মহামারি রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২২, ১১:৫৩ এএম | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২২, ০১:০৫ পিএম

ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা। ছবি: সংগৃহীত

ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস মহামারি শেষ না হতেই আসছে ডেঙ্গু মহামারি। এই অক্টোবর মাসেই একদিনে সর্বোচ্চ আটজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত শতাধিক মৃত্যু হয়েছে সারাদেশে। এর মধ্যে চলতি অক্টোবরেই মারা গেছে ৪১ জন; সেপ্টেম্বরে মারা গেছে ৩৪ জন। অক্টোবরের ১৭ দিনেই সেপ্টেম্বরের ৩০ দিনের চেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

বর্তমানে হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা। সিট দিতে পারছে না বলে অনেক হাসপাতালে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মশক নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার; বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের লোকরা নির্বিকার। ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যবস্থা গতানুগতিক। একটি বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে মশক নিধন কর্মসূচি, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে।    

মশক নিধন কর্মসূচি ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে অনেকে বলছেন, চলতি অক্টোবর মাসটি হতে যাচ্ছে ডেঙ্গুর মাস। এ মাসের গত ১৭ দিনে ৯ হাজার ৯৪৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। পুরো সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯১১ জন। সামনে আরও যে কদিন রয়ে গেছে তাতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সময়ে আরও ৯ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। কারণ ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ দেশে বিরাজমান। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশা জন্মানোর জন্য আদর্শ স্থান রয়েছে হাজার হাজার। যেখানে সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীরা কখনো যায় না অথবা পৌঁছতে পারে না। ফলে একদিনে ৯শর কাছাকাছি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।  

অন্যদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, এ সময়ে ডেঙ্গু জ্বর হলে অনেকে এখন বুঝতেই পারছেন না। কারণ শরীরে তেমন তাপ ওঠে না। এটাই শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ সময় জ্বর হলে বিলম্ব না করে তিনদিন পর সবার উচিত ডাক্তার দেখানো ও পরীক্ষা করা। 

এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যারা আক্রান্ত হয়েছেন এদের বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকা শহরের। যেমন- গত ১৬ অক্টোবর সারা দেশে ৮৫৫ জন আক্রান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে ৫২৩ জনই রাজধানী শহরে ৫১ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডেঙ্গু আক্রান্তের এই হারটা কেবল যারা স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত হাসপাতালে পরীক্ষা করেছে অথবা যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে বা নিচ্ছে তাদের।

এর বাইরেও অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে; কিন্তু তাদের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকায় আসে না। অনেক হাসপাতালের তালিকাও থাকে না স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জিন্সি অপারেশন অ্যান্ড কনট্রোল রুমে। ফলে এরা তালিকার বাইরেই রয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি; এমনকি মৃত্যুর সংখ্যাও। 

ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাসুদর রহমান বলেন, ‘এটা খুবই সহজ। ঢাকার অনেক স্থানে প্রায় প্রতিদিনই ফগিং করা হয়, এমনকি লাভিসাইডিংও করতে দেখা যায়; কিন্তু এই ওষুধগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে মশার মধ্যে এক ধরনের ‘রেজিস্ট্যান্স গ্রো’ (মশার দেহে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ব্যবস্থা) গড়ে উঠেছে। ফলে মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে এগুলো পরিবর্তন করার সময় এসেছে। মশার বংশ বৃদ্ধি রোধে নতুন ওষুধ আনতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কারা নতুন ওষুধ ব্যবহার করে ফল পাচ্ছে, সেসব ওষুধ নিয়ে আসতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, অতি সত্ত্বর পুরনো ওষুধ ব্যবহার বাদ দিতে হবে। বাইরে ওষুধ ছিটালেও ঢাকা মহানগরীর নির্মাণাধীন ভবনের পানিতে যে ডেঙ্গু জীবানুবাহী এডিস মশা অবাধে জন্ম নিচ্ছে সেখানে নজর দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের উচিত প্রতিদিনই নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান চালানো। যেখানে মশা পাওয়া যাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে অন্যরা সচেতন হবেন। 

গত ১৬ অক্টোবর ঢাকা মহানগরীর ৫১ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের এক হাজার ৯৫৭ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিন হাজার চারজন। এর মধ্যে ঢাকাতে চিকিৎসাধীন আছেন দুই হাজার ১৫ জন। ডেঙ্গু রোগীতে হাসপাতালগুলো ঠাসা থাকার কারণে নতুন রোগীও ভর্তি করা যায় না।

রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে; কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে হাসপাতালগুলোয় এ ধরনের সেবাও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। হাসপাতালে সিট না পেয়ে এখনই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে। 

মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিন দেখা গেছে, কমপক্ষে ৫০ জন ডেঙ্গু রোগীকে তারা মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা দিচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও একই অবস্থা। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাসুদুর রহমান বলেন, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের জ্বর কম হচ্ছে। ফলে অনেকেই সামান্য জ্বরে ডাক্তারের কাছে যান না অথবা জ্বর বাড়লে যাবেন, পরীক্ষা করাবেন- এমন মনোভাবের কারণে অনেকের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। জ্বরের তিনদিন চলে গেলে হাসপাতালে গিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে আসা উচিত। অবহেলা করলে নিজের ক্ষতিই ডেকে আনা হবে।  

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘জ্বর হলে দেরি করা ঠিক নয়। কারণ এখনকার ডেঙ্গু জ্বরে শরীরের তাপ তেমন বাড়ে না।’ ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এর কোনো ওষুধ নেই। ভাইরাসের কারণে শরীরে যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নেওয়ার চিকিৎসা দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। যেমন- ডেঙ্গু হলে রক্তচাপ কমে যায়। সে কারণে স্যালাইন দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।

আবার রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়া হয়। ডা. মাসুদুর রহমান বলেন, বেশি করে ফ্লুইড দেয়া হলে রোগী সুস্থ থাকেন, তার খুব বেশি ক্ষতি হয় না। 

ডেঙ্গু হলে শুরু থেকে প্রচুর পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে ভিটামিন সি জাতীয় সব ধরনের ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন। লেবুর শরবত খুবই উপকারী। এর বাইরে জাম্বুরা, কমলা, মাল্টা খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

ডা. মাসুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর শুরুতে রোগীকে কিছুক্ষণ পর পর খাওয়ার স্যালাইন দেয়া হলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয় না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খাওয়ার স্যালাইন নিয়মমতো গুলিয়ে খাওয়াতে পারলে ডেঙ্গুর খারাপ লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় না। তবে অবস্থা খারাপ হলে রোগীর লোহিত কণিকা ভেঙে যায়। নাক, মুখ, চোখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। ত্বকের নিচে লালচে হয়ে যায়। অবস্থা খারাপ হলে রোগী শকে চলে যেতে পারে।

সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু জ্বর বা রক্তক্ষরণ হলেই তা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলতে হলে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকতে হবে। ডেঙ্গু হলে রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষার মাধ্যমে প্লাটিলেটের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়।

প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের কম হলে তাকে হেমোরেজিক বলে ধরে নেয়া যায়। প্লাটিলেট বিপজ্জনক মাত্রায় না নামা পর্যন্ত (২০ হাজারের নিচে) প্লাটিলেট বা রক্ত সংগ্রহ করার জন্য দুশ্চিন্তারও কারণ নেই। কারণ খুব কমসংখ্যক রোগীরই শেষ পর্যন্ত প্লাটিলেটের দরকার হয়। আর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ডেঙ্গুর আসল চিকিৎসা প্লাটিলেট সঞ্চালন নয়, বরং পানিশূন্যতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, প্লাজমা লিকেজ বা প্লাজমা রক্তনালির বাইরে যাতে চলে না আসে, সে চেষ্টা করা। রক্তক্ষরণের জন্য ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না, বেশিরভাগের মৃত্যু ঘটে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। মানে রোগী যখন শকে চলে যায়, হৃৎস্পন্দন দুর্বল হয়ে পড়ে, রক্তচাপ নেমে যায় আর শরীরের বিভিন্ন অপরিহার্য অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh