আহসান হাবীব সুমন
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:২৭ পিএম
ইউরোপের ছককাটা গতিশীল ফুটবল হার মেনেছে ল্যাটিন ছন্দের কাছে। ছবি: সংগৃহীত
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ট্রফি জয়ের মধ্য দিয়ে ল্যাটিন ফুটবলের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। ইউরোপের ছককাটা গতিশীল ফুটবল হার মেনেছে ল্যাটিন ছন্দের কাছে। অবসান ঘটেছে দুই দশক ধরে বিশ্বকাপ ফুটবলে ইউরোপের একচ্ছত্র আধিপত্যের।
২০০২ সালে ল্যাটিনের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। পরবর্তী চারটি বিশ্বকাপ গেছে ইউরোপে। তাতে ইউরোপের ফুটবল নিয়ে গর্ব যেন আকাশ ছুঁয়েছিল। ২০২২ সালের শুরুতেই ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে বলেছিলেন, ইউরোপের তুলনায় ল্যাটিনের ফুটবল এগোয়নি।
এমবাপ্পের এমন মন্তব্যে তেতে উঠেছিল পুরো ল্যাটিন। কাকতালীয়ভাবে সেই এমবাপ্পের ফ্রান্সকেই ফাইনালে হারিয়ে বিশ্ব ফুটবলে ল্যাটিনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে আর্জেন্টিনা। এ যেন প্রকৃতির নির্মম বিচার।
গত দেড় যুগ ধরে বিশ্ব ফুটবল শুধু ল্যাটিন আর ইউরোপের আধিপত্য নিয়ে বিভাজিত ছিল না। ছিল ফুটবলের দুই মহানায়ক লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও দ্বিধা। কাতারে মেসি বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে আপাত সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুটি ‘গোল্ডেন বল’ আর বিশ্বকাপের প্রতিটা ম্যাচে গোল করার রেকর্ড নিয়ে আর্জেন্টাইন মেগাস্টার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৩৭ বছর বয়সী পড়ন্ত ক্যারিয়ারের রোনালদো বিশ্বকাপ জয় করে মেসিকে কখনো ছুঁতে পারবেন- এমন ভরসা নেই।
লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে এখন আর কোনো অপূর্ণতা নেই। ক্লাব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার ট্রফিভাণ্ডার উপচে পড়া। বাকি ছিল আন্তর্জাতিক সাফল্য। সেটাও ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার পর বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। মেসি এখন নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা চরিত্র। তিনি এখন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর প্রয়াত দিয়াগো ম্যারাডোনার আশীর্বাদপুষ্ট। যিনি জীবদ্দশায় বহুবার মেসির সমালোচনা করেছেন শুধু আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্যর্থতার কারণে। সেটা তিনি করতেন অভিমানেই। মেসির বিশ্বকাপ জয়ে ম্যারাডোনার স্বর্গীয় আত্মা শান্তি পাবে- সন্দেহ নেই।
ল্যাটিনের সমালোচনা করে অনেকের বিরাগভাজন হলেও এমবাপ্পে কাতারে সবার মন ঠিক জয় করেছেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে টানা দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে জিতেছিলেন সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কার। এবার ফাইনালে হারলেও জিতেছেন ‘গোল্ডেন বুট’। এমনকি ১৯৬৬ সালে জিওফ হার্সটের পর ইতিহাসের দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে হ্যাট্রিক করার অনন্য গৌরবগাথা রচনা করেছেন। মেসি-রোনালদো পরবর্তী যুগশ্রেষ্ঠ ফুটবলারের ‘সিংহাসন’ দখলের স্পষ্ট ঘোষণা তিনি দিয়েই রাখলেন কাতার বিশ্বকাপে।
কাতার বিশ্বকাপের পর্দা নামার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের মন সিক্ত হয়েছে অনেক প্রিয় ফুটবলারের প্রস্থানে। কাতার বিশ্বকাপেই শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন লুইজ সুয়ারেজ, রবার্ট লেভেন্ডস্কি, লুকা মদ্রিচ, কেইলর নাভাস, ম্যানুয়েল ন্যয়ার, থমাস মুলার, হুগো লরিসরা। যারা বিগত দুই দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন ভক্তদের। মেসি, রোনালদো এমনকি নেইমারকেও হয়তো দেখা যাবে না পরবর্তী বিশ্বকাপে। কাতার বিশ্বকাপ আধুনিক ফুটবলের নক্ষত্রদের একসঙ্গে বিদায় জানিয়ে নিজেকে গর্বিত করেছে।
যদিও পুরনোকে বিদায় করে নতুনের আগমন প্রকৃতির অমোঘ বিধান। যে ধারায় ইতোমধ্যে রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াস জুনিয়র, ফিল ফোডেন, গ্যাভি, পেদ্রি আর চুয়ামেনিদের আগমনীবার্তাও পেয়ে গেছে বিশ্বফুটবল।
কাতার বিশ্বকাপ শেষ। পরবর্তী বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালে ইতিহাসে প্রথমবার তিনটি দেশের যৌথ আয়োজনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আর মেক্সিকোর মাটিতে সেই বিশ্বকাপ হবে নতুনদের স্বপ্নযাত্রা। তবে সেই সময় পর্যন্ত বিশ্বফুটবলে ল্যাটিন আমেরিকাই শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই কৃতিত্ব আর্জেন্টিনার। এই কৃতিত্ব লিওনেল স্কালোনির তত্ত¡াবধানে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা মেসি অ্যান্ড কোংয়ের।