আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩৭ এএম
ইউক্রেন এই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। প্রতীকী ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি গত ১৭ নভেম্বর বলেছেন, ইউক্রেন এই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। আর এই অবস্থাতেই তারা যদি আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে রাশিয়া হয়তো কোনো একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগুতেও পারে। জেনারেল মিলির এমন মন্তব্য ওয়াশিংটনের ইউক্রেন নীতিতে নতুন সুর যোগ করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
জেনারেল মিলি বলেন, রাশিয়া প্রায় এক লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি সেনা নিয়ে ইউক্রেনে হামলা করে এবং তারা বহু হতাহতের শিকার হয়েছে। তার পরও যে বাহিনী তারা ইউক্রেনে রেখেছে, তা বেশ শক্তিশালী। আর এর সঙ্গে নতুন করে মোবিলাইজ করা সেনারা যুক্ত হচ্ছে। ইউক্রেনীয়রা রুশদের আক্রমণ সফলভাবে ঠেকাতে পেরেছে এবং এর পর তারা আক্রমণে গিয়ে খারকিভ ও খেরসনের বেশকিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে। তবে এই পুনরুদ্ধার করা ভূমি রুশদের দখলীকৃত ভূমির খুব বড় কোনো অংশ নয়। রুশদের সামরিকভাবে ইউক্রেনের দখলীকৃত ভূমি থেকে উৎখাত করাটা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। তবে রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত রুশ সামরিক বাহিনী যতটা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তাতে তারা আলোচনার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগোলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এক সপ্তাহ আগেও জেনারেল মিলি বলেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেলে ইউক্রেনীয়দের তা হাতছাড়া করা উচিত হবে না। অপরদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলছেন, ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে। শান্তিচুক্তির জন্য টেবিলে বসা হবে কিনা, সেটা ইউক্রেনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোনো প্রভাব রাখবে না। জেনারেল মিলি ও সুলিভানের এমন বক্তব্যে ইউক্রেনে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে- তারা কার কথা শুনবে? প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনা দেখিয়ে দেয়, ওয়াশিংটন প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও বড় কোনো যুদ্ধের দিকে নিতে ইচ্ছুক নয়। অপরদিকে ইউক্রেন থেকে প্রতিবেশী ন্যাটো দেশ পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পৌঁছায় তখন তিনি ‘জি-২০’ শীর্ষ বৈঠকের জন্য ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থান করছিলেন।
খবরটা দিতে ভোরে প্রেসিডেন্টকে ডেকে তোলা হয় এবং তিনি তার কর্মকর্তাদের ছাড়াও পোলিশ প্রেসিডেন্ট ও ইউক্রেনের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে তাদের শান্ত থাকার উপদেশ দেন।
ডিফেন্স নিউজের এক খবরে বলা হচ্ছে, ন্যাটো সদস্য দেশ হিসেবে পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা যদি রুশদের হামলা হিসেবে প্রমাণ হয়, তা হলে প্রশ্ন আসবে- জোটের ‘আর্টিকেল-৫’ অনুসারে ন্যাটোভুক্ত বাকি দেশগুলো পোল্যান্ডকে সামরিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবে কিনা। এই আর্টিকেল অনুসারে জোটের একটা দেশের ওপরে হামলা হলে বাকিরাও তাদের ওপর হামলা হয়েছে বলে ধরে নেবে। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাঝেই ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেন, এটা খুব সম্ভবত ইউক্রেনীয় বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যা রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ঘায়েল করতে গিয়ে টার্গেট মিস করে পোল্যান্ডে আছড়ে পড়ে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও বলা হয়, পোল্যান্ডের ওপর রুশ সামরিক হামলার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া ফোর্সেস নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা বেলিংক্যাটের লেখক ব্রিটিশ সাংবাদিক এলিয়ট হিগিন্স বলেন, ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়া গেছে তা হলো- এটা ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, যা এই মুহূর্তে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই ব্যবহার করছে। তবে প্রমাণাদি দেখে মনে হচ্ছে, মিডিয়াতে প্রচারিত খবরটা সত্য নয়। অর্থাৎ এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়া ছোঁড়েনি। লন্ডনের কিংস কলেজের প্রফেসর মাইকেল ক্লার্ক বলেন, ইউক্রেনের চারদিকে ন্যাটোর গোয়েন্দা বিমানগুলো দিনরাত উড়ছে। কাজেই ইউক্রেনের আকাশে কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র উড়ছে, তা ন্যাটোর অজানা থাকার কথা নয়।
পোল্যান্ডের ঘটনাটা দেখিয়ে দেয়, যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে মোটেই আগ্রহী নয়। পশ্চিমাদের সামরিক সক্ষমতাও প্রশ্নাতীত নয়। ফিন্যানশিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা শিল্পের কাছ থেকে সময়মতো খুচরা যন্ত্রাংশ পাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্ত্রের অর্ডার বেড়েছে; কিন্তু সরবরাহ সমস্যা ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে। অপরদিকে সুলিভান ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখার কথা বললেও ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় যাওয়ার ব্যাপারে জেনারেল মিলির বক্তব্যকে বাতিল করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি শান্তি আলোচনার ব্যাপারটা একপ্রকার এড়িয়েই গেছেন; কিন্তু বাস্তবতা হলো- ইউক্রেন এই মুহূর্তে পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন সামরিক সহায়তার ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। অর্থাৎ ইউক্রেনের যুদ্ধ চালিয়ে নিতে পারার সক্ষমতা পশ্চিমা সহায়তার ওপরই নির্ভর করবে। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে চীনের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টায় রয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘জি-২০’ বৈঠক থেকে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একমত হয়েছে এবং দুই দেশ এ ব্যাপারে যোগাযোগ রেখে চলবে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলিভানকে আলোচনা এগিয়ে নিতে বেইজিং যেতে বলেছেন।
বাইডেনের বক্তব্য- যুদ্ধের কারণে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপারে মার্কিন জনগণের মতামতকেই প্রতিফলিত করছে। তদুপরি মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর কংগ্রেসে বিরোধী রিপাবলিকান শিবিরের শক্তিশালী অবস্থান হোয়াইট হাউসকে চাপে রাখবে।