব্যাপকভাবে দেখা দিতে পারে; বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। 

খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে গেছে জানিয়ে এফএওর হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা বিশ্বের ৪৫টি দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপেও খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে ধরনের ইঙ্গিত দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের জনগণকে উৎপাদন বাড়ানো ও সঞ্চয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।  

এফএওসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার প্রক্ষেপণে গোটা বিশ্বেই চলতি বছর খাদ্যশস্য উৎপাদন কমার আশঙ্কা করা হয়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য উৎপাদন কমবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের বাকি সব মহাদেশ বা অঞ্চলেই এবার খাদ্যশস্য উৎপাদন কম-বেশি হারে কমবে। 

সম্প্রতি জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের এক ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে। সমীক্ষাটি বলছে, বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে শুধু না খেতে পেয়ে। এ মুহূর্তে বিশ্বের সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। আমাদের দেশসহ আরও ৪৫টি দেশের কোটি কোটি মানুষের দিন কাটে অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য সংকট তৈরি হয় না, এর জন্য খাদ্য বণ্টনের অসমাঞ্জস্যতাসহ নানা সমস্যাই দায়ী।

করোনা মহামারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। করোনার আগে যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ইয়েমেন প্রয়োজনীয় খাদ্যের ৯০ শতাংশ আমদানি করে। এর ৩০ শতাংশ আমদানি হয় কৃষ্ণসাগর দিয়ে। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো অচল হয়ে পড়ে।

ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন এখন তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ায় ইরাকের মতো তেল রফতানিকারক দেশ লাভবান হলেও, তারাও আজ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে। কেননা ইরাকে বছরে ৫২ লাখ টন গমের প্রয়োজন, সেখানে দেশটিতে উৎপাদন হয় অর্ধেকেরও কম। ব্যাপক খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কায় পড়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ। মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা এসব দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশেরও। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এ মুহূর্তে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সে হারে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি। বিবিএস ও ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া ৫ শতাংশের বেশি। আর এ সময় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশেরও কম। দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গম উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টনে।

জনসংখ্যা তথা চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে উৎপাদন সেভাবে না বাড়ায় দেশে খাদ্যশস্যের আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। যদিও বিশ্ব বাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে এখন চাহিদামাফিক আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশে ৬৭ লাখ ৩০ হাজার টন চাল ও গম আমদানি করা হয়েছিল; কিন্তু বিশ্ব বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বাড়তির দিকে থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার টনে।

এতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিকে কেবল কক্সবাজারের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা চাপে পড়ার প্রধানতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবার তা গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছে এফএও। বর্তমানে বিশ্বে বহিরাগত উদ্বাস্তুদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতা দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এদেশে। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক দাতাদের সহযোগিতায় এ উদ্বাস্তুদের ভরণপোষণ করা হলেও এখন সে সহায়তাও দিন দিন কমে আসছে।

অপরদিকে খাদ্য অপচয় বিশ্ব অর্থনীতির ওপর বড় আঘাত। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলেও তা ক্ষুধার্তের কাছে পৌঁছায় না। জাতিসংঘের পরিবেশসংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বছরে খাদ্য নষ্টের মোট আর্থিক মূল্য ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর উন্নয়নশীল দেশে এর পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।

ধনী দেশগুলোতে ভোক্তারা বছরে ২২ কোটি ২০ লাখ টন খাবার নষ্ট করে, যা আফ্রিকায় সাহারার নিচে স্থিত দেশগুলোর মোট খাদ্য উৎপাদনের (২৩ কোটি টন) সমান। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বছরে মাথাপিছু খাবার নষ্ট করার পরিমাণ প্রায় ১১৫ কেজি। আর যে পরিমাণ খাবার বিশ্বজুড়ে নষ্ট করা হয়, তার এক-চতুর্থাংশও যদি বাঁচানো যায়, তা হলে এ দিয়ে ৮৭ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব। 

দেশে খাদ্য ঘাটতি নিয়ে আশঙ্কা বাড়াচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাবও। দীর্ঘায়িত খরায় ব্যাহত হয়েছে আমন মৌসুমের চাষ। এর আগে গত মে মাসে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় বোরো ধানসহ ব্যাপক ফসলহানির শিকার হয়েছেন কৃষক। এফএওর হিসাব অনুযায়ী ওই সময়ের বন্যায় অন্তত ৭২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাণ ও সম্পদহানির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষি অবকাঠামোও ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সামনের দিনগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ফকরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ বছর তিনবার বন্যা হয়েছে। সামনে আরও বাড়তে পারে। তাই এখন থেকেই পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। আবার উৎপাদনের পর কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কৃষক অন্য পেশায় চলে যেতে পারেন। যদি এগুলো নিশ্চিত করা না যায়, তা হলে সংকট বড় ধরনের হতে পারে। 

তিনি আরও বলেন, আপৎকালীনের জন্য খাদ্য মজুদ ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। অন্তত দুই মিলিয়ন টন চাল মজুদ রাখতে হবে। সরকারি গুদামে বেশিদিন মজুদ রাখা যায় না। এজন্য মজুদ ব্যবস্থায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, কৃষি সবসময়ই ঝুঁকিতে থাকে। বিষয়টি আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তবে বড় কোনো দুর্যোগ না হলে বিশ্বের যেখানেই খরা হোক, যুদ্ধ হোক; বাংলাদেশের মাটিতে ফসল হবেই। তাই খাদ্য সংকটের শঙ্কা নেই।

অবশ্য আমাদের দেশে বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন গম লাগে। আমরা ১০ লাখ টনের মতো উৎপাদন করতে পারি। বাকিটা আমদানি করতে হয়। আবার গমের সংকট বিশ্বব্যাপী। এখানেই বড় শঙ্কা। আমরা যদি ৫০ লাখ টন গম আমদানি করতে না পারি, তখন চালের ওপর চাপ পড়বে। চালের ক্ষেত্রে যদিও সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি অনেক দেশ থেকেই আমদানির সুযোগ রয়েছে। 

সরকারি গুদামে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে আমন উৎপাদন ভালো হয়েছে বলে জেলা প্রশাসকরা তথ্য দিয়েছেন। তবু পাঁচটি দেশ রাশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে। ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালুর ফলে চালের দাম কমেছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আরও বেশি সময় পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh