বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনা ও অর্থনৈতিক সংকট

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:৫২ পিএম

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

২১ নভেম্বর ২০২২। সকালে বসে গত রাতে শুরু হওয়া ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ তথা বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে ফুটবল উন্মাদনা এবং ক্রম অগ্রসরায়মান অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে কলামটা যখন লিখছি, তখন মনে পড়লো মাসখানেক আগে টেলিভিশনে দেখা ধ্রুব ব্যানার্জি পরিচালিত এবং পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা দেব অভিনীত ‘গোলন্দাজ’ সিনেমাটির কথা।

ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনে জর্জরিত বাংলার জনগণের ইংরেজদের ওপর ক্ষোভ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পটভূমিতে অবিভক্ত বাংলার ফুটবলের উষালগ্নের ইতিহাস নিয়ে ছবিটি নির্মিত।

খেলা, বিশেষত ফুটবল নিয়ে উন্মাদনায় আমি আজও মজে থাকি। বাংলার ফুটবলের প্রবর্তক প্রবাদপ্রতীম পুরুষ নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর নামটা জানতাম; কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে পড়ে ফুটবলের ইতিহাসটা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না।

তাই ছবিটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখে গুগলে সার্চ দিয়ে বাংলায় ফুটবলের ইতিহাস নিয়ে সব কিছু পড়ে নিলাম। ১৩৬ বছর আগে ১৮৭৮ সালে জমিদার নন্দন নগেন্দ্র প্রসাদ যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন ফুটবলে মেতে ওঠেন।

ত্রিশ টাকা চাঁদা তুলে ইংরেজদের দোকান থেকে রাগবি বল কিনে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও হিন্দু স্কুলের ছাত্ররা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নিয়ম-কানুন ছাড়া এলোপাতাড়ি খেলা শুরু করলেন। পা-হাতের ব্যবহার একই সঙ্গে চললো। পথচলা কিছু লোকও জুটে গেল ওই অদ্ভুত খেলা দেখতে।

আমাদের সেই পূর্বপুরুষরাই ফুটবল উন্মাদনার জনক। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক বি ভি স্ট্যাক বাঙালি বালকদের খেলা দেখে হেসেই খুন। তিনিই ছাত্রদের ফুটবল আর রাগবীর পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন ফুটবল নিয়ে এলেন। বাঁশি হাতে রেফারির কাজ করলেন। সেদিন আরও বেশি মানুষ খেলা দেখতে জুটেছিল। তাই বলা যেতে পারে, বাংলায় নগেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন ফুটবল খেলার উদ্ভাবক, ধাত্রী ছিলেন স্ট্যাক সাহেব আর উন্মাদক ছিলেন নাম না জানা সেই পথযাত্রীরা।

১৯৭৮ থেকে ১৮৯৪। ষোলো বছর চেষ্টা। নগেন্দ্র প্রসাদ বাঁধা-বিঘ্ন জয় করে ১৮৮৪ সালে গড়ে তোলেন ওয়েলিংটন ক্লাব। পরের বছর টাউন ক্লাব। পরে শোভাবাজার ক্লাব। ব্রিটিশ-ভারত উন্মুক্ত ফুটবল প্রতিযোগিতায় ইংরেজদের সঙ্গে পর পর ৩ বছর পরাজয়, পরে জয়।

১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলো ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তার পর ভারতীয় দলগুলোর পরাজয় আর পরাজয়। ৪১ বছর পর শিবদাস ভাদুরীর নেতৃত্বে কলকাতা মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জিতে নিল। বিস্মিত ও গর্বিত হতে হয় এজন্য যে, ১১ জন বাঙালি খেলোয়াড়ের মধ্যে ১০ জনই ছিল পূর্ববাংলার।

বাংলার ফুটবল প্রথম থেকেই যুক্ত হয়ে যায় রাজনীতি তথা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা শুরু হওয়ার দিনগুলোতে জন্ম নেয় ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পর্যায়ক্রমে মোহনবাগানের সঙ্গে আরও দুটি উচ্চমানের দল যুক্ত হয়।

১৯৮১ সালে মোহামেডান এবং ১৯২০ সালে ইস্ট বেঙ্গল। বাংলার তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে এ দুটি ক্লাবের জন্মের সম্পর্ক বিষয়টি গভীর অনুসন্ধিৎসার বিষয়। তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছিলেন মোহামেডানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আর ঘটি-বাঙাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা যুক্ত হয় মোহনবাগান আর ইস্ট বেঙ্গলের মধ্যে।

তবে বাংলার রাজনীতি বিদ্বেষ ও হানাহানির দিকে ধাবিত হলো; কিন্তু ফুটবলে তেমন হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ঐক্যই যে ফুটবলের প্রাণ। মোহনবাগান যখন ইংরেজদের ক্লাবকে পরাজিত করে আইএফএ শিল্ড জেতে, তখন মোহামেডান ক্লাবের সদস্য-সমর্থকরা ‘তাদের হিন্দু ভাইদের জয়ে আনন্দ-উত্তেজনায় প্রায় পাগল এবং মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল।’ এখানেই বাংলার ফুটবলের সঙ্গে বাংলার রাজনীতির পার্থক্য; ফুটবলের সৌন্দর্য ও স্বার্থকতা।

বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ফুটবলের এই মহান ধারা প্রবহমান। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল- সবাই ফুটবল নিয়ে লিখেছেন। কবিগুরু যখন কোনো এক শক্ত-সামর্থ্য যুবকের কথা ভাবেন তখন বাসে মেয়েদের উত্যক্তকারীকে শায়েস্তা করে ফুটবল বীরের কথা ভেবে লেখেন- ‘মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।/হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কটমট করে-/ আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।/বোধ হয় আমাকে চেনে।/ আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,/বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।’

আর বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ফুটবল আর রাজনীতিকে এক সঙ্গেই টেনে আনেন। বিভক্ত ও নির্লিপ্ত স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে লেখেন- “জোর জমিয়েছে খেলা।/ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকাল বেলা।/... ময়দানে জোর ভিড় জমিয়েছে বড় ছোট মাঝারি,/স্বদেশি বিদেশি লোভী নির্লোভ হেটো, মেঠো বাজারী।/এই দিকে ‘রাজি’, ওদিকে ‘নারাজি’ দল/সেন্টারে পড়ে আছে ‘ভারতের স্বাধীনতা’ ফুটবল।” স্বাধীনতার জন্য দল-মত নির্বিশেষে ঐক্য নিয়ে কবির ব্যাকুলতা ফুটবল দিয়ে প্রকাশ করেছেন, বিশেষত বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা ছিল বলেই।

‘ধান ভানতে শিবের গীত’-এর মতো ১৯৩৭ সালের আজকের দিনটির কথা স্মরণ করে ফুটবলের ইতিহাস নিয়ে আকাশ-পাতাল নানা কথা বলে ফেললাম। ওই বছর ইংল্যান্ডের নামি-দামি ফুটবল ক্লাব এসেছে ঢাকায় খেলতে। দূরপ্রাচ্য-বার্মা-কলকাতায় যেসব দলের সঙ্গে খেলেছে সব দল হেরেছে, কেবল কলকাতা মোহামেডান ছাড়া। খেলাটি ড্র হয়েছিল। ঢাকা স্পোর্টিং ইউনিয়নের (ডিএসএ) সঙ্গে ওইদিন বিকেলে খেলা। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র মন্টু (পাখি) সেন পাখির মতো বল নিয়ে দৌড়ে গিয়ে গোল করে দলকে বিজয়ী করলেন। কয়েক হাজার দর্শকের সে কি উল্লাস! ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয় মানে স্বাধীনতা আন্দোলনের জয়!

খেলা শেষে পরাজিত দলের অধিনায়ক পি বি ক্লার্ক জয়ী দলকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছিলাম। এবার চোখে দেখলাম।’ সেই দিনও সেই অযোধ্যাও নেই। ২১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবল এখন ১৯২তম। বিশ্ব নয়, ফুটবলে সার্ক বিজয় আমাদের লক্ষ্য। মহিলা দল সার্ক চ্যাম্পিয়ান হলেও ফুটবল তেমন এগোচ্ছে না। এগেুাচ্ছে ক্রিকেট। তবে ফুটবলপ্রেমীরা আছে দেশ নয়, বিদেশের ফুটবল নিয়ে উন্মাদনায় মেতে।

পাগলামি-আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস সব ফুটবল নিয়ে। যদি তা না হতো, তবে জমি বিক্রি করে ৫ কিমি দীর্ঘ পতাকা কিংবা ৫ গ্রাম মিলে ৩১ লাখ টাকা খরচ করে পতাকা বানানো প্রভৃতি হতো না। অর্থকষ্ট ধেয়ে আসছে- এমন ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে যারা ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত পাগলামি-আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস নিয়ে শঙ্কিত হন বা সমালোচনা করেন, তাদের দলে আমি নই।

এক হিসাবে জানা যায়, ফুটবল আয়োজন করতে কাতারের ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ব্যয় ও আয়ের তফাতটা কি কেবল পাগলামি-আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাসের মূল্য! বোধকরি নয়। এই ব্যয় বিশ্ব দরবারে কাতারকে মাথা উঁচু করে নব নব বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। টাকার মূল্য আর অনুপ্রেরণার মূল্য- কোনটা বেশি? এই প্রশ্নের উত্তরের ভার পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানুষ জীবনের গান গায়; আমরাও মুক্তিযুদ্ধের সময় গেয়েছি। ক্যাম্পে প্রতিদিনের যৎসামান্য খাদ্য বরাদ্দ থেকে অর্থ বাঁচিয়ে মাস শেষে ফিস্ট খেয়েছি। সর্বোপরি বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে শঙ্কার মধ্যেও এসব পাগলামি-আবেগ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাস আমাদের জাতির অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে বহিঃপ্রকাশ। দল-মত-ধর্ম-শ্রেণি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলন, ঐক্য ও সংহতির সেতু, সুস্থ প্রতিযোগিতার বহিঃপ্রকাশ।

করোনা দুর্যোগের মধ্যেও অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কায় মানুষের হতাশা প্রকাশ পেয়েছে; কিন্তু মানুষ ঐক্যবদ্ধ থেকে মানবতার জয়গান গেয়েছে। আসলে বাধা-বিঘ্ন, ঝড়-ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে বিজয়ী হওয়াটাই তো আনন্দের-উৎসবের। ফুটবল উন্মাদনা আমাদের আগামী দিনের বিজয়ের সেই বার্তাই দিয়ে যায়।

বিশ্বকাপ ফুটবল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আলি খান কাতারের আল বায়ত স্টেডিয়ামে ধারণক্ষমতার বেশি দর্শক ও বিশ্বকে সাক্ষী রেখে বলেন, ‘মানুষে মানুষে বিভেদ ভুলে এই ঐক্য দেখতে কী দারুণ লাগছে!’ মানুষের, মানবতা ঐক্য আসলেই দারুণ এক অনুভূতি। দেশে-দেশে, বিশ্ব সমাজে যার আজ বড়ই প্রয়োজন।

অপরিনামদর্শী-অশুভ অস্ত্রযুদ্ধ, অর্থনৈতিক যুদ্ধের পরিনামে সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। জয় আমাদের ফুটবল উন্মাদনার জয়। জয় আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে জয়। জয় আমাদের অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সংগ্রামের জয়। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর সামনে রেখে জয় বাংলার জয়।

কলাম লেখক

রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh