নির্বাচনমুখী প্রশাসন

শাহরিয়ার হোসাইন

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩৩ এএম

 নির্বাচন কমিশনের লোগো। ফাইল ছবি

নির্বাচন কমিশনের লোগো। ফাইল ছবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আরও এক বছরের কিছু বেশি সময় বাকি আছে। ইতোমধ্যে এক সচিব ও পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে প্রশাসনে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এর মাধ্যমে মূলত প্রশাসন নির্বাচনমুখী করার কাজ শুরু হলো।

এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে ‘বিশ্বস্ততার’ কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ প্রশাসনের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানোর প্রক্রিয়াও চলমান। একই সঙ্গে আসছে কয়েক স্তরে পদোন্নতি। আর কিছুদিনের মধ্যে মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় রদবদল আসছে বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই নির্বাচনমুখী প্রশাসন সাজাতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে সরকার।

রদবদল শুরু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে

ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রদবদল শুরু হয়েছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদেও পরিবর্তন আসছে বলে জানা গেছে। কারণ এ দুটি পদে থাকা দুই কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদ ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে।

গত ২৭ অক্টোবর পদোন্নতি দিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। 

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা নতুন তথ্য ও সম্প্রচার সচিব পদে নিয়োগ পান। অন্যদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির খন্দকার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফরিদ আহাম্মদ পদোন্নতি পেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। কিন্তু ১ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খন্দকারকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে না পাঠিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। জাকিয়া সুলতানার গত ২৭ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদলির প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। 

গত ৩১ অক্টোবর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. কামাল হোসেনকে সিনিয়র সচিব করে স্থানীয় সরকার বিভাগে বদলি করা হয়েছিল। ১ নভেম্বর সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে কামাল হোসেনকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।

অন্যদিকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের (পিপিপি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইবরাহিমকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব পদে বদলির আদেশাধীন বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. মুশফিকুর রহমানকে পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

২৭ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীকে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর পর তাকে ৩১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তির মেয়াদ আগামী ১৫ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর।

পদোন্নতি

নির্বাচন সামনে রেখে মোটামুটি তিন স্তরে পদোন্নতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব। প্রথমে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তবে এবার অধিকতর সতর্কতার সাথে পদোন্নতির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। মূলত ২৮তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ২৫৯ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। উপসচিবের পদোন্নতির পর এখন যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির চূড়ান্ত সুপারিশের সারসংক্ষেপও পাঠানো হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন সূত্র জানায়। এবার যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য ২১তম ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে।

পদোন্নতি দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে কয়েকটি বৈঠক করে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। বৈঠকে প্রত্যেকের কর্মজীবনের সমস্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করা হয়। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় নম্বর, চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা, দুর্নীতির বিষয়সহ সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনায় এসেছে। পদোন্নতি কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট ব্যাচ কর্মকর্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী তারা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। অন্য দিকে যেসব কর্মকর্তা মেধাবী; কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে শক্তিশালী নন, তারা দুশ্চিন্তায় আছেন। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী এসএসবি সদস্যদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের দিয়ে তদবির করাচ্ছেন।

অন্যদিকে মাঠ প্রশাসন থেকে ডিসি, ইউএনও পদেও পরিবর্তন আনা হবে। ইতোমধ্যে আদর্শগত দিক বিবেচনায় বেশকিছু ডিসি ও ইউএনওর বিষয়ে বিতর্ক উঠেছে প্রশাসনের অন্দরে। বলা হচ্ছে- ডিসি, ইউএনও পর্যায়ে এমনকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োজিতদের অনেকের ক্ষেত্রেই আদর্শগত দিক নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জনপ্রশাসন সূত্র বলছে, চলতি মাস থেকে একজন একজন করে সকলের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে কার্যক্রম শুরু হবে।

ডিসি পদে রদবদল আসছে

মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে ডিসি। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার মূল কাজটিই করে থাকে জেলা প্রশাসন। তাই মোটামুটি ২০ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।

গত ১৯ মে চাঁদপুর, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরে নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, পিরোজপুর, রাজবাড়ী, নোয়াখালী, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিলেট, ঝিনাইদহ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ- এ ১৩ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। পরে ১২ জানুয়ারি নীলফামারীর ডিসি পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাফিসা আরেফিনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। কারণ নাফিসার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

তবে এবার ডিসি পদে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। ইতোমধ্যে ডিসি পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য ফিটলিস্ট করতে কয়েক দফা সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই হয়েছে নানাভাবে। জেলা প্রশাসক উপসচিব পদ মর্যাদার কর্মকর্তা হয়ে থাকেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসক পদটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।

সরানো হচ্ছে সন্দেহভাজনদের

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবের পর পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরখানেক আগে অবসরে পাঠানোর এ ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। সরকারের ওপর যাদের আস্থা নেই কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে যারা ঝুঁকছেন, তাদের প্রতি এটা সরকারের কঠোর বার্তা।

চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে গত ১৬ অক্টোবর অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। স্বাভাবিকভাবে আগামী বছরের (২০২৩ সাল) ২৫ অক্টোবর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল মকবুল হোসেনের। এর পর ১৮ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। তাদের অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। ওইদিন সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. আলমগীর ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মাহবুব হাকিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তাদের সবাইকেই ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী অবসর দেয়া হয়েছে। ভোটের এক বছর আগে এভাবে কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কারণ কী- জানতে চাইলে সাবেক সচিব বদিউর রহমান বলেন, ‘অনেক দিন বন্ধ ছিল, শেষ মুহূর্তে আসবে না কেন? জনতার মঞ্চ কখন হয়েছিলো? বিএনপি যাদের আওয়ামীমনা বলে চাকরিচ্যুত করেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাদের আবার সচিব বানিয়েছে। রাজনৈতিক দল যদি সিভিল সার্ভিসকে নিরপেক্ষ না রাখে তা হলে এগুলো ঘটবেই।’

বদিউর রহমান আরও বলেন, ‘সরকার হয়তো এর মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের দুষ্ট মানুষদের বার্তা দিচ্ছে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh