জিঙ্কের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:১৫ পিএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:১৪ পিএম

জিঙ্কের ঘাটতি পূরণে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। ছবি: সংগৃহীত

জিঙ্কের ঘাটতি পূরণে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। ছবি: সংগৃহীত

জিঙ্ক বা দস্তা মানবদেহের অন্যতম প্রয়োজনীয় একটি খনিজ উপাদান। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রোটিন উৎপাদন ও দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সাহায্য করে ডিএনএ তৈরিতেও। পর্যাপ্ত জিঙ্কের অভাবে দেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জিঙ্ক ত্বক ভালো রাখতে যেমন সহায়তা করে, তেমনই শরীরের কোথাও কেটে গেলে ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধতেও জিঙ্ক অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। সময়মতো রক্ত জমাট না বাঁধলে ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। এতে বোঝা যায় শরীরের জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। 

মুখমণ্ডলের ব্রণ নিরাময়েও দেরি হয় জিঙ্কের ঘাটতি থাকলে। চিকিৎসকরা বলছেন, জিঙ্ক শরীরের কোষকলার গাঠনিক কাঠামো বজায় রাখা এবং শর্করা, চর্বি ও আমিষের বিপাক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন করে। গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে জিঙ্কের বিশেষ ভূমিকা আছে। শরীরে জিঙ্কের স্বাভাবিক পরিমাণ ২ থেকে ৩ গ্রাম। এ উপাদানটি শরীরের বিশেষ কোনো কোষকলায় অতিরিক্ত পরিমাণে জমা থাকে না। 

ফলে নিয়মিত বাইরে থেকে শরীরে সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। চিকিৎসকরা বলছেন, নারীদের প্রতিদিন আট মিলিগ্রাম ও পুরুষদের ১১ মিলিগ্রাম জিঙ্ক খাওয়া প্রয়োজন।

জিঙ্কের অভাব হলে শীর্ষ ৫ সমস্যা হয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষের জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, দেশের প্রায় সাড়ে ৪৪ শতাংশ শিশু এবং প্রায় সাড়ে ৫৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী জিঙ্কের অভাবজনিত রোগে ভুগছে। এই সমস্যাটি শীর্ষ ৫ শারীরিক সমস্যার একটি। ৩০০টির বেশি এনজাইমকে প্রভাবিত করে জিঙ্ক শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে নানা উপকার করে থাকে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, প্রতিটি মানুষের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

জিঙ্ককে বলা হয়ে থাকে শরীরের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান। মানব শরীরের প্রতিটি কোষ, টিস্যু, হাড় ও তরলে জিঙ্কের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এতেই অনুমান করা যায়, কেন জিঙ্ক শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এবং তার ঘাটতি দেখা দিলে শরীর কতটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জিঙ্কের ঘাটতি ও এর অভাব ঘটলে কি হয় সে বিষয়ে সচেতন নন। শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। করোনা মহামারি চলাকালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের জিঙ্ক ট্যাবলেট সেবন করার পরামর্শ দিতে দেখা গেছে বাংলাদেশের চিকিৎসকদেরও।

জিঙ্কের অভাবে বিভিন্ন রোগ

জিঙ্কের অভাবে দেখা দিতে পারে খাবারে অরুচি। ফলে পর্যাপ্ত খাবার খেতে না পারলে দেহে পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। ধীরে ধীরে শরীরের ওজন কমে যেতে থাকে। জিঙ্ক চুল, চুলের গোড়া ও মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এই উপাদানটির অভাবে চুল পড়ে যাওয়া, চুলের আগা ভেঙে যাওয়া কিংবা চুল পাতলা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যেতে পারে। 

এছাড়া নখে দেখা যেতে পারে সাদা দাগ। প্রয়োজনীয় এই উপাদানটির অভাবে ঘন ঘন সর্দি-জ্বর দেখা দিতে পারে। জিঙ্কের অভাব হলে শরীরে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ফলে সর্দি-কাশির মতো সমস্যা লেগেই থাকে। 

চিকিৎসকরা বলছেন, বয়স্ক মানুষের জিঙ্কের অভাবে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে প্রায় ৬৬ শতাংশ। জিঙ্কের অভাবে চোখের সমস্যাও হয়ে থাকে। চোখ ভালো রাখতেও জিঙ্ক অপরিহার্য। এর অভাবে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, চোখের তির্যক সমস্যা হয়ে থাকে। তবে শরীরে যে জিঙ্কের অভাব দেখা দিয়েছে তা পরীক্ষা করেই তা নিশ্চিত হতে হবে। নিশ্চিত না হয়ে কোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ করা ঠিক নয়। এ ধরনের সমস্যা হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে।

নিউরোলজিক্যাল সমস্যা 

মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জিঙ্ক খুবই উপকারী একটি উপাদান। মস্তিষ্কের কোষে জিঙ্কের ঘাটতি দেখা দিলে এর কার্যক্ষমতা ধীর হয়ে যায়। শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি দেখা দিলে এর প্রথম প্রভাবটাই দেখা দেয় মস্তিষ্কে। এর অভাবে শিশুদের মনোযোগে সমস্যা দেখা দেয়। এরা বই পড়ায় অথবা ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এমনকি বয়স্কদের মধ্যে অমনোযোগিতা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে জিঙ্কের অভাব দেখা দিলে জিঙ্ক ট্যাবলেট খাওয়া উচিত হবে না। তার পরিবর্তে জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে বেশি করে। 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় 

শরীরে সঠিক মাত্রায় জিঙ্কের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্যকর থাকে এবং জীবাণু সংক্রমণ কম হয়ে থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরে প্রয়োজন অনুযায়ী জিঙ্কের মাত্রা ঠিক থাকলে জীবাণু প্রতিরোধকারী টি-সেল সঠিক পরিমাণে উৎপাদন হয়ে থাকে। টি-সেল করোনা ভাইরাস ও ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে থাকে। অন্যদিকে হরমোন রিসেপ্টরের জন্যও জিঙ্কের প্রয়োজন হয়। এগুলো সম্মিলিতভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ডায়রিয়া দেখা দেয়

জিঙ্কের ঘাটতি দেখা দিলে কিছুদিন পরপর ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২০ লাখ (২ মিলিয়ন) শিশু ক্রমাগত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জিঙ্কের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরে ডায়রিয়ার জীবাণু (ই-কোলাই) প্রবেশ করে শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত করে। এছাড়াও পাকস্থলীজনিত আরও কিছু রোগ, অ্যালার্জি ও থাইরয়েডের সমস্যাও হয় শরীরে জিঙ্কের সঠিক মাত্রা বজায় না থাকলে।

শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়

জিঙ্কের অভাবেও শিশুরা সহজে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া কনজাংকটিভার প্রদাহ, পায়ে বা জিহ্বায় ক্ষত, মুখের চারপাশে ক্ষত, অ্যাকজিমা, ত্বকে ও দেহের ভেতরে ছত্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণজনিত অসুস্থতা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন শরীরে জিঙ্কের পরিমাণ কম থাকলে পুরুষের প্রজননক্ষমতাও কমে যায়। পাশাপাশি মানসিক দুর্বলতা, আচরণগত অস্বাভাবিকতা, বিষণ্নতা, সিজোফ্রেনিয়া দেখা দেয়। এ ছাড়া পুষ্টিহীনতা, ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, লিভারের সমস্যাজনিত রোগ হয়ে থাকে। 

জিঙ্কের ঘাটতি মোকাবিলায় জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান

যেসব খাবারে বেশি জিঙ্ক থাকে বাংলাদেশের বেশির মানুষ সে খাবারগুলো খেতে পারে না অর্থনৈতিক কারণে। এদেশের মানুষ অন্য কোনো কিছু না খেলেও চেষ্টা করে সামান্য তরকারি দিয়ে হলেও অধিক ভাত খেতে। ভাত খাওয়াকে পছন্দ করে বলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিরি) জিঙ্ক ধান উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে, যেন সাধারণ মানুষ ভাত থেকে সহজেই এবং পরিমাণ মতো জিঙ্ক পেয়ে যায়। 

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিঙ্কসমৃদ্ধ চালের মাধ্যমে শিশু ও মায়ের শরীরের জিঙ্কের ঘাটতি প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ সম্ভব। জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান চাষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষককে জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থাও করেছে। বিরি ১৯৯৫ সালে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ছয় জাতের জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উৎপাদন করেছেন। জিঙ্কের জিনসমৃদ্ধ ধান বাছাই করা মাটি থেকে দানার মধ্যে জিঙ্ক স্থানান্তর করতে পারে। উল্লেখ্য, জিঙ্কের জিন থাকে ধানের খোসার মধ্যে। এরপর জিঙ্ক জিনসমৃদ্ধ ধান উচ্চ ফলনশীল জাতের সঙ্গে ক্রস করা হয় অর্থাৎ সঙ্করায়ণ করা হয়।

যেসব খাবারে জিঙ্ক পাওয়া যাবে

চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, জিঙ্কের ঘাটতি পূরণে কোনো সামপ্লিমেন্ট নয়, খেতে হবে স্বাভাবিক খাবার। সে কারণে জিঙ্কের উপস্থিতি বেশি সে সব খাবার বেশি খেতে হবে। মিষ্টি কুমড়ার বিচি, কাজুবাদাম, মটরশুঁটি, মাশরুম, গরু, খাসি ও মুরগির গোশত, দই, কচুশাক প্রভৃতিতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক পাওয়া যায়। এসব খাবার নিয়মিত খেলে শরীরে সাধারণত জিঙ্কের অভাব দেখা দেয় না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh