হুন্ডি গিলছে ডলার

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৫১ এএম

হুন্ডি কারবারিরা বিদেশ থেকেই বেশি দামে ডলার কিনে নিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

হুন্ডি কারবারিরা বিদেশ থেকেই বেশি দামে ডলার কিনে নিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহ ডলার সংকটে ভুগছে দেশ। সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, পণ্য আমদানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক যাচাই-বাছাই শেষে ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

ডলার সংকট তৈরির মূল কারণ দেশের ডলার আয় কমে গেছে অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে। ডলার আয় কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ অবৈধপথে বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন।

সেই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেল বা অন্য বৈধপথে এলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়; কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। হুন্ডি কারবারিরা বিদেশ থেকেই বেশি দামে ডলার কিনে নিচ্ছেন। প্রবাসীরা অনেকটা ঝামেলাবিহীনভাবে বিনাখরচে স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন।

এক্ষেত্রে হুন্ডি কারবারিদের অর্থ বিতরণ সহজ করে দিয়েছে মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ ও রকেট ব্যবহার করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। 

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, প্রতিবছরই বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ছে। অথচ সম্প্রতি রেমিটেন্স প্রবাহ কমছে। ৬২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন এবং ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭১৯ বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন। অথচ রেমিটেন্স প্রবাহ আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সর্বমোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার অনেক পুরনো একটি সমস্যা। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি হুন্ডিতে আসছে। সাধারণত দেশের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ কিংবা কর ফাঁকির অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর না হলে এ প্রবণতা কমানো যাবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে অনেক বেশি দর দেওয়া হচ্ছে। ফলে হুন্ডির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চ্যানেল পেরে উঠছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরেই থেকে যাওয়ায় দেশের মুদ্রাবাজারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

বেশ কিছুদিন ধরে দেশে ডলারের সংকট চলছে, যার অন্যতম কারণ রেমিটেন্স কমে যাওয়া। ব্যাংকের পাশাপাশিখোলাবাজারেও ডলারের দর অনেক বেড়ে গেছে। চলতি বছরের শুরুর দিকেও খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯০ টাকার আশপাশে ছিল। সম্প্রতি যা সর্বোচ্চ ১১৯ টাকায় উঠেছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনসহ বিভিন্ন উদ্যোগের পর দর এখন কিছুটা কমে ১০৬ থেকে ১১০ টাকায় নেমেছে। আবার আমদানি পর্যায়েও ৮৬ টাকায় থাকা ডলারের দর ১১২ টাকায় উঠেছিল। এখন যা কিছুটা কমে ১০৪ থেকে ১০৬ টাকায় নেমেছে।

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের দর এভাবে বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে। প্রবাসীরা হুন্ডিতে ঝুঁকছেন; এর অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে- ব্যাংকের তুলনায় তারা ডলার প্রতি ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেশি পাচ্ছেন, আরেকটি কারণ হচ্ছে এখানে তাদের কোনো চার্জ বা মাসুল দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শ্রম রপ্তানি বেশি হয়। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায় যান প্রবাসীরা। এসব প্রবাসীর কাছ থেকে অবৈধভাবে বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নামে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে একটি চক্র।

হুন্ডি চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশি এজেন্টের কাছে অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের সুবিধাভোগীর এমএফএস অ্যাকাউন্ট নম্বর ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে এসএমএস পাঠাচ্ছে। এখানকার এজেন্ট সুবিধাভোগীর নম্বরে ক্যাশ ইন করে দিচ্ছে। এতে প্রবাসীদের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না।

দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) সম্প্রতি হুন্ডি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থায় চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। এমএফএস প্ল্যাট

ফর্ম ব্যবহার করে ডিজিটাল হুন্ডি এবং অবৈধ গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোট্রেডিং বা অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং-সংক্রান্ত লেনদেন চিহ্নিত করতে মোট ৪ লাখ এমএফএস এজেন্টের তথ্য বিশ্নেষণ করেছে বিএফআইইউ। চারটি নির্দেশকের ভিত্তিতে গত এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ের লেনদেন বিশ্নেষণ করে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫০৫টি সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করা হয়। এসব নির্দেশকের একটি হলো- যেসব এজেন্ট নম্বরের মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে।

অন্য নির্দেশকের মধ্যে রয়েছে- মোট লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি, যেখান থেকে শুধু ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে, এক মিনিটে চারটি বা তার বেশি ‘ক্যাশ ইন’ এবং রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে ‘ক্যাশ ইন’। এভাবে বিকাশের ৬৯ হাজার ৬১৩টি, উপায়-এর ৩৮ হাজার ৮৩৫টি, রকেটের ৩৮ হাজার ৩৫৮টি এবং নগদের ৩৪ হাজার ৩৫৮ এজেন্টকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এর পর সংশ্নিষ্ট এমএফএস প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব এজেন্টের তথ্য দিয়ে অধিকতর বিশ্নেষণ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সে আলোকে ৫ হাজার ৮৯ জনের এজেন্টশিপ বাতিল করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত আরও ৩৩০টি এজেন্টের এজেন্টশিপও বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বাতিল হওয়া ৫ হাজার ৪১৯ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিআইডিতে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ডিজিটাল হুন্ডিতে অধিকতর সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত ৩৩০ এজেন্টের মধ্যে ১৩১টির মোট লেনদেনের ৯৯ দশমিক ৯৫ শতাংশই শুধু ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে, যেখানে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি টাকার বেশি। ৬১ এজেন্টের মোট লেনদেনের ৯৯ শতাংশ শুধু ‘ক্যাশ আউট’ হয়েছে, যেখানে মোট লেনদেনের পরিমাণ ৭০ লাখ টাকার বেশি।

৭৪টি হিসাব থেকে এক মিনিটে ৪ বা তার বেশিবার ‘ক্যাশ ইন’ হয়েছে। এসব এজেন্টের ক্ষেত্রে কমপক্ষে শতাধিকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। রাত ২টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে ২৫০টির বেশি ক্যাশ ইনের ঘটনা ঘটেছে ৬৪টি এজেন্ট নম্বর থেকে। হুন্ডি-চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এমএফএসের এজেন্টশিপ নিয়েছে।

তাদের কাছে বিদেশ থেকে শুধু টাকার পরিমাণ ও নম্বর উল্লেখ করে নির্দেশনা আসে। সে আলোকে সুবিধাভোগীর নম্বরে এখান থেকে অর্থ পরিশোধ করা হয়। দ্রুততম সময়ে সুবিধাভোগীর নম্বরে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ নেয় না হুন্ডি কারবারিরা। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে যেখানে গড়ে ৪ শতাংশের মতো খরচ হয়, অথচ ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে দর বেশি দেওয়া হয়।

হুন্ডি কারবারিদের আউটলেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার কাছে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাসা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। কখনো কখনো প্রবাসীর পক্ষে অগ্রিম অর্থ পাঠিয়ে দেয়। এ রকম নানা সুবিধার কারণে হুন্ডিতে ঝুঁকছেন অনেকে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদের বৈধ চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বিনিময়হার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডলারের বিনিময়হারের ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ চ্যানেলের মধ্যে ৬-৭ টাকার মতো পার্থক্য রয়েছে।

এই ব্যবধান ২-৩ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। এত বেশি ব্যবধান থাকায় অবৈধ চ্যানেলের ব্যবহার বাড়বে কিনা, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়। অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ঝুঁকি তুলে ধরে এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো ও জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh