সোনারগাঁওয়ের ‘হারানো’ নগর ও জাদুঘর

মাহাবুবা আখতার

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩৪ এএম

পানাম নগর। ছবি: সংগৃহীত

পানাম নগর। ছবি: সংগৃহীত

যারা ইতিহাস ও লোকজশিল্প ভালবাসেন অথবা যারা শহরের ব্যস্তজীবন ছেড়ে যান্ত্রিকতা-বিবর্জিত কোনো জায়গায় সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন, সেসব ভ্রমণপিপাসুর জন্য কালগর্ভে ‘হারানো’ সোনারগাঁওয়ের পানাম নগর এবং পার্শ্ববর্তী কারুশিল্প যাদুঘর হতে পারে আদর্শ দর্শনীয় স্থান। 

পানাম নগর 

রাজধানী ঢাকার মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত এই প্রাচীন নগরের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। অনেকের কাছে এটি ‘হারানো নগর’ নামেও পরিচিত। মুঘল আমলে বাংলার বারো ভূঁইয়াখ্যাত ঈসা খাঁর রাজধানী ছিল পানাম নগর। সমগ্র সোনারগাঁয়ের শাসনকার্য পরিচালিত হতো পানাম নগর থেকে। এ নগরের পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথ দিয়ে বিখ্যাত মসলিন কাপড় নিয়ে যেত বণিকেরা। ওই সময়ের বিখ্যাত পানাম নগর আজ পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে যে স্থাপনাগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর বেশিরভাগই দুইশ বছরের বেশি পুরনো নয়। 

উনিশ শতকে ইংরেজদের সহায়তায় কিছু ধনাঢ্য হিন্দু বণিক পুনরায় হারিয়ে যাওয়া পানাম নগরকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নগরের পূর্ব-দক্ষিণে প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ ও ৫ মিটার প্রশস্ত সড়কের দুধারে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত ৫২টি ভবন-স্থাপনা বর্তমানে টিকে আছে। এর উত্তর দিকে ৩১টি ও দক্ষিণ দিকে ২১টি স্থাপনা অবস্থিত। স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মুঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। পানাম নগরে গড়ে উঠেছিল সুরম্য অট্টালিকা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাকশাল, দরবারকক্ষ, ভোজনালয়, বিচারালয়, প্রমোদকুঞ্জ, প্রশস্ত দেয়াল প্রভৃতি স্থাপনা। 

নগরীতে এখনো দেখা যায় ৪০০ বছরের পুরনো মঠ-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। এখানে রয়েছে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কুখ্যাত ‘নীলকুঠি’। পানাম নগরের নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। নগরের প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে কূপসহ আবাস উপযোগী নিদর্শন। পানি সরবরাহের জন্য দুপাশে পুকুর রয়েছে; রয়েছে পঙ্খীরাজ খাল। শের শাহের আমলে নির্মিত সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৬০০ মাইলের ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড-ট্রাংক রোডের কিছু অস্তিত্ব আজও পানামে দেখা যায়। সোনালি ইতিহাসের সাক্ষী পানাম নগর প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। 

পানাম নগর দেখভালের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। এ নগরে প্রবেশের জন্য দেশি পর্যটকদের জন্য ১৫ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য ৫০ টাকা এবং এর বাইরে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা প্রবেশমূল্য হিসেবে নির্ধারিত।

সোনারগাঁও জাদুঘর

ঐতিহাসিক পানাম নগরের মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো দূরত্বে অবস্থিত লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনটিই লোকমুখে সোনারগাঁও জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। যারা পানাম নগর ঘুরতে যান, একবারের জন্য হলেও তারা ঢুঁ মারেন এ জাদুঘরে। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় শিল্পাচার্য জয়নুল বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। এখানে এলে প্রথমেই নজর কাড়ে প্রায় শত বছর পুরনো এক অট্টালিকা, যা বড় সর্দারবাড়ি নামে খ্যাত। জাদুঘর চত্বরে আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তৈরি গরুর গাড়ির ভার্স্কয, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভার্স্কয।

তিনতলা এ জাদুঘরটির গ্যালারিগুলোতে কাঠ খোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, তামা-কাঁসা-পিতলের নিদর্শনে লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, লোকজ অলঙ্কারসহ অনেক কিছুই রয়েছে। প্রাঙ্গণের বাইরের অংশে বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে কারুশিল্প গ্রাম। এখানে কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে; রয়েছে দীঘিতে মাছ ধরার সুব্যবস্থা। কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। বিদেশি পর্যটকদের জন্য এ মূল্য ১০০ টাকা। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh