জয়দুল হোসেন
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০২:৪০ পিএম
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশেষ অবদান রয়েছে। প্রতীকী ছবি
শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুনাম উপমহাদেশ জুড়ে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যেমন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশেষ অবদান রয়েছে। এমনি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় লোকসাহিত্য। এখানকার লোকসাহিত্য অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ।
এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল কাঠামো। প্রকৃতপক্ষে যে দেশ বা সমাজের লোকসাহিত্য যত উন্নত সে দেশ বা এলাকার সাধারণ সাহিত্যও তত সমৃদ্ধ।
ভিত্তি মজবুত হলে কাঠামো মজবুত ও সমৃদ্ধ হবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই যুগে যুগে এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছে। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আরও ব্যাপক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমান সাহিত্য-সংস্কৃতির যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। এ ফাঁকটুকু পূরণের লক্ষ্যেই আমাদের ঐতিহ্যসচেতন হতে হবে। এই লক্ষ্যেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছড়া ও প্রবাদ-প্রবচন সম্পর্কে নিচের সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
কৈর নাম দীনবন্ধু কৈর নাম দীনা
‘কৈ হা (খাওয়া) ঘরের বাত কৈ’ খা কিনা।
শ্রেণি বিভক্ত সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে পার্থক্য তারই প্রকাশ ঘটেছে এই ছড়াটিতে। একই নামের দুই ব্যক্তি, যার ঘরে ভাত আছে- অর্থাৎ যার আর্থিক অবস্থা ভালো সে হয় দীনবন্ধু, আর যার ঘরে ভাত নেই- অর্থাৎ যে গরিব সে হয়ে যায় দীনা। এরূপ সমাজে সাধারণ মানুষ সমাদৃত নয়। একই শ্রেণির লোকেরা সবসময় একত্রে থাকে। তাদের মধ্যেই আদান-প্রদান হয়। ধনী-দরিদ্রে কখনো মিল হয় না। আবার অবস্থার বিপাকে দরিদ্রদের মাঝেও বিচ্ছিন্নতা এসে যায়। যেমন:
আমার আছে তোমার আছে তাইও দৌড়াদৌড়ি
আমার নাই তোমার নাই যাওগা উড়াউড়ি।
স্বভাব কেউ বদলাতে পারে না। যার যেমন স্বভাব সে ঠিক তেমন কাজটিই করে। যেমন:
জাতের ধারা খ্যাতের নাড়া।
এমন অবস্থা দেখেই হয়তো কোনো এক লোককবি গেয়ে উঠলেন:
কাউয়ার বাসায় কুলি ছাও
জাত আনমান করে রাও।
মানুষ পরিবেশের ফসল। পরিমণ্ডল অনুসারেই তার
স্বভাব-চরিত্র ও জীবন গড়ে ওঠে। যেমন:
ছাটগুণে পাঠ, সমাজ গুণে নমাজ।
কথায় বলে, ‘এক ক্ষুরে মাথা মুড়ানো’। এর সঙ্গে তুলনীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি প্রবাদ:
এক গোয়ালের গরু।
অর্থাৎ একই স্বভাব ও চরিত্রের লোকেরা পাশাপাশি বিচরণ করে। আর এ স্বভাব যে মন্দ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তা প্রবাদটির ব্যবহারেই বোঝা যায়।
সীমাবদ্ধতাকে যারা অতিক্রম করতে পারে না, তাদের উদ্দেশে বলা হয়:
মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।
যোগ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্ব যদি কাউকে দেয়া হয় বা কেউ যদি তা করতে চায় তবেই বলা হয়:
কোনবা আগুনের আগুন, আবার কাডল আলি (বিচি) পোড়া।
আর সাধ্যের অতিরিক্ত যোগ্যতা যদি কেউ দেখায় তবে তার প্রতি কটূক্তিস্বরূপ বলা হয়:
জান চলে না বাড়ি বাউনবাইড়া।
যোগ্যতা ও ক্ষমতাকে অতিক্রম করা উচিত নয়। যাকে যেখানে মানায়, তার সেখানেই থাকা উচিত।
এমন জাগত বইছ, কেউ না কয় ওঠ
এমন কথা কইছ, কেউ না কয় জুট।
বোকামির জন্য অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। তখন আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যেমন:
আক্কেলে খাইছে মাডি
বাপে-পুতে কান্দাকাডি।
অথবা
আক্কেল দোষে মুখ লড়ে
ঝুলনা বাইয়া ফেন পড়ে।
এই আক্কেল দোষে অনেক সময় একূল ওকূল- দুকূলই হারাতে হয়। তখনই প্রবাদের ভাষায় বলা হয়:
হুলার (চুলা) হোলাও গেল, গাইলের হোলাও গেল।
এ অবস্থায়ই ‘উভয় সংকটে’ পড়তে হয়। যেমন:
মাইজ গাঙে চৈর (লগি) ভাঙ্গা।
‘পচা শামুকেও পা কাটে’। অর্থাৎ তুচ্ছ ব্যক্তি বা বস্তু থেকেও অনেক সময় মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। প্রভাবশালীরাও সময় ও সুযোগ মতো সাধারণের কাছে আটকা পড়ে। যেমন:
চটকা বড়িত (ছোট ছিপ) লাইগ্যা বোয়াল
ভেটকাইছে দুই গাল।
এমন অনেকে আছেন যারা আপন লোকদের পছন্দ করে না; আপনদের কোনো কিছুই তাদের কাছে ভালো বা পছন্দনীয় নয়। অন্যদের সবকিছুই তাদের কাছে প্রিয় ও শ্রেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাদে বলা হয়েছে:
বাড়ির গরু গাডার (ঘাটের) ঘাস খায় না।
অনায়াসে কিছু পাওয়া গেলে তার সঠিক মূল্যায়ন হয় না। যেমন:
মাগনা গরুর দাঁত নাই।
অযথা যারা সময় নষ্ট করে, তাদের উদ্দেশে বলা হয়ে থাকে:
আকাঁড়া চাইলের দোকানদারি।
স্বভাব সহজেই কেউ বদলাতে পারে না। যেমন:
হাইচ্ছৎ (স্বভাব) ছাড়ে না চুরে
টুন্ডা আতে হিন (সিঁদ) কুড়ে।
যোগ্যতার অতিরিক্ত ক্ষমতা যদি কেউ দেখায় বা কোনো কাজে পারদর্শী না হয়ে যদি কেউ কিছু করতে চায় তবে বিপদে পড়তে হয়। যেমন:
আবাঙাইল্যা ঘোড়া চড়ে
ধাপ্পুর ধুপ্পুর পইরা মরে।
‘আবাঙাইল্যা’ এখানে অবাঙালি নয়, আনাড়ি।
সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা নানা ছলচাতুরী ও ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চায়। যদিও শ্রেষ্ঠত্বের কোনো কিছুই তাদের মধ্যে নেই। এরা শুধু গলাবাজিতেই শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত হতে চায়। কথার আড়ম্বরে এরা নিজেদের আসল পরিচয় ঢেকে রাখে। এদের প্রতি কটূক্তি স্বরূপ বলা হয়ে থাকে :
ফেনদা ভাত খাইয়া গপ্প মারে দই
নাইরহল্যা উক্কাদা (নারিকেল টুসের হুক্কা) তামুক খাইয়া পইরচা উক্কা কই।
আর যারা নিজের আসল পরিচয় গোপন করে অন্য কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তাদের উদ্দেশে বলা হয়:
বাপ-দাদার নাম নাই, চান মোল্লার বিয়াই।
কিন্তু বড় গাছের নিচে ছোট গাছ বাড়ে না। অর্থাৎ প্রভাবশালীদের আড়ালে অনেক সময় সাধারণের সঠিক বিকাশ হয় না। যেমন:
বাগের তলে হাগও (শাক) অয় না।
যার যেটুকু আছে সেটুকু নিয়ে যদি কেউ সন্তুষ্ট না হতে পারে, যদি কৃত্রিম আবরণের দ্বারা নিজের প্রকৃত পরিচয় লুকাবার চেষ্টা করে তবে বলা হয়:
চুল নাই বেডি, চুলের লাইগ্যা কান্দে
কচু পাতার ঢিপা দিয়া মুইট্টা হুপা (খোঁপা) বান্দে।
সামর্থ্য না থাকলেও অনেকে ঠাট বজায় রাখতে চায়। সমাজে এরা হাস্যাস্পদ হয়। যেমন:
বাপের গুতে নাও নাই, টিনদা বান্দে ছৈয়া
নারায়ণগঞ্জে খ্যাপ পাইয়া লেজদা থাহে বৈয়া।
এদের প্রতি কটূক্তি স্বরূপ বলা হয়:
নিজের নাই জাগা
কুত্তা আনে ভাগা।
সময়মতো সব কিছুই করা উচিত। তা না হলে কোনো কাজই সুচারুরূপে করা যায় না। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে:
থাকতে ধরাইয়া খাও
বেইল থাকতে আইট্টা যাও।
সময়মতো কাজ না করলে পরে আক্ষেপ করতে হয়। যেমন:
আরাইয়া মুরশিদের নাম, পথে বইয়া কান্দে।
অবসর থাকলে নানা অকাজের চিন্তা মাথায় আসে। তখনই বলা হয়:
আজাইরা থাইক্যা গজাইরা গীত গায়।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই অনেক সময় অনেক কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। সুবিধাবাদীরা তখন এর কৃতিত্ব দাবি করে বসে। তাদের প্রতি টিপ্পনী স্বরূপ বলা হয়ে থাকে:
ঠাডা ফইরা বগা মরছে
ফকিরি জাহির অইছে।
অথবা
ছিকা ছিরা বিলাইর ভাইগ লাগছে।
কথায় বলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অনেক সময় সামান্য লাভের আশায় বড় রকমের বিপদে পড়তে হয়। তখন বলা হয়ে থাকে:
ভিক্ষার কাম নাই, কুত্তা সামলাও।
বুদ্ধিমানেরা সময়মতোই প্রয়োজনীয় কাজটি সেরে নেয়। যেমন:
সেয়ানের কাজ বেয়ানে।
কিন্তু সেয়ানেরা যদি ভুল করে, তবে তা কারও কাছে প্রকাশ করে না। যেমন:
সেয়ান ঠকলে বাপের কাছেও কয় না।
কথায় বলে ‘বানরের গলায় মুক্তার মালা’। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর রূপ:
দুড়া কাউয়ার (দাঁড়কাক) মুখে হিন্দুইরা আম।
অথবা
শুয়রের কপালে হিন্দুর (সিঁদুর) লাগে না।
বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি’। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক প্রবাদে এর ভাষা আরও তির্যক:
আফাট্টা কাডলের (কাঁঠাল) মুডি ডাংগর!
পর্যাপ্ত সুবিধা পাবার পরও যদি কেউ অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তখন বলা হয়; পাল পাইয়া দাঁড় বাও।
সুবিধাবাদীরা সব সময় গা বাঁচিয়ে চলে। যখন যেমন তখন তেমন চরিত্রই তারা প্রদর্শন করে। কোনোরূপ সৃজনশীলতা তাদের মধ্যে নেই। ন্যায়-অন্যায়ের ধারও তারা ধারে না। আসলে তাদের কোনো চরিত্রই নেই। প্রবাদের ভাষায় তারা:
যেদিক দিয়া সওরা (ঝোল) পড়ে, সেদিক দিয়া নলা ধরে।
ন্যায়-অন্যায় উভয়পক্ষের সঙ্গেই তারা গোপন যোগাযোগ রাখে। এরা চরম সুবিধাবাদী। প্রবাদে এদেরকে বলা হয়:
দুই মুইখ্যা সাপ।
এরা ‘দুই নাওয়ে পাও রাখে’।
এদের দ্বারা সমাজের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এরা:
চোরকে কয় চুরি করিছ, গিরছরে কয় হজাগ (সজাগ) থাহিছ।
চেষ্টা কখনো বিফলে যায় না। যেমন:
লাইগ্যা থাকলে মাইগ্যা খায় না।
বেসবুর লোকেরা প্রচুর পরিমাণে খেয়েও আরও খেতে চায়। অর্থাৎ অগাধ ধন সম্পত্তির মালিক হয়েও তারা আরও বেশি পেতে চায়। তাদের উদ্দেশে বলা হয়ে থাকে:
পেট করে টিল টিল
চোখে বলে আরো গিল।
‘পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তে যায়’। অর্থাৎ অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ভোগ করা যায় না। অসৎ পথেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়। একেই বলে:
যে নালে উৎপত্তি, সে নালেই বিনাশ।
অহংকারীরা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান করে’। তারা মনে করে টাকা হলে সবকিছুই করা যায়। তাদের দর্পভরা কথা:
ভাত ছিটাইলে কাউয়ার অভাব অয় না।
অলস ব্যক্তিরা সব সময় কাজে ফাঁকি দেয়। কিন্তু কাজের শেষ পর্যায়ে তারা অতিরিক্ত উৎসাহ দেখায়। একেই বলে:
হুতরা গোরু লাইল দেখছে।
মূল উপলক্ষের চেয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত বিষয়ে বেশি উৎসাহ দেখায় একেই বলা হয়:
আলে (হালে) আডে না গরু, হাঁতারে (সাঁতার) তেজ।
সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। যেমন:
ছাগলের পাড়ায় ধান পড়ে না।
অসময়ে কোনো কাজ করতে গেলে অনেক সময় হাস্যাস্পদ হতে হয়। যেমন:
হাই মরছে আগুনে (অগ্রহায়ণ) কোয়ান (কান্না) দিছে ফাগুনে।
মূল উপলক্ষ বাদ দিয়ে অনেকেই অতিরিক্ত আড়ম্বরে মেতে ওঠে। নকলের ছড়াছড়িতে অনেক সময় আসল ঢাকা পড়ে যায়। তখন বলা হয়,
হাইয়ের নামে লেশ নাই, দেওর চৌদ্দজন।
কোনো কাজে যদি কেউ অতিরিক্ত উৎসাহ দেখায় কিংবা অনধিকার চর্চা করে, একেই বলা হয়:
যার বিয়া তার খুজ নাই
পাড়া পড়শির ঘুম নাই।
একেই বলে ‘অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো’। এক্ষেত্রে প্রবাদের ভাষা অধিকতর তির্যক:
বাড়িওলার বাড়ি না, বার বাড়িওয়ালার ফরফরি।
হঠাৎ যদি কারো অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে তার চাল-চলন ও কথাবার্তায় সামঞ্জস্য থাকে না। যেমন:
তিন দিনের যুগি না, ভাতেরে কয় অন্ন।
তখনই বলা হয়:
কম পানির মাছ বেশি পানিত পড়লে ছরর ছরর করে।
একেই বলে:
না পাইয়া পাইছে ধন
বাপে-পুতে করে কীর্তন।
পর্যাপ্ত ধন-সম্পদের মধ্যে থেকেও যারা আরও বেশি সম্পদ আত্মসাৎ করতে চায় তাদের উদ্দেশে বলা হয়:
রাজার অয় না ধনে
কুমারের অয় না বনে (খড়ে)।
এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের একটি বহুল পঠিত কবিতার দুটো লাইন:
‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি, ভূরি
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’
প্রবাদ প্রবচন ও ছড়াগুলো অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। এগুলোর মধ্যে সামাজিক আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কার-সংস্কৃতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্যের মূল পরিচয়ও এর মধ্যে নিহিত। একই প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া বা লোককাহিনি অভিন্নভাবে অথবা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে একাধিক অঞ্চল বা দেশেও প্রচলিত আছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি গ্রন্থের নামকরণ করেছেন, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’। এর সঙ্গে তুলনীয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ:
বুড়া কালে কুড়ার ডাক।
ভারত চন্দ্র তার ‘অন্নদা মংগল’ কাব্যে লিখেছেন, ‘বাঘের বিক্রম সনম মাঘের শিশির।’ কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক প্রবাদে সেই বাঘের বিক্রম হার মানে। যেমন:
মাঘের জাড়ে বাঘ পালায়।
মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। তখন বলা হয়-
তুলা দুধে ফুলা বাঁচে না।
তথাপি যদি কেউ মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কৃত্রিম সভ্যতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে তবে তার পরিণতি ভালো হয় না।
বাঙালি মা-র সিপাই পুত
আব-আব (পানি-পানি) কইরা মইল (মরল) পুত।
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধুনিকতায় উন্নতি সম্ভব নয়। লোকসাহিত্য আধুনিক সাহিত্যের মূল। একে মজবুত করার প্রয়োজনেই ব্যাপকভাবে লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির গবেষণা ও সংগ্রহ আবশ্যক। সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্মীরা আজ নানাভাবে অবহেলিত। এই অবহেলার কারণেই তারা ব্যাপক কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছে না। অবহেলা অতীতেও ছিল, কাজের সঠিক মূল্য তারা কখনো পাননি। এ কারণেই হয়তো কোনো এক লোককবি আক্ষেপ করে বলেছিলেন:
কী কাম করলায়রে ভাই গাজির গীত গাইয়া
পাঁচসিহা রাজি করলাম, দেড়টেহা খাইয়া।
কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য ও অবিচার পরিলক্ষিত হয়। শ্রমের সঠিক মূল্য এ দেশে কোনোকালেই দেয়া হয়নি। সারাদিন পরিশ্রমের পর কেউ যদি ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে না পারে, তবেই নানা আক্ষেপের জন্ম নেয়। এরূপ অবস্থাই প্রকাশ পেয়েছে নিম্নের ছড়াটিতে:
হাইট্টা (খেটে) মরে বাপে-পুতে
ফায়দা লুডে (লোটে) নূর মোহাম্মদের পুতে।
জীবিকার সন্ধানে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায়। এরই প্রকাশ ঘটেছে নিম্নের ছড়াটিতে:
নরম বিবির খড়ম পায়
লাল বিবির জুতা পায়
বললো বিবি ঢাকা যাই
ঢাকা গিয়া টাকা চাই।
হা-ডু-ডু গ্রামবাংলার একটি প্রিয় খেলা। এই খেলাকে কেন্দ্র করে নানা ছড়ার উদ্ভব হয়েছে। যেমন:
কালিসীমার মাডি সেলাম কইরা আডি
যদি মাডি লরে কিল খাইয়া মরে।
লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ শাখা মন্ত্রশক্তি। আগের দিনে বিপদে-আপদে, দুঃখ-দুর্দশায় এই মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ হতো। এর মাধ্যমে বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধারের কাহিনিও প্রচলিত আছে। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। আসলে এটি হচ্ছে এক ধরনের ইচ্ছাশক্তি বা বিশ্বাস। এই ইচ্ছাশক্তি থেকেই বিপদ-আপদ অনেকটা কেটে যায়। প্রবাদের ভাষাতেই এর সত্যতা প্রমাণ হয়। যেমন:
বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।
যদি মনে করা হয় যে, সামনে বিপদ আছে তবেই মানসিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে যেতে হয়। এই দুর্বলতা থেকেই নানা বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি হতে পারে। আর যদি মনে সাহস থাকে, ইচ্ছাশক্তি যদি প্রবল হয়, তবে শত বাধা-বিপত্তিও অনায়াসে অতিক্রম করা যায়। এসব মন্ত্রশক্তির কাজও সেই ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত করা। এ থেকে মনের দুর্বলতা অনেকটা কেটে যায়। যেমন:
বিষ মাদাইলে কামুড় দিছে।
বাউনবাইরা আগুন লাগছে
ফজর মা ঝাইবা দিছে
বাড়িত গিয়া কইতাম না।
অর্থাৎ বিষ মান্দারের কামড়ে যে ব্যথা হয় তা আগুন লাগার মতোই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু তা যদি ভুলে থাকা যায় তবে এর ব্যথা কিছুটা হলেও লাঘব হয়।
বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ মাস। ধান কাটার মৌসুম। প্রায়ই রোদ ওঠে না। একটানা অনেক দিন পর্যন্ত বৃষ্টি হয়। কৃষকেরা ধান শুকাতে পারে না। রোদের অভাবে ধান নষ্ট হয়। এরই মধ্যে হয়তো আকাশের মেঘ কমে আসে। হঠাৎ দেখা গেল রাতের বেলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আকাশে কিছু তারা। এক মায়ের এক মেয়ে তখন রোদের জন্য আকাশের তারা বাঁধে, আর মনে মনে মন্ত্র আওড়ায়:
এক তারা বানলাম তারা
দুই তারা বানলাম তারা
তিন তারা বানলাম তারা
চাইব তারা বানলাম তারা
পাঁচ তারা বানলাম তারা
ছয় তারা বানলাম তারা
তারা তারা তারা সাত ভাই
বাইন্ধা লাইলাম বড় ভাই
মানব (মানুষ) মরে ভাতে
গোরু মরে ঘাসে
রাইত পোয়াইয়া রইদ ওঠ
কালকে দিনই হরি লুট।
মন্ত্র আওড়ায় আর নিজের আঁচলে গেরো দেয়। এ থেকে রোদ ওঠে বলে তাদের বিশ্বাস।
শীতের সকালে গ্রামের ছেলেমেয়েরা রোদের জন্য খোলা জায়গায় একত্র হয় এবং ছড়া কাটে:
রৈদ ওঠ ফাইট্টা
গুয়া (সুপারি) দিমু কাইট্টা
ঘরে ঘরে বাইট্টা।
অথবা
ছেংগা হেত (ক্ষেতে) ছেংগা ফুল
ছেং ছেংগাইয়া রৈদ ওঠ।
নিচের ছড়াটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বহুকাল থেকে প্রচলিত:
আইড় মাছের কাডাকুডা
বোয়াল মাছের দাড়ি
হুইন্যা যাগো জব্বইরার মা
কলের গান করি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ ছড়াটির নিম্নোক্ত পরিবর্তন ঘটেছে।
আইড় মাছে কাডাকুডা
বোয়াল মাছের দাড়ি
টিক্কা খান ভিক্ষা করে
শেখ মুজিবের বাড়ি।
এ পরিবর্তনটুকু নিশ্চয় কেনো লেখক বা ছড়াকারের দ্বারা হয়নি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এরূপ পরিবর্তন নিচের ছড়াটিতেও লক্ষ করা যায়:
এই পোলা, তর বাড়ি কই-নাগাইয়া
আডছ ক্যামনে-ফাগাইয়া
কান্দ (কাঁধে) কিতা-এলেমজি (এলএমজি)
মারছ কিতা-পাঞ্জাবি
টুল্লুস, টুল্লুস, টুল্লুস।
গ্রামের ছেলেরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে এই ছড়াটি বলে এবং যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে ওঠে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের মধ্য থেকে এখানে সামান্য কিছু নমুনা তুলে দেয়া হলো। এ ব্যাপারে আরও ব্যাপক আলোচনার ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : কবি, গবেষক ও সংগঠক