আবুল ফজল সাহিত্য ও সমাজ ভাবনা

সাদাত উল্লাহ খান

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:১৩ পিএম

সাহিত্যিক আবুল ফজল। ফাইল ছবি

সাহিত্যিক আবুল ফজল। ফাইল ছবি

বাংলা সাহিত্যে আবুল ফজলের আগমনই একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ তাঁর শৈশব ও কৈশোর যে পারিবারিক পরিবেশে কেটেছে তাতে তাঁর সাহিত্যসেবক না হয়ে ইসলামধর্ম সাধক হওয়াটাই ছিল অধিক যুক্তিসঙ্গত ও পরিবেশসঙ্গত।

চট্টগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম খ্যাতিমান মৌলবি ফজল রহমান চেষ্টা করেছিলেন পুত্র আবুল ফজলও হবে পিতার মতো একজন খ্যাতিমান ইমাম। সে আশায় বুকবেঁধে আবুল ফজলকে পিতা চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় ভর্তি করান। বাড়িতে বাংলা ভাষাচর্চা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু আখেরে আবুল ফজল হলেন একজন সফল ও প্রতিবাদী সাহিত্য সাধক।

তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় শৈশবে। প্রসঙ্গত আবুল ফজলের স্মৃতিকথা থেকেই উল্লেখ করি-“আমাদের ছেলেবেলা বেশ কিছুটা বেপরোয়াভাবেই কেটেছে। বিশেষত যতদিন গ্রামে ছিলাম জীবনটা ছিল রীতিমতো উদ্দাম। একটু বড় হয়ে দূর দূর গ্রামেও চলে যেতাম যাত্রা কি কবি গান শুনতে... চাঁদনিরাতে ছেলেরা ‘বদর’ দিয়ে উঠলে কিছুতেই ঘরে স্থির থাকতে পারতাম না।”

তার স্মৃতিচারণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘রেখাচিত্র’তে পিতার বিষয়ে স্মরণ করছেন। পিতার নির্দেশে তিনি ওকালতি পাঠ বাদ দিলেও বাংলা ভাষায় লেখালেখি বাদ দেননি। এর মাধ্যমে তিনি বংশ পরম্পরায় চলে আসা গোঁড়া রীতি ভেঙে দিলেন। তিনি একের পর এক রচনা করলেন, চৌচির (১৯৩৪), প্রদীপ ও পতঙ্গ (১৯৪০), মাটির পৃথিবী (১৯৪০), বিচিত্র কথা (১৯৪০), রাঙ্গা প্রভাত (১৯৫৭), রেখাচিত্র (১৯৬৬), দুর্দিনের দিনলিপি (১৯৭২) প্রভৃতি গ্রন্থ।

আসলে যারা বড় হয়, কীর্তিমান হয় তাদের জীবনের গল্প এমন করেই শুরু হয়। আমরা দেখি পরবর্তীকালে আবুল ফজল সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে অবলোকন করেছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন একুশ মানে মাথা নত না করা। তিনি কখনো অন্যায় শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। তিনি তাঁর গল্পে সমাজের  অন্যায়, অবিচার ও অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। 

আমরা দেখি দেশের যে কোনো সংকটে যে কজন পণ্ডিত মনীষা বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে প্রতিরোধমন্ত্র ও আত্মপরিচয় স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন আবুল ফজল তাদের অন্যতম। পরিবারিক ও রাষ্ট্রীয় বৈরী পরিবেশের মধ্যেই তিনি তার চিন্তাকে বিকশিত করেছিলেন।

কেবল তাই নয়-তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদী একজন লেখক ও শিক্ষক। আর শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি বরাবরই বিকাশধর্মিতার প্রতি উৎসাহী ছিলেন। 

‘চিত্র-কলা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লেখেন: ‘স্বদেশের নবজাগ্রত চিত্রকলার প্রতি দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই যে অবহেলা ও অনাদর, এর মূলে, আমার মনে হয়, আমাদের কলা-শিল্প-জ্ঞানের অভাব ও অজ্ঞতাই দায়ী।...কর্তৃপক্ষ যদি প্রত্যেক স্কুল-কলেজে ছোটখাটো এক-একটি চিত্রশালা (স্কুল লাইব্রেরি বা কমনরুমেও তা হতে পারে) প্রতিষ্ঠার আদেশ ও সেই বাবদ কিছু কিছু অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করেন তা হলে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ থেকেই শিল্প-শিক্ষা আরম্ভ হতে পারে।’ যে কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

‘মানব কল্যাণ’ প্রবন্ধে আবুল ফজল লেখেন-“রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রশাসন চালানোই নয়, জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলাও রাষ্ট্রের এক বৃহত্তর দায়িত্ব। যে রাষ্ট্র হাতপাতা আর চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, সে রাষ্ট্র কিছুতেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না। তাই মানবকল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যত্বের অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাকে কিছুতেই মানবকল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না।”

দেশ ও দেশের ভাবনায় সব সময় ভাবতেন ও লিখতেন। ফলত মানবকল্যাণ বলতে লেখক মূলত মানুষের ব্যবহারিক জীবনের কল্যাণকে বুঝিয়েছেন। মানবতন্ত্র (১৯৭২) গ্রন্থে কিছু অংশ তার চিন্তা গভীরতার পরিচয় বহন করে। 

তাই তিনি বলেন-“আমাদের বিশাল মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে মানব কল্যাণ হয়ে উঠবে মানব মর্যাদার সহায়ক।”

মানুষের জীবন নিয়ে তার ভাবনা ছিল আমৃত্যু। অন্যদিকে বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে আবুল ফজলের স্থানও বেশ উজ্জ্বল। তিনি জীবন ও সমাজের জন্যেই শিল্প সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। তাঁর সমাজচেতনা ও শিল্পচেতনা বেজায় প্রখর। তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক। 

আবুল ফজলের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে পাঁচটি। যথা (১) মাটির পৃথিবী, ঢাকা, ১৯৪০। (২) আয়ষা, চট্রগ্রাম, ১৯৫১। (৩) শ্রেষ্ঠ গল্প, চট্টগ্রাম, ১৯৬৪। (৪) নির্বাচিত গল্প, ঢাকা, ১৯৭৮। (৫) মৃতের আত্মহত্যা, ঢাকা, ১৯৭৮। 

আবুল ফজলের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মাটির পৃথিবী’। এই গল্পগ্রন্থে মোট ১৭টি গল্প আছে। গল্পগুলো হচ্ছে: আয়ষা, একখানি হাসি, হাকিম, পরদেশিয়া, জয়, জনক, সংস্কারক, লাঠৌষধ, আলোছায়া, শরীফ, আহমদ, নবাব-আমির-বাদশা, চোর, পরিণাম, দুই যাত্রী, রহস্যময়ী প্রকৃতি ও মাটির পৃথিবী। তাঁর প্রথম মৌলিক গল্প ‘ইসলাম কী জয়’। ১৩৩৪ সালে কার্তিক সংখ্যায় ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর গল্পটি প্রকাশ হয়। পরে অবশ্য ‘জয়’ নামে গল্পটি ‘মাটির পৃথিবী’ গ্রন্থে সংকলিত হয়।

এ গ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে লেখকের সমাজ চেতনা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। 

এতে দেখা যায় সমাজের বিভিন্ন চিত্র, বিশেষত মুসলিম সমাজের নানামুখী চিত্র, ধর্মের মুখোশধারী মানুষের ভণ্ডামি, ইসলাম ও ধর্মের ব্যবসায়ীদের স্বরূপ। আবার রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারী আভিজাত্যগর্বী মুসলমান সম্প্রদায়ের অধঃপতনের চিত্র। ‘মাটির পৃথিবী’ গ্রন্থের গল্পসমূহে আবুল ফজল সামাজিক অবিচার, যৌনতা, প্রেম, প্রকৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, মনস্তত্ত্ব, দরিদ্রতা ইত্যাদি সমাজের সমস্যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। 

আবুল ফজল তাঁর ‘মাটির পৃথিবী’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। বইটি সম্পর্কে নজরুল ইসলাম বলেন: ‘আভিজাত্যাভিমানী অথচ দরিদ্র মুসলমান সমাজের যে নিখুঁত চিত্র ইনি এঁকেছেন, তার তুলনা নেই। বাংলার যে অংশ অজানা ছিল সেই অবহেলিত সমাজের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেশের ও সমাজের প্রত্যুপকার সাধন করলেন।’

১৩৩০ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে সংশয় প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ‘কল্লোল’ লেখকগোষ্ঠী-এই সংশয়-দ্বন্দ্ব জিজ্ঞাসাকে সাহিত্যে রূপ দিতে এগিয়ে আসেন। স্বল্পতা ও আবেগের পরিবর্তে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণতত্ত¡ ও সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষের বদলে নিম্নস্তরের বস্তিজীবনের নগ্ন বাস্তবতাকে তারা সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আবুল ফজলের ‘মাটির পৃথিবী’ গ্রন্থের গল্পসমূহে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর প্রভাব সুস্পষ্ট।  

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি আবুল ফজলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আয়ষা’। এ গ্রন্থে মোট ১৩টি গল্প আছে, এর মধ্যে নতুন গল্প হলো ১২টি, যথা : নিজের মা ও পরের বাপ, উচ্চ ও তুচ্ছ, পুত্রার্থেভার্যা এবং তিন বিয়ের একফল। ১৩ গল্পের বাকি ৯ গল্প আগের গল্পগ্রন্থ ‘মাটির পৃথিবী’ থেকে সংকলন করা হয়েছে। 

‘নিজের মা ও পরের বাপ’ গল্পে অপত্যস্নেহকে কেন্দ্র করে মানুষের স্বার্থপরতার চিত্র অংকিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এই সত্যও গল্পটি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাৎসল্যপ্রীতির প্রশ্নে ধনী দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নেই। ধনী চৌধুরী সাহেব এবং তার দরিদ্র ঝি সন্তানপ্রীতির প্রশ্নে একই মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে এই গল্পের মধ্যে। সামাজিক জীবনের বৈষম্য 

স্নেহ-প্রীতির ক্ষেত্রে গিয়ে টিকতে পারেনি। 

‘আয়ষা’ গ্রন্থের নতুন দ্বিতীয় গল্প ‘উচ্চ ও তুচ্ছ’। ‘উচ্চ ও তুচ্ছ’ গল্পটি যুদ্ধের বাজারে একজন স্বল্প বেতনভোগী কেরানির জীবনালেখ্য। এই গল্পটিতে মানুষের মনের উচ্চ ও মহৎ অভিব্যক্তির পাশাপাশি জৈবিক চাহিদাকে প্রকাশ করা হয়েছে। যুদ্ধের কল্যাণে আমাদের শাশ্বত ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস কি নির্মমভাবে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে এই গল্পে তার পরিচয় ধরা পড়েছে। 

আবুল ফজলের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের নতুন তৃতীয় গল্প হলো ‘পুত্রার্থে-ভার্যা’। এই গল্পটিতে আছে হালকা রসিকতা। কাহিনি বর্ণনাই মুখ্য হয়ে উঠেছে চরিত্র-চিত্রণ নয়। তাই একে সাদামাটা ধরনের গল্প বলা যায়। 

এ গল্পগ্রন্থের নতুন চতুর্থ গল্প হলো ‘তিন বিয়ের একফল’। এটি মূলত একটি মিলনাত্মক গল্প। এতে বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব আছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন মানবজীবনের স্বাভাবিক অভিব্যক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত কোনো বাধাই আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। লেখক গল্পটিতে মানবধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। এই গল্পে আবুল ফজলের মানব মুক্তির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে। চিন্তাধারায় বারবার মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন হলেও এই গল্পে মানবতার আরও উদারতারপটে শিল্পী আবুল ফজলের আত্মমুক্তি ঘটেছে। 

আবুল ফজলের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ তা আগেই একবার উল্লেখ করেছি। ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ গ্রন্থে মোট গল্পের সংখ্যা ৩০টি। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মাটির পৃথিবী’ এবং ‘আয়ষা’ থেকে মোট ২১টি গল্প ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ গ্রন্থে নতুন গল্প সংযোজিত হয়েছে শুধু ৯টি। যথা: সতীর সহমরণ, কুমারী এ-মা, কবিতার অপমৃত্যু, রাহু, সাক্ষী, সিতারা, প্রেম মৃত্যু, বিবর্তন এবং দ্বিতীয়বার। অতি সংক্ষেপে এই গল্পগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করার চেষ্টা করব। 

‘সতীর সহমরণ’ একটি সমালোচনামূলক গল্প। গল্পটিতে ব্যঙ্গ-রসাত্মক আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তঃসারশূন্য সমাজকে সমালোচনা করা হয়েছে। শ্রীমন্ত বাবুর ছেলে শ্রীনাথ ছায়ার দিদিকে প্রেম নিবেদন করায় তার কিছুই হয়নি বরং ছায়ার দিদিকে সমাজ পরিত্যাগ করতে হয়েছে। ষাট বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে ছায়ার বিয়েতেও সমাজ কোনো আপত্তি তোলেনি। ছায়ার সহমরণে তাঁর পিতা কমল বাবু নিজেকে ধন্য মনে করেছে। আর ছায়া সবাইকে অবাক করে শেষ মুহূর্তে স্বামীর চিতায় নিজেকে বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করলহিন্দুর বিয়ে দেহগত নয়, শাস্ত্রগত। কী যে নিষ্ঠুরতা আর রসিকতা। 

‘কুমারী এ-মা’ গল্পটি অতি আধুনিকা একজন নারীর অধঃপতন নিয়ে রচিত। সমগ্র গল্প জুড়েই তথাকথিত অতি আধুনিকতা নারীর প্রতি ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এতে হয়তো বর্তমানকালের মনমানসিকতার দোষে আক্রান্ত বলে অভিযুক্ত করতে পারেন। এই গল্পের নায়িকা এ-মার দম্ভভরা মেকি ব্যক্তিত্ব গল্পটিতে হাস্যরসের জোগান দিয়েছে। নারী স্বাধীনতা একটা নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করার পর কীভাবে একজন নারীকে সর্বনাশের পক্ষে নিমজ্জিত করতে পারে তারই চিত্র গল্পকার এ-মা-র ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

‘কবিতার অপমৃত্যু’ একটি মনোবিশ্লেষণমূলক গল্প। গল্পে মানবমনের চিরন্তন প্রকৃতি ও অতৃপ্ত কামনা অতি চমৎকারভাবে রূপায়িত হয়েছে। লেখক বলতে চেয়েছেন, ‘আমরা যা পাই আমাদের শাশ্বত আগ্রহ। পরকীয়া প্রেমের একটি চিরকালীন আবেদন রয়েছে। রমণীর পরকীয়া প্রেম পুরুষকে বিশষভাবে আকর্ষণ করে। কিন্তু সে নারীকে অতৃপ্তির ভেতর দিয়ে পুরুষের আগ্রহে ভাটা-পড়ে যায় কিংবা একটু বৈরাগ্য এসে যায়। এই হলো গল্পের মর্মবাণী। 

‘সাক্ষী’ গল্পটি রচিত হয়েছে হাদিসের ছায়া অবলম্বনে। জোহরা চরিত্র মৃত্যুকে জয় করে মানবীয় গুণাবলি লাভ করেছে। আমরা দেখতে পাই যে, পতিতাবৃত্তির দায়ে সমাজ জোহরাকে দণ্ড দিচ্ছে কিন্তু তার অংশীদার পুরুষের প্রতি সমাজ নির্বিকার রয়েছে। জোহরা চরিত্রটি মানবীয় গুণাবলি লাভের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। গল্পটিতে লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় নীতিবাদী-আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে। 

‘দ্বিতীয়বার’ গল্পটি সরলভাবে গতানুগতিক ভঙ্গিতে রচিত। এতে লেখক চরিত্র সৃষ্টির চেষ্টা না চালিয়ে একে একটি কাহিনিনির্ভর গল্পে পরিণত করেছেন। এতে দেখা যায় চরিত্রস্খলনের কারণে ওয়াজেদের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। হায়দার একজন সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী। ফিরোজার রূপে মুগ্ধ হয়ে সে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গিয়েছিল এবং এক সময় জানাজানি হয়ে গেলে ফিরোজার ভালোবাসা পাবার জন্যে তার ভেতর ব্যক্তিত্ব জেগে ওঠে। ফিরোজা ওয়াজেদকে দশজন বাঙালি রমণীর মতো ভালোবাসতো। তাই হায়দারের প্রলোভনে সে ভেঙে পড়েনি। তাই গল্পের পরিণতিও গতানুগতিক। 

‘বিবর্তন’ আবুল ফজলের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম। এই গল্পটি তাঁর মানবতাবাদী ও চিন্তাচেতনার এক সফল সৃষ্টি। গল্পটিতে হাফেজ মওলানা সাহেবকে প্রথম থেকেই লেখক একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গল্পের শেষভাগে মওলানা মোহাম্মদ হোসেনের প্রতি পাঠকমনে যথেষ্ট সহানুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। গল্পের বর্ণনাভঙ্গি চমৎকার, ভাষা, সাবলীল এবং সংলাপ রচনা করা বাস্তবানুগ হয়েছে। 

‘সিতারা’ গল্পে আবুল ফজল কালজয়ী হতে পেরেছেন খানবাহাদুরের মতো বিশেষ চরিত্র সৃষ্টি করে। এই গল্পে লেখক ভণ্ড তপস্বীদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন। সমাজে আমরা যাদের অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় বলে মনে করতে পারি-তাদের যে আর একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে এবং তা কতটা জঘন্য হতে পারে তার স্বরূপ যথার্থভাবে এই গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘সিতারা’ গল্পে খানবাহাদুর ব্যক্তি হিসেবে নিকৃষ্ট নন। এ গল্পের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি আশরাফ চরিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের নায়িকা ‘সিতারা’-আপন মাধুর্যে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সৃষ্টি। 

‘প্রেম ও মৃত্যু’ গল্পের আমিনা চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে আবুল ফজল নিজেকে মানবতাবাদী সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পের মধ্যে আছে দুটি ধারা, এক ধারায় আজরাইল মদনের বিতর্ক অন্য ধারায় 

আমিনা-আকতারের প্রেম। গল্প বর্ণনার ভঙ্গিটি অভিনব। 

‘গল্প সংকলন’ আবুল ফজলের চতুর্থ গল্পগ্রন্থ। এ গ্রন্থের ১৬টি গল্পের মধ্যে ১৫টি নেওয়া হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ থেকে। সুতরাং গল্প সংকলন বিষয়ে এখানে বিশেষ কিছু আলোচনা নেই। 

আবুল ফজলের সর্বশেষ বা বলা যায় পঞ্চম গল্পগ্রন্থ ‘মৃতের আত্মহত্যা’। এ এতে মোট চারটি গল্প : ‘মৃতের আত্মহত্যা, নিহত ঘুম, কান্না এবং ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। এই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। এমন একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেকোনো বিবেকবান মানুষকে পীড়িত করে। তাই আবুল ফজলের মতো মানবতাবাদী শিল্পীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড একটি মানবতা পরিপন্থী হত্যা ছাড়া কিছুই নয়।

এই বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদে ‘মৃতের আত্মহত্যা’। এ গ্রন্থের সব গল্পই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হিসেবে লেখা। মানব তাড়না থেকে প্রতিবাদ হিসেবে আবুল ফজলের ছোটগল্প আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি তাঁর ছোটগল্পে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর মানবিকতা। তিনি নিজে সমাজ, সাহিত্য ও চরিত্র চিত্রণে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সমাজে ভণ্ডামি, নীচতা, হীনতা, ধর্ম ব্যবসায়ীদের মিথ্যা ছদ্মবেশ, যৌনতা, অসহায় নারীর জীবন ইত্যাদি চিত্রণে সর্বত্রই তাঁর উদার মনের পরিচয় লক্ষ করা যায়। তাই তিনি একজন উদার মানবতাবাদী লেখক। 

দুই

‘একুশ মানে মাথা নত না করা’-বলেছেন আবুল ফজল। তিনি কখনো কোনো অন্যায় শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। তাই সঙ্গত কারণেই তাঁকে বাঙালির বিবেকের প্রতীক বলে সম্মান জানানো হয়। ১৯৭৪ সালে ৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে কাজী নজরুল ইসলাম, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহের হোসেন এবং আবুল ফজলকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সেই সমাবর্তনের ভাষণে তিনি বলেন : 

‘মানুষের জীবনে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাহিত্যের একটি প্রধান ভ‚মিকা রয়েছে। সে ভ‚মিকায় আমি কখনো বিস্মৃত হইনি। তাই দেশের মানুষ আর সমাজের বিচিত্র সমস্যা বারবার আমার লেখায় ছায়াপাত করেছে। এমনি সময় আমার লেখাকে কণ্টকিতও করেনি তা নয়। ভয়ে বা প্রলোভনে আমি কখনো লেখাকে সাহিত্য তথা সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেইনি।’

তাঁর কাছে সাহিত্য ও সত্য সমার্থক শব্দ। তাই তিনি সাহিত্যকে গ্রহণ করেছেন সত্য হিসেবে। তাঁর ষাটতম জন্মদিবসে তাঁর বিবিধ রচনা থেকে ‘শত উক্তি’ সংকলন করে প্রকাশ করা হয়। সেই সময়টা ছিল ১৯৬৩ সাল। লেখকের রোজনামচা শীর্ষক বইতে ‘শত’ উক্তি ছাপা হয়েছে।

আবুল ফজল তাঁর ‘শত উক্তি’র প্রথম উক্তিতে বলেছেনধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক মতবাদে যদি সাহিত্য লালিত হয়, তাহলে সাহিত্য আর সাহিত্য থাকে না। সাহিত্য বন্দি হয়ে যায়। মানে সত্য আর সত্য থাকে না। তিনি দ্বিতীয় উক্তিতে বলেন- লেখকের উপর কোনো জবরদস্তি চলবে না। লেখক তখন শিল্পী। তাকে মুক্ত অবস্থায় নিজের মতো লিখতে দিতে হবে। অন্যথায় সত্যের বিকাশ হবে না। তিনি তাঁর তৃতীয় উক্তিতে বলেন-রাষ্ট্র ও মতবাদ সবই এক একটা শৃঙ্খল। সাহিত্য মানুষের মনের মুক্তির ক্ষেত্র। মুক্তির জন্য শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। তাই সাহিত্য মুক্তির হাতিয়ার। শৃঙ্খল ভাঙার মাধ্যম। সাহিত্য সমাজের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। 

বর্ণ বা সম্প্রদায়, জাতি বা ভাষার কারণে সাহিত্য শিল্পের স্মরণীয় ঐতিহ্য বিশেষকে উপেক্ষা করা যাবে না। যদি করা হয় নিজের সাধনাকে ছোট করে দেখা হয়। এসব বলেছেন পঞ্চম উক্তিতে। সাহিত্য স্বাধীনতার বাণী শোনায়। জীবনকে জানার অর্থ স্বাধীনতা। সাহিত্য ছাড়া স্বাধীনতা হবে না। 

সাহিত্য ও শিল্প মানব হৃদয়ে প্রবেশ করে মনকে জাগ্রত করে, সমাজকে সজাগ করে, জীবনে প্রাণ সঞ্চার ঘটায়। মনে ফুল ফুটলেই কলমের মুখে ফুল ফুটবে। সাহিত্য সৃষ্টি হবে। মনই সাহিত্যকে সৃষ্টি করে। সাহিত্যে মনের প্রতিফলন ঘটে। সুতরাং সাহিত্যে সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। তাই তো তিনি বলেন সাহিত্য সমাজের আয়না। 

তিনি বলেছেন সাহিত্য একটি শিল্পকর্ম, অন্য শিল্পের মতো সাহিত্যেরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। তাই প্রস্তুতি প্রায়ই সাহিত্যকে দান করে বিশেষত্ব। বিশ্বসাহিত্যে বিচরণ করার আগে জাতীয় সাহিত্য জানা জরুরি। অন্যথায় সাহিত্যের কিছুই জানা যাবে না। সাহিত্য জীবনে নতুন ও বিচিত্র চেতনার সঞ্চার ঘটায়। এসব নতুন চেতনা কোনো বিশেষের দ্বারা হয় না, বাইরের ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা ঘটে। তাই সাহিত্য বিশ্বের সঙ্গে, যুগপ্রবাহের সঙ্গে মানুষ ও সমাজের সেতুবন্ধ তৈরি করে। 

সাহিত্যের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আছে। এই তিন এক সূত্রে গাঁথা। এগুলো উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল। সুতরাং সাহিত্য যেমন সমাজের তেমন যুগেরও আয়না, বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। 

সাহিত্য মনের বন্ধন মুক্তি ঘটায়। মনের মধ্যে দীর্ঘদিনের অন্ধবিশ্বাস বাসা বেঁধে বাস করে। সাহিত্য এসব বিভাজন করে। মনের মুক্তি ঘটায়। সুতরাং সাহিত্য মুক্তির বাণী শোনায়। দেশ ও জাতির বড় সম্পদ ভাষাসাহিত্য। সব ধরনের উন্নতি ও প্রগতি নির্ভর করে দেশের ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমেই। মানুষের চিন্তার বাহন হলো ভাষা ও সাহিত্য। চিন্তার অগ্রগতি আসলেই কর্মের জগতে জোয়ার আসবে। সাহিত্য ও শিল্পের পথ সত্যের পথ। সত্য অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম। সাহিত্য সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। কারণ সাহিত্য ও সত্য হাত ধরাধরি করে চলে। দেশে মাটি, মানুষ ও প্রতিদিনের উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়েই সমাজ। দেশের প্রতিদিনের সে চিত্র আমরা দেখতে পাই তাই তো সাহিত্য জগৎ। তাই সাহিত্য মানে দৈনন্দিন সমাজ চিত্র। 

সাহিত্যের মাঝে প্রকৃত মানুষ পাওয়া যায়। মানব বিকাশের জন্য আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতি সাহিত্য। সাহিত্য ছাড়া আসল মানুষ পাওয়া যায় না। সাহিত্য থেকে মানুষকে আলাদা করা যায় না। 

সাহিত্য সমাজকে কূপমণ্ডূকতা থেকে বাঁচায়। সাহিত্য প্রেরণা জোগায়। সাহিত্য সমাজ থেকে গোঁড়ামি দূর করে। সাহিত্য সংস্কৃতির মূল কাণ্ড। সাধারণত সাহিত্যকে অবলম্বন করে সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা প্রসারিত হয়। সাহিত্য বিচার করে মানবতা, সত্য। তাই সাহিত্যিকদের কাছে সত্যই বড় কথা। সাহিত্য সমাজে আলো জ্বালায়, অন্ধকার দূর করে, মানুষকে মানবতার পথ দেখায়, যুক্তিবান ও বিবেকবান হতে শেখায়।

আবুল ফজলের শত উক্তির বেশিরভাগেই সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তাতে সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের মানুষের, যুক্তির সংস্কৃতির, বিবেকের, জ্ঞানের, যুক্তিবাদের, আলোর জাগরণের, বিকাশের আধুনিকতার সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে। আবার সঙ্গে সমাজ ভাবনা ও সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে। কারণ তিনি ছিলেন সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ। তার শত উক্তিতে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সাহিত্য, সত্য ও মানুষ, শাস্ত্র, ধর্ম ও শৃঙ্খলা নয়।

তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন-সাহিত্যই সমাজে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা ও অজ্ঞতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা, উদারতা ও আধুনিকতার বাণী প্রচার করে। আরও প্রচার করবে সত্যের কথা। সত্য কঠিন, সত্য নিরাপদ- তিনি সাহিত্যকে গ্রহণ করেছেন সত্য হিসেবে, কারণ সাহিত্যের জাগরণ সমাজে জাগরণ সৃষ্টি করে। সমাজে প্রগতি সাধন করে। তাই আমরা তার ‘শত উক্তি’তে জাগরণ, প্রগতি ও উন্নতির বাণী দেখতে পাই।

আবার তাঁর ‘শত উক্তি’তে তাঁর স্বপ্নও দেখতে পাই। আবুল ফজল তাঁর পঁচাশিতম উক্তিতে বলেছেন-খাঁটি সাহিত্যের কাছে শাস্ত্রকে এমনকি রাষ্ট্রীয় শক্তিকেও একদিন মাথা নোয়াতে হবে-এ বিশ্বাসে আমি বিশ্বাসী। আমরাও বিশ্বাস করি তাঁর এ বিশ্বাস সফল হোক। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh