মসজিদের প্রথম নারী নকশাকার জয়নেপ ফাদিলিওগলু

অনিন্দ্য হাসান

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২২, ০২:৫৪ পিএম | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২২, ০২:৫৭ পিএম

জয়নেপ ফাদিলিওগলু। ছবি: সংগৃহীত

জয়নেপ ফাদিলিওগলু। ছবি: সংগৃহীত

তুরস্কের সর্বকালের সর্বসেরা স্থপতি মিমার সিনান (১৪৯০-১৫৮৮)। সে দেশে যুগে যুগে বহু স্থপতি এসেছেন, যারা জগতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। স্থাপত্য ও স্থপতির স্বর্গরাজ্য তুরস্ক। একালেও বহু স্থপতি রয়েছে, যাদের সুনাম ছড়িয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। সেরকম একজন জয়নেপ ফাদিলিওগলু। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জয়নেপ ফাদিলিওগলুর জন্ম ১৯৫৫ সালে। তিনি তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।

তার স্থাপত্যশৈলী খুবই স্বাতন্ত্র্যময়। তিনি মূলত সাড়া ফেলেন ইস্তাম্বুলের উস্কুদুর জেলার বিখ্যাত শাকিরিন মসজিদের নকশা করে। এটি যে কোনো নারীর করা মসজিদের প্রথম নকশা। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে স্থাপত্যশিল্পে মর্যাদাবান আগা খান অ্যাওয়ার্ডে তাকে ভূষিত করা হয়। ফরাসি স্থপতি জ্যঁ নোভেল, চায়নিজ-আমেরিকান স্থপতি আইএম পেই, আমেরিকার ভাস্কর রিচার্ড সেরা, ভারতীয়-ব্রিটিশ ভাস্কর আনিশ কাপুর, কানাডার স্থপতি ফ্রাঙ্ক গেরি- এদের কাতারে তাকে বিবেচনা করা হয়।

ডিজাইনবুম ডটকমে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছে- অনিন্দ্য হাসান।

আপনি কীভাবে একজন স্থপতি হলেন? 

একাডেমিকভাবে আমি স্থপতি হইনি। বরং ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে আমি এটা হয়েছি। আমি দ্য ইন্স বাল্ড স্কুল অব ডিজাইন-এর শিল্পের ইতিহাস ও নকশার একজন স্নাতক। আমার ১২ স্থপতি ও ১৩  নকশাকারের একটি দল আছে; যারা আমার নকশাকে একটি স্থাপত্য ভাষায় রূপান্তর করে। আমি সবসময় শিল্প ও নকশার ব্যাপারে আগ্রহী। নিজের গহনা নকশা করেছিলাম, যখন আমার বয়স ১২ বছর।

কোন প্রেক্ষাপট ও বিশেষ দিকগুলো আপনার নকশা ও দর্শনে প্রভাব রেখেছে?

আমার দাদু ও নানু টেক্সটাইল ব্যবসায় ছিলেন। কাপড়ের প্রতি আবেগ ও প্রাচীন জিনিসপত্র সংগ্রহের বিষয়টি তাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। আমি বেড়ে উঠেছি পানিবেষ্টিত একটি প্রাসাদে। এটি গড়ে ছিলেন বিখ্যাত স্থপতি গার্বেট বালিয়ান (১৮০০-১৮৬৬)। এখানে দিনযাপনের জন্য পরিবেশ, শিল্পকলা ও নকশা- সবছিল খুব উঁচুমানের। আমি শিল্প সংগ্রহ শুরু করি যখন আমার বয়স ১৪ বছর। অবশ্যই আমি আমার পিতার নির্দেশনা ও সহায়তার কথা বলি।

তিনি আমাকে লন্ডনের ইন্সবন্ড স্কুল অব ডিজাইনে শিল্পের ইতিহাস ও নকশা অধ্যয়নের জন্য পাঠিয়েছিলেন।এটা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। আমি অটোমান পরিবারের একজন বংশধর হওয়ার কারণে, তাদের রঙিন ও জাদুকরী অভ্যন্তরীণ জগত আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছি। যে সময়কালে টার্কি তার মুখ পুরোপুরি পশ্চিম দিকে ঘুরিয়েছিল; সেই রিপাবলিকান যুগে শিক্ষিত হওয়ার কারণে, আমি পশ্চিমা দৃষ্টিতে অটোমান সংস্কৃতি ও শিল্পকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ ও সৌভাগ্য অর্জন করেছি।

কী বা কে আজ পর্যন্ত আপনার কাজের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে?

কে- আমার স্বামী যিনি আমাকে আমার নিজস্ব নকশা, অফিস খুঁজে পেতে উৎসাহিত করেছিলেন। কী- আমার স্বামীর ব্যবসা, যা আমাকে রেস্তোরাঁ, ক্লাব ও সমুদ্রসৈকতে আমার স্থাপত্য এবং অভ্যন্তরীণ নকশার দক্ষতা অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছে।

আপনি মসজিদ থেকে নাইট ক্লাব পর্যন্ত বিস্তৃত প্রকল্পজুড়ে কাজ করেন, এটি একটি স্থাপত্য পরিচয় বজায় রাখার ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে?

যে কোনো প্রকল্পে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিপ্রস্তর একই থাকে: নিরবধিতা, মুক্তমনা, রঙের প্রতি ভালোবাসা, টেক্সচারের স্তর ও স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য। আমার কাজ ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের একটি আধুনিক উপলব্ধি প্রতিফলিত করে। আমার অনুপ্রেরণার প্রধান অংশ হিসেবে আমার নিজ শহর ইস্তাম্বুল ব্যবহার করে, আমার ডিজাইনে আমি পূর্ব ও পশ্চিমের নান্দনিকতাকে একত্রিত করার চেষ্টা করছি এবং স্থানীয় অনুভূতি ও একটি সর্বজনীন আবেদন আছে- এমন কাজ তৈরি করতে অটোমানদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করছি। আমি সারা বিশ্বের শীর্ষ কারিগর ও শিল্পীদের সাথে কাজ করি।

মসজিদের নকশা করার সময় কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা সামাজিক নকশার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার?

আমার নকশা সবসময় ক্লায়েন্টের অনুরোধ ও প্রয়োজনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। তাদের প্রত্যেকটি পরিবেশ ও ভবনের স্থাপত্যের সাপেক্ষে নকশা করা হয়েছে। একটি মসজিদ নকশা করার সময় ধর্মীয় বিধান নকশার কাঠামোকে সংজ্ঞায়িত করে। এই ফ্রেমের মধ্যে আমি মসজিদে মুসল্লিদের চাহিদা সম্পর্কে সচেতন থেকে আমার ক্লায়েন্টের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করছি। মসজিদে মুসল্লিদের একটি নির্মল পরিবেশ প্রদান করা উচিত। বিশ্বাসীদের ঐতিহ্যকে আঘাত না করার জন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে।

আপনাকে ‘মসজিদের প্রথম নারী নকশাকার’ বলা হয়। এই তকমায় কোনো ধরনের চাপ বহন বা প্রশংসার ব্যাপারটি কী দাঁড়ায়?

আমি কিছু তুর্কি লোকদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিলাম। তাদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, তারা নাকি আরও ভালো করতে পারত। আমি বিশ্বাস করি এই প্রকল্পটি তাদের জন্য কমিশন বয়ে আনেনি বলে তারা আমার ওপর ঈর্ষান্বিত ছিল। দেশের শাসকশ্রেণি, আন্তর্জাতিক দর্শক ও বিশ্বগণমাধ্যম থেকে প্রশংসা এসেছে। আজ ‘সাকিরিন মসজিদ’ ইস্তাম্বুলের ‘অবশ্যই দেখার’ মতো একটা স্থাপনা।

আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, এমন একটি বিষয় রয়েছে- যা সমস্ত ধর্মের ধর্মীয় ভবনকে এক করে?

সমস্ত ধর্মীয় ভবনের একটি সাধারণ লক্ষ্য রয়েছে- বিশ্বাসীদের জন্য তাদের ঐশ্বরিকতার সাথে সংযোগের পথ খোলা রাখা।

আপনি বর্তমানে কী বিষয়ে আগ্রহী, আর এটি আপনার সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে কীভাবে পুষ্ট করে?

শিল্প ও প্রাকৃতিক জগৎ আমাকে সবসময় প্রণোদনা জোগায়।

প্রশংসা করতে বললে আপনি জগতের কোন স্থপতি ও শিল্পীর কাজের প্রশংসা করবেন?

ফরাসী স্থপতি জ্যঁ নোভেল, চাইনিজ-আমেরিকান স্থপতি আই এম পেই, আমেরিকার ভাস্কর রিচার্ড সেরা, ভারতীয় ব্রিটিশ ভাস্কর আনিশ কাপুর, কানাডার স্থপতি ফ্রাঙ্ক গেরি।

আপনি কি আমাদের কোনো সম্ভাব্য প্রকল্প সম্পর্কে বলতে পারেন, যেটি নিয়ে বিশেষভাবে উত্তেজিত?

আমাদের সারাবিশ্বে অনেক প্রকল্প চলমান। প্রাসাদ, হোটেল, দোকান- সবই খুব উত্তেজনাপূর্ণ। আমরা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের আসবাবপত্র ও আনুষঙ্গিক লাইন চালু করেছি। এটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক মনোযোগ পাচ্ছে। শিগগিরই বিশ্বের নির্বাচিত নকশাকারদের সাথে প্যারিসে আমাদের পণ্যগুলো দেখানো হবে, যা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh