খেলাপি ঋণ যেন পাগলা ঘোড়া

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ০৯:০৬ এএম

 ব্যাংকের সর্বস্তরে মারাত্মক প্রভাব ছড়িয়ে দেয় এই খেলাপি ঋণ। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংকের সর্বস্তরে মারাত্মক প্রভাব ছড়িয়ে দেয় এই খেলাপি ঋণ। ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে অহরহ। খাতা-কলমে কম দেখানোর জন্য নীতিগত ছাড়-সুবিধা কয়েক বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। তবু পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে খেলাপি ঋণ। সর্বশেষ তিন মাসেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথভাবে ঋণ বিতরণ না করায় তা আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেথ খাতা-কলমে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এই পরিমাণ আরও অনেক বেশি। ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এখনই আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি  হয়ে গেছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। চলতি বছরে জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ব্যাংক খাতে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। গত বছর সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিয়মনীতি সঠিকভাবে পরিপালন না করে ভুল জায়গায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এজন্য ওই ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ প্রয়োগে নতুন আইন বা সংস্কার করার চেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ। বিদ্যমান আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। 

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করে তা ব্যাংকের তিন ধরনের শ্রেণিকৃত ঋণ। নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দঋণ; এর মধ্যে শেষের শ্রেণির ঋণ আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ। এর বাইরে অবলোপন ও আদালতের স্থগিতাদেশের ঋণ রয়েছে সেগুলোও খেলাপি। এর বাইরে আরও প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, যা দেখানো হচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হয়ে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে আন্তরিকতার প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছে। এজন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে ও ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি সরকারি ব্যাংকগুলোতে। বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের ২ হাজার ৯৭০ কোটি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ৭৭। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ খেলাপি।

ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। এর পর থেকে প্রতিবছরই বিভিন্ন নামে, নানা ঢঙে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে ঋণের টাকা আদায় না হলেও খাতাকলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পেরেছে ব্যাংকগুলো।

সর্বশেষ করোনা ভাইরাস মহামারিসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে নানান ছাড় দেয়। এতে এক বছর পর ২০২০ সাল শেষে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ওই বছরে মহামারির কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি বকেয়া হলেও খেলাপি না দেখানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংক্রমণ পরিস্থিতি কমে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে থাকলে এর পর সুবিধা ধীরে ধীরে তুলে নিতে শুরু করলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের স্থিতি ফের লাখ কোটির ঘর পার করে হয় এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে চলতি বছরের প্রথম দিক থেকেই তা বাড়তে দেখা গেছে।

এর মধ্যে নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ১৮ জুলাই খেলাপি হওয়া ঋণের পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এখন থেকে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের নীতিমালা করবে। এ সার্কুলারের ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে বড় ছাড়ও দেওয়া হয়। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপির পরিমাণ কাগজ-কলমে আরও কমে আসবে বলে মনে করেছিলেন বিশ্লেষকরা; তবে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তা হয়নি।

খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে ক্যানসারের মতো নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। ব্যাংকের সর্বস্তরে মারাত্মক প্রভাব ছড়িয়ে দেয় এই খেলাপি ঋণ। যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ হয়, ব্যাংকের ওই পরিমাণ টাকা আটকে  যায়, খেলাপি ঋণ থেকে ব্যাংক কোনো সুদ আয় দেখাতে পারে না।

ফলে একদিকে ঋণ প্রদানযোগ্য অর্থ কমে যায় আবার নিয়মিত আয়ও কমে যায়। ঋণখেলাপি হয়ে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে এই প্রভিশন করা বাধ্যতামূলক। এতে ব্যাংকের মুনাফা খেয়ে ফেলে খেলাপি ঋণ।

এদিকে ঋণের টাকা আটকে গেলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হয়। ফলে ব্যাংকে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়। খেলাপি ঋণ আদায়, মনিটরিং ও আইনগত পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ব্যাংকের ব্যয় বেড়ে যায়। সবদিক থেকে  ব্যাংকের খরচ বাড়িয়ে দেয় খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেশি হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হয়। ওই ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংক ব্যবসা করতে চায় না। এতে ব্যাংকের ব্যবসা খারাপ হয়ে যায়।  

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার যে চেষ্টা করছে সেই পথেও খেলাপি ঋণ প্রতিবন্ধকতা। আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত জুড়ে দিচ্ছে এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh