সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে

যতীন সরকার

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৫ পিএম

যতীন সরকার। ফাইল ছবি

যতীন সরকার। ফাইল ছবি

এখন বিজয়ের মাস। প্রতিবছর বাঙালির মাঝে ঘুরেফিরে আসে আমাদের এই বিজয়ের মাস এবং বিজয় দিবস। এরই মধ্যে বিজয়ের অর্ধ-শতাব্দী পালন করেছি আমরা। অর্ধ-শতাব্দীর পর আমাদের বিজয়ের যে প্রাপ্তি- এটা বলে শেষ করা যায় না। ‘বিজয়’ নিজেই একটা প্রাপ্তি। 

আমরা দীর্ঘকাল পরাধীন ছিলাম- ২শ বছরের সেই পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে আমরা ১৯৪৭ সালে একটি নতুন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হই। সেই নতুন রাষ্ট্রটি প্রকৃতপ্রস্তাবে আমাদেরকে শোষণ করতে শুরু করে। নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হতে থাকি নতুন রাষ্ট্রে। ওরা আমাদেরকে শোষণের একটি ক্ষেত্ররূপে পরিণত করল। কত দূরে সে রাজধানী- হাজার মাইলের ব্যবধানে পশ্চিম পাকিস্তান এবং এখানে আমাদের পূর্ব পাকিস্তান। 

এরকমভাবে একটি রাষ্ট্র অদ্ভুতভাবে তৈরি হয়েছিল। এভাবে কোনো রাষ্ট্র থাকতে পারে না। একটা অরাজক পরিস্থিতি ছিল তখন। এ কারণেই এর বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হলো। এরপর আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হলাম। আসলে পাকিস্তানের তথাকথিত জনক জিন্নাহ সাহেব যে দিন বললেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেদিনই আমাদের মোহ ভঙ্গ হলো চূড়ান্তভাবে।         

যে পূর্ববঙ্গ একদিন ছিল ব্রিটিশদের হাতের মুঠোয়, যে উপমহাদেশে সূর্য ডুবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নামে রোজ, ব্রিটিশের পতাকা উড়ত রাজপ্রাসাদের সামনে- সেদিন তো গিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য লড়াই হয়েছে- প্রাণ গিয়েছে হাজারো। বীর সূর্যসেন, প্রীতিলতার মতো সাহসী সন্তানদের জীবন গিয়েছে। সেই মাটিতে ফের স্বাধীনতার নামে শুরু হলো নতুন করে প্রহসন। এর বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়ালাম প্রথমবার ৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। আর এরপরই আস্তে আস্তে করে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে লাগলাম, বলা যায় অগ্রসর হতে থাকি নতুন করে। 

গত শতকের ষাটের দশকে আমাদেরকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে বিকৃত করার পাঁয়তারা চলছিল। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নজরুল ইসলামকে খণ্ডিত করা হয়েছিল। এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম তার মাধ্যমেই ৫২ সালের ভাষার লড়াইয়ে আমরা জিতে যাই। এই আন্দোলন ছিল আমাদের চলমান এক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমেই মূলত আমরা আস্তে আস্তে করে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। 

তবে সেদিন সেই যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল, আমরা স্বাধীন হওয়ার পরে সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গতিটাকে ধরে রাখতে পারিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা একসময় সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের দেশটিকে মুক্ত করলাম; কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর জাতির বিজয় লাভের পর আমরা সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পরিত্যাগ করলাম- একথা অনায়াসে বলা যেতে পারে। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পরিত্যাগ করার ফলেই দেখা গেল- আমাদের ওপরে এসে নতুন করে পাকিস্তান ভর করল। 

সদ্যস্বাধীন দেশ তখন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, যে দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দেশেই ৭৫-এর পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এবং এরপর যারা ক্ষমতায় এলো তারা প্রকৃত অর্থে পাকিস্তানের ভূতকেই এদেশে নিয়ে এলো। সেই পাকিস্তানের ভূতের হাত থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি। যদিও এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে- সেই সংগঠনটি।

তারপরও দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের সংবিধানকে যেভাবে কাটাকুটি করে নষ্ট করে দিয়েছিল। সেই পুরো সংবিধানটিকে তারা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আমাদের মধ্যে রাষ্ট্র ধর্ম বলে এখনো একটা ধর্ম বজায় আছে। আবার বলা হয়েছে আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের কথা। এই যে গোঁজামিল, এই গোঁজামিলের অবসান না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতভাবে আমাদের বিজয়ের যে ফল সেটা সবার ঘরে পৌঁছবে না। 

ফলে এবারে এই যে অর্ধ-শতাব্দী পরে বিজয় দিবস উদযাপন করছি, সেটা কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয় যেন, এই বিষয়ে আমাদের সক্রিয় সচেতনতা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু সেই সচেতনতা আমরা কোথাও দেখাতে পারিনি আজও। আর তা পারিনি বলেই এখনো আমাদের মধ্যে পাকিস্তানের ভূত আছর করে রয়েছে। 

ঠিক এ মুহূর্তে এমন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে, যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সেটির জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখনো ঠিকঠাক মুক্তির ইতিহাস জানতে পারেনি। 

১৯৭১ সালে এদেশের যে তরুণেরা লড়াই করেছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের মুখোমুখি অসীম সাহসী যোদ্ধা রূপে, সেই ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের কথা জানা প্রয়োজন তরুণদের। না হলে শত্রুকে জানতে পারবে না। তরুণের দল যখন দেশের মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস জানবে তখন নিজস্ব চেতনা জাগ্রত হবে তরুণদের মধ্যে।

ফলে তারা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করবে। একদিকে শিক্ষায় এগিয়ে যাবে একালের তরুণ যোদ্ধারা, আরেকদিকে স্বাধীনতার যে সফলতা, তারও দিকে অগ্রসর হতে থাকব আমরা। 

তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এভাবে এগিয়ে গেলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে, এটাই আমি সর্বতো কামনা করি। এটা ছাড়া সত্যিকার বিজয়ের ফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পথ আছে বলে আমি মনে করি না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh