কাতার বিশ্বকাপে চাপা পড়া শ্রমিকদের কান্না

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২২, ০৩:৩৫ পিএম

বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নতুন করে আটটি স্টেডিয়াম তৈরি করে কাতার। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নতুন করে আটটি স্টেডিয়াম তৈরি করে কাতার। ছবি: সংগৃহীত

আলোর রোশনাই আর ঝলকানিতে মিশে থাকবে হাজারো লাশের আর্তনাদ! বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে অবকাঠামো তৈরি করতে গিয়ে নির্যাতিত আর নিহত হওয়া শ্রমিকদের নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত প্রতিবাদমুখর থাকলেও আশার আলো পাওয়া যায়নি। বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফাও কাতারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। চাপা পড়া শ্রমিকদের কান্না শুনতে পারেনি ফিফা সভাপতি জিওভান্নি ইনফান্তিনোর দল।

কাতার বিশ্বকাপের দিনক্ষণ গণনার জন্য ১০০ দিন আগে রাজধানী দোহার আল কর্নিশে বসানো হয়েছে কাউন্টডাউন ঘড়ি। আসরের লোগোর স্ক্রিনের মধ্যে বসানো এই ঘড়িতে মাস, দিন, ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। তবে বিশ্বকাপটি কাতার আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বিতর্ক লেপ্টে আছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ধনী এই রাষ্ট্রের অভিযোগ- পশ্চিমারাই এই বিতর্ক উসকে দিয়েছে। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবেই ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর প্রথমবারের মতো আয়োজনের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কাতার। বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য পুরোপুরি নতুন করে আটটি স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেয় কাতার। এই স্টেডিয়ামগুলো নির্মাণে প্রচুর শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছিল দেশটি। তবে প্রশ্ন উঠেছে- এই শ্রমিকদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, কত ঘণ্টা ডিউটি করানো হচ্ছে আর ওভারটাইমের মজুরি ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কিনা। এ ছাড়াও আসরটি নিয়ে সমকামী সমর্থকদের স্বাগতম জানানো হবে কিনা, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে চলেছে নানা কথা। 

কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে যে ৮টি স্টেডিয়াম, নতুন বিমানবন্দর, মেট্রো ও রাস্তাসহ আরও অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেছে কাতার। যেখানে নিউ সিটির মাঝখানেই আসরের ফাইনাল ম্যাচের স্টেডিয়াম, এই ভেন্যুতে আরও ৯টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। মহাযজ্ঞের এই প্রকল্পগুলোতে ৩০ হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করেছে; কিন্তু অভিযোগ আছে কর্তৃপক্ষ তাদের দেখভালে ঠিকভাবে নজর দিচ্ছে না। 

২০১৬ সালেই অবশ্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, কাতার জোর করে শ্রমিকদের থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছে, তাদের বাসস্থানগুলো বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। এতে আরও বলা হয়, এখানে কাজের জন্য শ্রমিকরা বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছেন, তাদের মজুরি আটকে রাখার পাশাপাশি পাসপোর্টও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যদিও ২০১৭ সালে কাতার সরকার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়- অভিবাসী শ্রমিকদের অত্যধিক গরমে কাজ করা থেকে রক্ষা করতে, তাদের কাজের সময় সীমিত করতে এবং শ্রমিকদের ক্যাম্পের অবস্থার উন্নতির জন্য ব্যবস্থা করেছে। এর পর ২০২১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, শ্রমিকরা এখনো বিভিন্ন ঝামেলার মধ্যে রয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম অনৈতিকভাবে মজুরি কর্তন ও দীর্ঘ সময় কঠোর কাজের জন্য মাসিক অবৈতনিক কাজ করতে বাধ্য করা। 

আবার নিজেদের অবস্থান জানাতে গিয়ে অ্যামিনেস্টি ইন্টিারন্যাশনাল জানায়, ‘কাফালা বা স্পনসরশিপ বিলুপ্তির পরও অভিবাসী শ্রমিকদের তাদের নিয়োাগকর্তার সম্মতি ছাড়া চাকরি ছেড়ে দিতে বাধা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কর্মীদের ওপর বিভিন্ন রকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ান তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার ৬ হাজার ৫০০ অভিবাসী শ্রমিক বিভিন্ন সময় মারা গেছে। যদিও এই রিপোর্টে বলা হয়নি কোন কাজ করতে গিয়ে এদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তবে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা গ্রুপ ফেয়ার স্কয়ার জানিয়েছে, বিশ্বকাপের অবকাঠামো প্রকল্প তৈরি করতে গিয়েই এদের বেশিরভাগ মারা যায়। কাতার সরকার অবশ্য বলেছে, এই অংকটা বাড়িয়ে বা অনুমান করে বলা হয়েছে। কেননা অনেক শ্রমিকই বহু বছর এখানে থাকার পর মারা গেছে ও নির্মাণকাজের বাইরে আছে এমন অনেকের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম তৈরির শ্রমিকের মধ্যে ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়। এদের ৩৪ জনই আবার কাজের বাইরে থাকা অবস্থায় মারা যান বলে জানিয়েছেন। 

কাতারের এই বক্তব্যের বিপরীতে আবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (আইএলও)। তারা জানায়, শ্রমিকদের হঠাৎ বা অপ্রত্যাশিত মৃত্যুগুলোকে কাতার হিসাবের মধ্যেই আনেনি। এমনকি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাগুলো দেশটি ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। আইএলও জানায়, ২০২১ সালেই কাতারে ৫০ জন শ্রমিক মারা গেছে এবং ৫০০ জনের বেশি গুরুতর আহত হয় স্টেডিয়াম ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ করতে গিয়ে। এ ছাড়া আরও ৩৭ হাজার ৬০০ জন হালকা থেকে মাঝারি আঘাত পেয়েছে, যারা আগের মতো কাজ করতে পারছে না। এসব মৃত্যু ও আঘাতের প্রধান কারণ ছিল ওপর থেকে পড়ে যাওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা এবং ওপর থেকে পড়া বস্তুর আঘাত। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh