বেড়েছে জিপিএ-৫ কমেছে মান

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:৩২ পিএম

শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান কমেছে। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান কমেছে। ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান কমেছে। কারণ চলতি বছর ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কেউ পাস করতে পারেনি।

এর মধ্যে ৪১টি মাদ্রাসা এবং ৯টি বিদ্যালয়। অথচ গত বছর শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ১৮টি। এছাড়া এবার পাসের হারও কমেছে গত বারের চেয়ে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এবার পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী। আর গত বছর পাস করেছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।

বছরে বছরে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ের নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার মানের সূচকে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩২ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়াতে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করেছে।

প্রকাশনাটি ২০১৯ সালের যে তালিকা দিয়েছে সেখানে এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। যদিও দেশে অনুমোদিত ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় একশর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কাজাকিস্তান, আফ্রিকার তানজানিয়া কিংবা ইরাকের মতো দেশ জায়গা করে নিয়েছে।

পাকিস্তানের ৯টি, ভারতের প্রায় ৫০টি এমনকি ছোট দেশ নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও রয়েছে। নেই শুধু বাংলাদেশের নাম।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, জিপিএ-৫ বাড়লেও শিক্ষায় মান কমার ঘটনাটি উদ্বেগজনক। কেননা জনসংখ্যার যে বিপুল অংশ তরুণ, যারা জাতিকে ‘তারুণ্যের ডিভিডেন্ড’ দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি, তারাই ক্রমাগত জাতির জন্য বোঝা হয়ে উঠছে।

মানহীন শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা এই বিপুল জনগোষ্ঠী একসময় দেশের জন্য ভার হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, জিপিএ-৫ আসলে কোনো দেশের শিক্ষার মান নির্ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীর উন্নত কোনো দেশে জিপিএ-৫কে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যতটা দেওয়া হয় বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।

আমাদের এই বদ্ধমূল চিন্তার খোলস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শুধু ভালো জিপিএর পেছনে না ছুটে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। পাসের হার বাড়লেই আমরা বলতে পারব না শিক্ষার মান বেড়েছে। এই যে এ বছর এত শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেল তাদের সবার মান তো এক নয়। আর শিক্ষার মান বাড়াতে বাংলাদেশের মানের শিক্ষা নয়, প্রয়োজন বিশ্বমানের শিক্ষা।

শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক বলেন, করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে এবার এসএসসির ফলাফল খারাপ হয়েছে। করোনা ও বন্যার কারণে অনেক স্কুল বেশিদিন ক্লাস করতে পারেনি। আবার বন্যায় অনেক শিক্ষার্থীর বই পুস্তক নষ্ট হয়েছে।

শূন্য পাস করা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মহিলা কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে এ বছর দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ছাত্রীদের মাত্র ২৬ দিন ক্লাস হয়েছে। খারাপ ফলের অন্যতম কারণ তাদের ঠিকমতো পাঠদান করা যায়নি। এই মাদ্রাসা থেকে এবার দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল ১৯ জন। কিন্তু কেউই পাস করেনি। অথচ মাদ্রাসাটি ২৫ বছর ধরে এমপিওভুক্ত।

৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় এবার পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা ৯টি বোর্ডের গড় পাসের হারের চেয়ে ৭ শতাংশের বেশি। আর পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট শিক্ষা বোর্ড।

এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা ৯টি বোর্ডের গড় পাসের হারের চেয়ে ৯ শতাংশেরও বেশি কম। এবার সিলেটসহ কয়েকটি এলাকায় ভয়াবহ বন্যার কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ১০ শতাংশ। শুধু এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ জন।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারের শূন্য পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মূলত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসংখ্যা কম, শিক্ষার্থীদের অনেকে বিদ্যালয়ে অনিয়মিত, ছাত্রীদের কেউ কেউ বাল্যবিবাহের শিকার ও ছাত্রদের কেউ কেউ করোনাকালে শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়েছে এবং শিক্ষকদের দক্ষতা ও পাঠদানে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয় আছে। কারণ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। শিক্ষকদের অনেকে সরকারের কাছ থেকে বেতনের মূল অংশ ও ভাতা পান। অভিযোগ আছে, যেনতেনভাবে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ‘নানাভাবে’ পাঠদানের সরকারি অনুমোদনও পাওয়া যায়। পরে অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তও হয়ে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, কীভাবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে। এজন্য মন্ত্রণালয় থেকে এসব স্কুলকে সহায়তা করা হবে।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়, এ বছর ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত বারের তুলনায় জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২ জন।

গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। এবার পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী। পাসের হার কমেছে গত বারের চেয়ে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। গতবার পাস করেছিল ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এবার নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ১০। আর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ। 

গত ১৫ সেপ্টেম্বর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার তিনটি মাদ্রাসার কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। এর মধ্যে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৯৪ সালে এমপিওভভুক্ত হয়। এখন ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। এ বছর এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ জন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু কেউ পাস করতে পারেনি। উল্লাপাড়ার বাঙ্গালা ইউনিয়নের ইসলামপুর (মাঝিপাড়া) ধরইল দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৮৫ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এবার ১০ জন দাখিল পরীক্ষা দিয়ে সবাই অকৃতকার্য হয়।

উপজেলার বড় পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বড় পাঙ্গাসীর খন্দকার নুরুন্নাহার জয়নাল আবেদীন দাখিল মাদ্রাসাটি ১৯৯৫ সালে এমপিওভুক্ত হয়। এখান থেকে এবার ১১ জন দাখিল পরীক্ষা দিলেও সবাই ফেল করে। কালিকাপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, তাদের ১২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৭ জন ছাত্রী, ৫ জন ছাত্র ছিল। করোনাকালে ছাত্রীদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় কাজে যুক্ত হয়েছে। এরপরও অনেক চেষ্টা করে তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হয়েছিল।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার নেই। এগুলো আসলে বোঝা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতে হলে ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকার নিয়ম আছে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম শিক্ষার্থী নেই, সেগুলোর স্বীকৃতি বাতিল করে দেওয়া উচিত।

সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শূন্য পাস করা ৯টি বিদ্যালয় গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রাজশাহী, যশোর ও জামালপুরের। আর ৪১টি মাদ্রাসা ২১টি জেলায় অবস্থিত। এগুলো হলো টাঙ্গাইল, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, যশোর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, ভোলা, রাজশাহী, শেরপুর ও কক্সবাজার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh