তথ্য সচিবের অবসরের নেপথ্যে

মাসুদ শাহরিয়ার

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২২, ১০:৪৫ এএম

মো. মকবুল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

মো. মকবুল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে সরকার। তার এ অবসর প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ সরকারের আস্থাভাজন না হলে কোনো কর্মকর্তা সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন না।

অন্যদিকে যেখানে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পরও কর্মকর্তাদের লঘুদণ্ড হয়। এমনকি পরে সেসব লঘুদণ্ড ও বাতিল হতে দেখা গেছে। সেখানে মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতো একটি সর্বোচ্চ প্রশাসনিক নির্বাহীর পদ থেকে একেবারে বিদায় করে দেয়ার বিষয়টি সবাইকে অবাক করেছে।

আলোচনার কেন্দ্রে একটি প্রশ্ন কী এমন অপরাধ করেছিলেন মকবুল হোসেন যে, তাকে চাকরি থেকে একেবারে বিদায় করে দেয়া হলো। নেপথ্যের কারণ কী? নেপথ্যের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যম বিভিন্ন অভিযোগের বিষয় সামনে এনে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তবে এ বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী- কেউই মুখ খোলেননি। কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে- কী কারণে এ শাস্তি তিনি পেয়েছেন সেই বিষয়ে কিছুই ধারণা করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন মকবুল হোসেন।

গত ১৬ অক্টোবর মকবুল হোসেনকে অবসর দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা হলো। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। স্বাভাবিকভাবে আগামী বছরের (২০২৩ সাল) ২৫ অক্টোবর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল মকবুল হোসেনের।

আইনের ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বৎসর পূর্ণ হইবার পর যে কোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করিলে কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া তাহাকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে।’

আলোচনায় নানা অভিযোগ

বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সচিবের বিরুদ্ধে। সেই দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ রয়েছে সরকারের হাতে। তাই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেউ বলছেন, মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিএনপিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তিনি কয়েক মাস আগে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বলা হচ্ছে- এ দলে আরও কর্মকর্তারা রয়েছেন। মকবুল হোসেনের মাধ্যমে তাদের কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার।

তবে কোনো গণমাধ্যই এসব অভিযোগের অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি। সম্ভাব্য নেপথ্যের কারণ হিসেবে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে।

কিছু জানেন না তথ্যমন্ত্রী

সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত।

গত ১৭ অক্টোবর সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি (সচিবের অবসর) অন্তর্নিহিত কী কারণ সেটা আমি জানি না। অন্তর্নিহিত কারণ বলতে পারবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সচিবকে অবসর দিতে পারে, তাকে আবার এক্সটেনশন দিতে পারে, দেয়। আবার সচিবের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সচিবকে সরিয়ে দেয়, অবসর দেয়- এগুলো আগেও ঘটেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবে।’ 

কোনো তথ্য দেননি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও

বিষয়টি এড়িয়ে চলছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও। জনপ্রশাসন সচিব সাংবাদিকদের মুখোমুখি হচ্ছেন না। প্রতিমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকার আইন, বিধি-বিধান মেনেই তাকে অবসর দিয়েছে। এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই।’ তথ্য সচিবকে অবসরে পাঠানোর কারণের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যে আদেশ রয়েছে, এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রতিমন্ত্রী।

এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মন্ডল সাংবাদিকদের বলেন, কারও চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর হলে সরকার যে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারে।

যা বলেছেন মকবুল হোসেন

প্রজ্ঞাপন জারির পরদিন দুপুর দেড়টার দিকে মকবুল হোসেন সচিবালয়ে তার দফতরে আসেন। খবর পেয়ে সাংবাদিকরা যান তার কক্ষে। তিনি তার চেয়ারে না বসে পাশে দাড়িয়ে ৩০ মিনিটের মতো কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই আবেগতাড়িত হয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কয়েকবার কেঁদেও ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমি যতদিন এখানে কাজ করেছি, সততার সঙ্গে করেছি, নিষ্ঠার সঙ্গে করেছি, সরকারকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আমার জানা নেই, আমার জ্ঞানের ভেতর নেই, আমার কোনো অপরাধ ছিল কিনা বা কোন অপরাধের কারণে অবসরে দেওয়া হয়েছে, সেটিও আমার জানা নেই। যেহেতু এটি সরকার পারেন, আইনের ভেতরেই পারেন সেজন্য এটি কার্যকর। আমি সরকারের প্রতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল।’

অন্যান্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আপনারা সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধান করতে পারেন। সরকারবিরোধী কোনো অ্যাক্টিভিটিজে আমার সম্পৃক্ততা ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে সেটি আপনারা প্রচার করতে পারেন, আমার পক্ষ থেকে কোনো অসুবিধা নেই।’ বিদায়ী সচিব বলেন, ‘অন্য কোনো দলের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ছিল না। আমার আপন বড় ভাই আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। আমি হলে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিও ছিলাম। আমরা ভাইয়েরা মুক্তিযোদ্ধা।’

‘আমরা এখানে চেষ্টা করেছি, আমাদের অফিস টাইমের পরও সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য, এ মন্ত্রণালয়ের মান-সম্মান-ইজ্জত বাড়ানোর জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী ছিলাম। আমি এমন কোনো দিন নেই যে, ২ ঘণ্টা বেশি কাজ করিনি’- বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার। এর পর বলেন, ‘আমি একটি কথা শুধু বলতে পারি- আমি কখনো আমার জীবনে নীতি-নৈতিকতার সাথে কম্প্রোমাইজ (আপস) করিনি।’

আপনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে হয়তো আপনারা যোগাযোগ তৈরি হয়েছে বলা হচ্ছে- এ বিষয়ে মকবুল বলেন, ‘আমরা লন্ডনে গিয়েছি গত মার্চ মাসে। হয় কি হাতি যখন পাঁকে পড়ে, চামচিকাও লাথি মারে- এমন একটা কথা আছে না। সেটা তো মার্চ মাসে হয়েছে। এখন সেই প্রশ্নটা আসে কী করে। আমি তারেক রহমানকে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে হয় না। তারেক রহমানকে দেখার ইচ্ছাও আমার নেই। যে সারাজীবন একটাকে বিলং করলো, যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে, সে বিএনপির লোকের সঙ্গে কানেকশন রাখবে- এটা হয় না, এটা হতে পারে?’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh