ব্যাংক কি সত্যিই দেউলিয়া হবে?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৩০ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১১:৩২ এএম

এ মুহূর্তে ব্যাংকের তারল্যের পরিমাণ ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ছবি: সংগৃহীত

এ মুহূর্তে ব্যাংকের তারল্যের পরিমাণ ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি এক বন্ধু কয়েকটা ব্যাংকের নাম লিখে এসএমএস করে জানতে চেয়েছে- এগুলো দেউলিয়া হবে কি না? কারণ এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তার ব্যবসা সম্পর্কিত নানা লেনদেন আছে। সঙ্গত কারণে অনেক টাকাও জমা আছে। ফলে সে খুবই আতঙ্কিত। তাকে বললাম- ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না; কিন্তু সে আমার কথায় আশ্বস্ত হয়েছে মনে হলো না।

আমার ধারণা, এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেই সম্প্রতি কয়েকটি কমন প্রশ্ন শুনেছেন, যেমন-

১. ব্যাংকগুলো কি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে?

২. ব্যাংক থেকে কি টাকা তুলে ফেলব?

৩. টাকা তুলে কোথায় বিনিয়োগ করব, স্বর্ণে না জমিতে?

৪. জিনিসপত্রের দাম কি আরও বাড়বে? সেক্ষেত্রে কি কিছু নগদ টাকা বাসায় এনে রাখব? 

৫. দেশে কি সত্যিই দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে?

৬. দেশে আসলে কী হচ্ছে? 

৭. আওয়ামী লীগ কি আবার ক্ষমতায় আসবে? বিএনপি নির্বাচনের এত আগে মাঠে নামল কেন? এই স্ট্যামিনা তারা ধরে রাখতে পারবে? নাকি তারা সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিলো?

৮. সরকারবিরোধী দলগুলো যা চায়, সরকার বা সরকারি দল যদি তাতে সম্মত না হয়, তখন কি রাজনীতি সংঘাতের দিকে যাবে? তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কি আরও খারাপ হবে?

এখান থেকে রাজনৈতিক সংশয়গুলো বাদ দিলে বাজার ও অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের মনে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তার কারণ কী? এই অনাস্থা ও অবিশ্বাস দূর করার উপায় কী? মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে? সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দলের নেতা, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম নাকি সোশ্যাল মিডিয়া? 

অস্বীকার করার উপায় নেই, এখন যে কোনো বিষয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়ানোর কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসুবক। কেউ একজন কোথাও থেকে কিছু একটা শুনে ফেসবুকে লিখে দেন, দেখা যায় অসংখ্য মানুষ কোনো ধরনের ক্রসচেক বা বাছবিচার না করেই সেটা বিশ্বাস করেন। এভাবে কোনো একটি মিথ্যা, গুজব বা অর্ধসত্য মুহূর্তের মধ্যেই জনপরিসরে ছড়িয়ে যায়। 

হাল আমলে যোগ হয়েছে একশ্রেণির আতঙ্কবাদী ইউটিউবার, যারা দেশের পরিস্থিতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে প্রচার করেন যে, মনে হবে দুই-তিনদিনের মধ্যে সব ব্যাংকের টাকা ফুরিয়ে যাবে; মানুষ ব্যাংকে গিয়ে নিজের টাকাও তুলতে পারবে না; বিনিয়োগকারী সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাবেন ইত্যাদি।

এসব প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পেছনে মানুষকে তথ্য দেওয়া বা দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা নয়, বরং অর্ধ সত্য বা অসম্পূর্ণ বিষয়কে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে মানুষ ব্যাংকে গিয়ে নিজেদের জমানো এমনকি সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগও তুলে ফেলে। আর যখন একসঙ্গে সবাই ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে ফেলবে, তখন তো ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবেই।

আর এরকম একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির মধ্য দিয়ে ওই আতঙ্কবাদী ইউটিউবারদের মূল উদ্দেশ্য সরকারের পতন ঘটানো। তার মানে উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক। তারা একটি বিশেষ দলের কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। 

মুশকিল হলো- মানুষ সবচেয়ে বেশি ভরসা করতে চায় যে গণমাধ্যমের ওপর, হাতেগোনা যে কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল এখনো নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে বলে মানুষ বিশ্বাস করে, তারাও এই ইস্যুতে, বিশেষ করে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে কিনা- এ বিষয়ে খুব নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশ করছে না।

কারণ যেসব গণমাধ্যমের খবর ও বিশ্লেষণ মানুষ বিশ্বাস করে, তাদের অনেকেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে সরকার ও সরকারি দলের প্রতি  তাদের ক্ষোভ আছে। এখন অর্থনৈতিক সংকটের ইস্যুটা ধরে তারা একধরনের প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব থেকে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে কিনা, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে গণমাধ্যম যা প্রকাশ ও প্রচার করছে, পরিস্থিতি আসলেই সেরকম কিনা, সে প্রশ্নটিও জনমনে আছে। 

রাষ্ট্রের এই সংকটকালে সবচেয়ে জরুরি সরকার ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে কোনো কিছু গোপন না করে বিশ্বাসযোগ্য কথাগুলো বলা, যা মানুষকে আশ্বস্ত করবে, সতর্ক করবে এবং সত্যি সত্যিই কোন কোন জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেবে; কিন্তু মুশকিল হলো- সরকার নিজের দোষ-ত্রুটি ঢাকতে গিয়ে সঠিক কথাটা বলে না। আবার গণমাধ্যমও অনেক সময় নিজের (মূলত মালিকের) ধান্দা অনুযায়ী সংবাদ পরিবেশন করে। 

ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রশ্নটিই ধরা যাক। অসংখ্য মানুষের মনে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকে যাদের বিনিয়োগ আছে; কিন্তু এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেটিও বা মানুষকে কতটা ভরসা দিতে পেরেছে? বাংলাদেশ ব্যাংক যে তারল্যের হিসাব দিয়েছে, মানুষ কি তাতে আশ্বস্ত হতে পারছে? অনেক ব্যাংক-লিজিং কোম্পানি এর আগে দেউলিয়া হয়েছে।

অসংখ্য মানুষ তাদের আমানত খুইয়েছে। গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের লোকজন তসরুপ করে বিদেশে পাচার করেছে। ফলে যখনই গণমাধ্যমে এ রকম খবর প্রকাশ হয় যে, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা করুণ, তখন মানুষ ভয় পায় এবং অতীতের ওইসব ঘটনা স্মরণ করে নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত হয়, উদ্বিগ্ন হয়।

শিক্ষিত ও সচেতন মানুষেরাও ব্যাংক থেকে নিজেদের জমানো টাকা তুলে ফেলার উদ্যোগ নেন; কিন্তু শুধু একটি বিজ্ঞপ্তি যে মানুষকে খুব বেশি ভরসা দিতে পারেনি, সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে স্পষ্ট হয়। মানুষ যাদের কথা বিশ্বাস করে বা আস্থা রাখতে চায়, নানা ঘটনায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে। ফলে তারা এখন সঠিক ও সত্য কথা বললেও মানুষ চট করে সেটা বিশ্বাস করতে চায় না। চায় না বলেই মিথ্যা, অর্ধসত্য ও গুজবও তারা বিশ্বাস করে। 

রাষ্ট্রীয় কিছু নীতিও অর্থনীতির এই সংকট বাড়িয়ে দেয়। যেমন- সরকার বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে নানারকম সুবিধা দেওয়ার কথা বললেও এখনো হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে লাভ বেশি। উপরন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানোর চেয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোকে নিরাপদ মনে করা হয়।

অথচ প্রক্রিয়াটি অবৈধ। মানুষ কেন একটি বৈধ চ্যানেল বাইপাস করে অবৈধ পথে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা দেশে পাঠায়, তার কারণ অনুসন্ধানও জরুরি। যদিও সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেনের অভিযোগে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) ২৩০টি অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। (ডেইলি স্টার, ১৭ নভেম্বর ২০২২)

বাস্তবতা হলো- যারা দেশের বাইরে থাকেন, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তুলনামূলক বেশি। তারা সোশ্যাল মিডিয়ার নানা প্রচারকে বিশ্বাস করেন এবং দেশের আত্মীয়-স্বজনকে ফোন করে নিজেদের ভয়ের কথা জানান; কিন্তু যাদের সঙ্গে কথা বলেন, তারাও যে সঠিকভাবে পরিস্থিতি বুঝাতে পারেন, তা-ও নয়। মূলত এভাবেই ভয় ও আতঙ্ক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

এ মুহূর্তে মূল আলোচনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টি নিয়ে। কেন ব্যাংক দেউলিয়া হয়? যখন গ্রাহককে দেওয়ার মতো টাকা ব্যাংকে থাকে না বা তারল্য থাকে না। অর্থাৎ আমানতকারীকে চাহিবামাত্র তার টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের নামই হচ্ছে ‘ব্যাংকের তারল্য’। এ মুহূর্তে তারল্যের পরিমাণ ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ বিদ্যমান বাস্তবতায় আড়াই লাখ কোটি টাকা হলেও যথেষ্ট হতো। (প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর ২০২২)

তার মানে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংকের কাছে অনেক বেশি টাকা আছে যা গ্রাহকরা চাইলেই পাবেন। কিন্তু গ্রাহকরা এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ফেললে সেই টাকা তারা কোথায় রাখবেন? জমি কিনবেন? যারা জমি বিক্রি করবেন, টাকাটা তার কাছে যাবে। তিনিও বা ওই টাকা কোথায় রাখবেন? টাকা তো বালিশের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখার জিনিস না। তার মানে ঘুরেফিরে মানুষকে টাকা জমা রাখার জন্য ব্যাংকেই যেতে হবে। 

তা হলে মানুষের মনে এ নিয়ে সংশয় ও ভয় কেন? সিনিয়র ব্যাংকার ও লেখক মাসরুর আরেফিন বিদ্যমান পরিস্থিতির একটা ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন- আমাদের বর্তমান সংকট মূলত একটা স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার মাধ্যমে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত থাকা ঠিক আছে; কিন্তু সেই সুস্থ চিন্তার বদলে গুজবে ভর করে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো কারণ দেখি না।

তিনি আরও লিখেছেন- ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের যে বিশাল অর্থনীতি আমরা তৈরি করেছি, তা আপনি মনে করেন উধাও হয়ে যাবে? রেমিট্যান্স আয় কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে দেশের অন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে? ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে? মনে রাখবেন, নতুন লাখো রেমিট্যান্স যোদ্ধা পুরোদমে বিদেশে যাওয়া শুরু করেছেন। অতএব প্রবাসী আয় সামনের দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার ওপরে ভরসা রাখুন।

আর প্রবাসী আয় যখনই বাড়বে, ডলার সংকট তখনই শেষ। আবার অন্যদিকে সামনে রপ্তানিও বাড়বে, নিশ্চিত। (প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর ২০২২)

পরিশেষে যে কথাটি দেশের অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সহজ করে মানুষকে বোঝানোর দরকার ছিল, সেই কাজটি করলেন একজন ব্যাংকার। তা-ও ভালো; যেসব গণমাধ্যমের ওপর মানুষ বেশি ভরসা করে, সেরকম একটি সংবাদপত্রেই মাসরুর আরেফিন লিখেছেন।

যারা তার লেখাটি পড়েছেন, তাদের অনেকে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হয়েছেন; কিন্তু যাদের কথায় মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার কথা, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কেন নষ্ট হলো এবং কীভাবে সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যাবে- বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের কালে সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh