ক্যামেরা সব সময় সত্য কথা বলে:মানজারে হাসীন মুরাদ

শোয়াইব আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:১৫ পিএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:১৯ পিএম

মানজারে হাসীন মুরাদ। ছবি: সংগৃহীত

মানজারে হাসীন মুরাদ। ছবি: সংগৃহীত

বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের পুরোধা মানজারে হাসীন মুরাদ।

একসময় চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন কাফকার শহর প্রাগের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ‘চার্লস ইউনিভার্সিটি’তে। এরপর দেশে ফিরে শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র আন্দোলন, নিজে পুরোধা হয়ে রয়েছেন প্রামাণ্যচিত্রের বরেণ্য নির্মাতা হিসেবে।

চলচ্চিত্র দুনিয়ায় গুণী এই নির্মাতার অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে মুখোমুখি হয়েছিলেন-এহসান হায়দার

প্রথাগত চলচ্চিত্র বা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বিপরীতে বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল শুরুর দিকে আপনাদের জন্য?

মানজারে হাসীন মুরাদ: বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে আমাদের মিল ছিল না কখনো। শুরুর সময়ে আমরা যারা ছোট ছবি বানিয়েছি, তখন তো মূলত শর্টফিল্মই বানানো হতো, ৩০/৩৫ মিনিটের। এই ছবিগুলো বানাতে গিয়ে আমাদের যেসব সমস্যায় পড়তে হয়, ডিস্ট্রিবিউশন ও প্রোডাকশন নিয়ে এটা কমন ব্যাপার ছিল। এসব কারণে আমাদের যারা ছবি বানাচ্ছিলেন এবং তারা যে ধরনের ছবি বানাতে চাচ্ছিলেন সেটার সঙ্গে একটা মিল আছে শর্ট ফিল্মের। তারপর আমরা সেটাকে একটা আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এভাবেই ৮৬ সালে আমাদের একটি সংগঠন তৈরি হলো-বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম। এটা বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন হয়ে উঠেছিল এক সময়।

কত সালে বললেন?

মানজারে হাসীন মুরাদ: ১৯৮৬ সালে। আমাদের এবার ৩৬ বছর হলো। তিন যুগ। আমরা এখন পর্যন্ত ওই একই চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করছি। আপনি যদি আরও ভালো করে এটা নিয়ে বুঝতে চান, তাহলে আমাদের প্রথম ১০/১২ বছরের কাজ নিয়ে ইতিহাস নিয়ে একটা বই বেরিয়েছে। সেটা দেখতে পারেন।

আমরা তথ্যচিত্র আর প্রামাণ্যচিত্র এই দুটির মধ্যে তফাতটা যদি আলাদা করে বুঝতে চাই তাহলে সেটা কী করে বুঝব? আপনি যদি একটু বিস্তারিত বলেন... 

মানজারে হাসীন মুরাদ: নানা ধরনের কাহিনিচিত্র আছে; সাদামাটাভাবে যেটাকে আমরা বলি ‘ফিল্ম জনরা’। যেমন কমেডি বলতে হাস্যরসাত্মক ফিল্ম নির্মিত হয়। এ রকম চলচ্চিত্র অনেকে তৈরি করে এটা আইডিন্টিফাই করার জন্য যে এই ছবিটার মূল ভাবনা কী। ট্র্যাজেডিও হতে পারে, এখন সায়েন্স-ফিকশন আসছে, হরর ও থ্রিলার ছবি হয়। এগুলো দেখলে বোঝা যাবে এই ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো-কমেডি হলে কমেডি, ট্র্যাজেডি হলে ট্র্যাজেডি। এই জনরার বিষয়টি প্রামাণ্যচিত্রেও হচ্ছে।

হয়তো বলা হলো তথ্যচিত্র, এর কারণ হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রে তথ্যটাকে প্রাধান্য দেওয়া। যে দর্শক তথ্য দেখতে চায় তার কাছে তথ্যটা আরও বেশি পৌঁছাতে হবে। কোনো কোনো ছবির হয়তো এডুকেশনাল আসপেক্ট বেশি, এগুলোর মধ্য দিয়ে ইনফরমালি মানুষকে বেশি তথ্য দিয়ে শিক্ষিত করে তোলা যায়। কোনো ছবি পলিটিক্যাল হলে তাতে রাজনৈতিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে বানানো হয়। আমরা যখন ডকুমেন্টারি বলি, তখন এটার সঙ্গে আমরা বলি অকাহিনিমূলক ফিল্ম বা নন-ফিকশন, এরই একটা অংশ হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্র। যেটা যে কোনো পারপাসে হতে পারে। এটা এডুকেশনের জন্য হতে পারে, রাজনৈতিকভাবে হতে পারে, প্রোপাগান্ডা পারপাসেও হতে পারে; কিন্তু এর সঙ্গে শিল্পের একটা সম্পর্ক থাকবে।

আর অন্য ধরনের প্রামাণ্যধর্মী চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র যেখানে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অত বেশি নেই; কিন্তু সেটাও আবার দর্শকের জন্য প্রয়োজন। সেটাকে আমরা বলছি নন-ফিকশন। আমরা জানি, যে কোনো শিল্প যদিও সার্থক হয়ে ওঠে সেখানে যে তথ্যগুলো আসছে তার অভিঘাত মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সে কারণে বলছি, তথ্যসমৃদ্ধ বা এডুকেশনাল বা পলিটিক্যাল যে ছবিতে শিল্পের মাত্রাটা থাকবে সেটা ডকুমেন্টারি, অন্যগুলো নন-ফিকশন।

আচ্ছা, সবাই যখন কাহিনিচিত্রের দিকে ঝুঁকতে থাকে শুরুর দিকে, সে সময়ে আপনি শুরুতেই কি প্রামাণ্যচিত্রের দিকে আগ্রহী হলেন?

মানজারে হাসীন মুরাদ: না, আমি ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়েছি অনেক পরে। ছোটবেলা হয়তো মা-চাচিদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছি সেগুলো তো সব কাহিনিচিত্র। তখন কেবল ইনফরমেশনাল ফিল্ম বলতে একটা জিনিসই দেখা যেত। আমি পাকিস্তান আমলে জন্মগ্রহণ করেছি। তখন একটা ফিল্ম ছিল‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর’। ১০/১৫ মিনিটের মতো হতো, অনেকটা প্রোপাগান্ডাচিত্রের মতো। সেখানে সরকারি কর্মকাণ্ড, সমাজ, রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে এক ধরনের ইনফরমেশন দেওয়া হতো। দেশ সম্পর্কে অবগত করার জন্য দেখানো হতো সাধারণ লোকজনকে।

সেটা কি প্রতিবেদনের মতো ছিল?

মানজারে হাসীন মুরাদ: হ্যাঁ, এখন যেটাকে প্রতিবেদন বলা হয় সেরকম ছিল। এখনো বাংলাদেশে আছে এমন। সেগুলো অনেকটা ছিল প্রামাণ্যচিত্র। যে কোনো কাহিনিচিত্রের শুরুতে সিনেমা হলে এগুলো দেখানো হতো। আমার তো চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ শুরু হয় স্বাধীনতার পর পর। যদিও এর আগে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষত আন্দোলনের সময় ১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখেছি অনেকবার। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সেই সিনেমা অনেকে দেখেছেন।

আমরা যখন ৭২ সালে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি তখন আমরা দেশ-বিদেশের ছবি যেগুলোকে আমরা শিল্পমানের ছবি বলছি সেটা দেখানো হতো। চলচ্চিত্র সংসদগুলোতে একটা পক্ষপাত ছিল কাহিনিচিত্রের প্রতি। সংসদগুলোতে যদি ১০০টা সিনেমা স্ক্রিনিং হতো এক বছরে, সেখানে হয়তো একটি-দুটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হতো। তারপর যেটা হয়েছে আমাদের দেশে মানুষ চলচ্চিত্র বলতেই কাহিনিচিত্র বোঝে। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমি প্রথম কিছু প্রামাণ্যচিত্র দেখি।

বেশিরভাগই বিদেশি। বাংলাদেশি প্রামাণ্যচিত্র বলতে গেলে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখি। যেটা আমাকে অভিভূত করে। ছবি এমনও হতে পারে তাহলে, যেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়া একটা গল্প! যেটা জাতীয় জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, মানুষকে ভাবাতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে। এরপর থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর একটা সুযোগ হয় আমার, যখন বিদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে যাই তখন আমাদের নানান ধরনের ছবি দেখানো হতো, তার মধ্যে প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হতো।

ভাবতে থাকি আমাদের দেশে তো শুধু কাহিনিচিত্রই হয়, তবুও ভালো মানের হয় না। ভালো কাহিনিচিত্র আমি খুবই কম পেয়েছি। এই ধারাটা বাংলাদেশে একেবারে প্রায় অস্তিত্বহীন। তারপর যখন ফেরত আসি তখন আমার মনের মধ্যে ভাবনা এই ধারাটা যদি শুরু করা যায়। এভাবে আমি প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি আগ্রহ হয়েছি। চেষ্টা করেছি নিজে কিছু বানাতে আর অন্যরা যারা আগ্রহী তাদের বানানো সম্পর্কে আরও আগ্রহী করে তোলা। পাঠদানের মাধ্যমে তাদের কাজে কিছুটা সাহায্য করা। 

প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সেই অর্থের জোগান কীভাবে হয়, আপনিই সম্ভবত এই ধারাতে শুরুর দিকে কাজ শুরু করেছেন-

মানজারে হাসীন মুরাদ: না, আমি একা না, আমাদের জেনারেশন যদি বলি, প্রামাণ্যচিত্রে একই সঙ্গে তারেক মাসুদ কাজ করেছেন। তানভীর মোকাম্মেল কিছুটা কাজ করেছেন। আমাদের আগে সৈয়দ বজলে হোসেন কাজ করেছেন-জহির রায়হান তো আছেনই। প্রামাণ্যচিত্র আমাদের এখানে এত জনপ্রিয় ছিল না। তাছাড়া হলেও দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। তখন ধরুন ৮০ কিংবা ৯০-এর দশকে টেলিভিশন বলতে কেবল বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল। এটা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, সুতরাং সরকার যে বিষয়গুলো জনগণের নজরে আনতে চান না-তখন সেগুলো দেখানো হয়নি।

কিছু ভালো ছবি তৈরি হলেও সেগুলো দেখানো হয়নি, দর্শক দেখতে পারেনি। আর অর্থের কথা বললেন। অর্থটা কাহিনিচিত্রই হোক আর প্রামাণ্যচিত্র হোক আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, অর্থ কিছু লাগে। কত লাগবে যদি সেখানে আপনি কী বিষয় নিয়ে বানাবেন, কীভাবে বানাবেন, আপনি সেখান থেকে কত মুনাফা করতে চান-এসব বিষয় জড়িত থাকে। 

আমি আরেকটু স্পষ্ট করে যদি বলি, আমাদের দেশে কাহিনিচিত্রে তো প্রযোজকরা অর্থ দেন, প্রামাণ্যচিত্রেও কি সেই রকম প্রযোজক পাওয়া যায়, মানে প্রযোজনা করতে আগ্রহী হন? 

মানজারে হাসীন মুরাদ: যাদেরকে আমরা প্রযোজক বলি প্রথাগতভাবে তাদের মধ্যে কেউ এই ধারায় অর্থ লগ্নি করতে আগ্রহী না; কিন্তু ধরেন আমাদের দেশে কিছু সামাজিক সংগঠন আছে, কিছু উন্নয়নমূলক সংগঠন আছে যাদের আমরা এনজিও বলি, এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকে।

আচ্ছা, কিন্তু আমি যতটুকু শুনেছি তারা যেসব প্রামাণ্যচিত্রে লগ্নি করেন-সেগুলোতে তাদের চাহিদা থাকে, তাদের মতো কাজ করতে হবে। আপনি যখন নিজে স্ক্রিপ্ট জমা দিচ্ছেন সেটা দেখে কতটুকু আগ্রহী হয় এনজিওগুলো?

মানজারে হাসীন মুরাদ: এটা এক কথায় বলা যাবে না। আগ্রহী, আবার আগ্রহী না এটাও বলা যাবে না। দু-রকমই আছে। এখন যেটা হয়-সরকার যদি লগ্নি করে, তাহলে তারা চায় তাদের প্রচার, তাদের গুণগান করা। মানুষ যেন সেটা শুনে তাদের পক্ষে তাদের সাপোর্টার হয়ে ওঠে বা তাদের সহযোগী হয়ে ওঠে। আমি যদি অন্যভাবে বলি, মনে করুন কোনো একটা অ্যাড ফিল্ম বানানো হলো, তাহলে কাজটা কী?

যে টাকা লগ্নি করে সে চায় অ্যাডের মধ্য দিয়ে মানুষজনের কাছে এই ইনফরমেশন পৌঁছানো যে, তার পণ্য সবচেয়ে ভালো। সুতরাং এটা বলা মুশকিল কেউ কোনো উদ্দেশ্য ব্যতীত চলচ্চিত্রে অর্থ বিনিয়োগ করবে। ধরেন আমাদের দেশে নারীর উন্নয়ন এখনো পিছিয়ে আছে-এখন একটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। তাদের নিজস্ব কিছু বিষয় আছে হতে পারে নারীর সামাজিক অবস্থা।

তারা হয়তো একটা ‘প্রেসক্রিপশন’ করে এইভাবে যদি কাজ করা যায় তাহলে নারীর উন্নয়ন হবে। এখন সেখানে যদি আপনি এমন কিছু ক্যারেক্টার বের করতে পারেন যারা খুবই উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে, তারা তাদের জীবন দিয়ে-কর্ম দিয়ে, সংগ্রাম দিয়ে-নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং আরও কয়েকজনকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন বা তারা নিজেদের জীবনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে।

আপনি যদি একটা দেশকে জানতে চান তাহলে সেদেশের ইতিহাস জানবেন তাই তো? একটা এনজিও নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে, তাকে আপনি যদি বলেন আপনারা তো নারী উন্নয়ন নিয়ে কাজ করেন আপনাদের যারা ক্লায়েন্ট হবে-তাদের জানানো দরকার আপনাদের ইতিহাসটা। তখন হয়তো তারা দেখল কথাটা তো ঠিক। একটা নারীকে উদ্বুদ্ধ করতে গেলে আরেকজন নারীর সংগ্রামের কথা বলা উচিত। এই ভূমিকাগুলো তাদেরও কাজে লাগবে। আবার সামাজিকভাবে আমি যদি একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চাই সেটারও কাজে লাগবে।

এখন আমরা নির্মাতারা এভাবে যদি বোঝাতে পারি, তাতে একেবারে যে হয় না তা না। আমি নিজেও কিছু এমন ছবি তৈরি করেছি। আমি তাদের বুঝিয়েছি এই কাজটা আপনাদেরও কাজে লাগবে আবার আমিও একটা ভালো ফিল্ম বানানোর চেষ্টা করলাম। 

আচ্ছা নিজের চাহিদাটাও পূর্ণ হবে...

মানজারে হাসীন মুরাদ: তাছাড়া বিদেশ থেকে নানান ফান্ড আমরা পাই নানা ইস্যুতে, থাক নাহ্।

আয়োডিনের অভাব নিয়ে একসময় খুব প্রচার ছিল এনজিওগুলোর মধ্যে। এটা সম্ভবত ৮০-এর শেষ দিক থেকে ৯০ দশকের শুরুর দিকটার কথা বলছি। এরপর টিউবারকুলোসিস নিয়ে যে সমস্যা ছিল, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে। তারপর ল্যাট্রিন/পাকা পায়খানা নিয়ে সচেতনতা। এরপর গণশিক্ষা বিষয়ক কাজ-এগুলোর সঙ্গে আপনি ওই সময় কাজ করেছিলেন বা সম্পৃক্ত ছিলেন?

মানজারে হাসীন মুরাদ: না, আমি এ ধরনের কাজের সঙ্গে ছিলাম না। যে কোনো কারণেই হোক এ ধরনের প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমি কাজ করিনি। আমি বলছি না যে এগুলো নিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না! অবশ্যই যাবে। এগুলো হচ্ছে সোশ্যাল ইস্যু। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী কখনোই ছিলাম না। 

এ ধরনের কাজ এনজিওগুলো করায়। সরকারেরও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও এ কাজগুলো করানো হয় আমি যতটুকু জানি...

মানজারে হাসীন মুরাদ: বেশিরভাগ এনজিও হয়তো এ ধরনের কাজ করায়। এর বাইরেও আছে কিছু এনজিও যারা বিভিন্ন কাজ করায়। আর যেটা বললাম ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড তো আসছে। আমি নিজে এ রকম তিনটা ছবি বানিয়েছি যেগুলো ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডে তৈরি। তো সেখানে আমাদের অ্যাপ্রোচ করা হয়েছে এই বিষয়ে-তুমি যদি কোনো সিনেমা তৈরি করতে চাও, তাহলে তুমি আমাদের প্রোপোজাল দিতে পারো। আমি শেষ যে ছবিটা বানিয়েছি সেটাতে কানাডিয়ান সরকার জড়িত আছে। তো ওরা সাউথ এশিয়ায় পাঁচটি দেশ, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা আর নেপালে একটা করে সিনেমা বানাবে।

মূল বিষয়টা ছিল-জাস্টিস অ্যান্ড পিপলস মুভমেন্ট। একেক দেশে একেক রকম বানিয়েছে। আমি বানিয়েছি আমাদের গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে-তাদের, বিচার হওয়া দরকার। বিচারটা কী হবে সেটা তো আর আমাদের কাজ না, আমরা মানুষজন বলতে পারি এ ধরনের বিচার হলে ঠিক হবে; কিন্তু কাজটা তো রাষ্ট্রের। বিচারব্যবস্থাই বলবে তাদের বিচার কী হবে। সেখানে কিন্তু ক্রাইটেরিয়া থাকতে পারে। ‘পৃথিবীর অনেক দেশে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নেই; কিন্তু আমাদের দেশে আছে। তাহলে কেউ যদি বলে মুক্তিযুদ্ধে যারা এসব নোংরা কাজ করেছে তাদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দেওয়া দরকার। বলতে পারেন যে আমি ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট পছন্দ করি না। তবুও যেহেতু ল অব দ্য ল্যান্ড এটা পারমিট করে সেটা আমি চাইতে পারি। দেবে কি দেবে না সেটা তো বিচার ব্যবস্থার বিষয়।’

তারা যখন আমাকে প্রপোজাল দিলো তখন আমি তাদের বললাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা মানুষের বিপক্ষে ছিল তাদের আমরা প্রোপার জাস্টিসে আনিনি। আমি প্রপোজালটা দিলাম। ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি আপনার মনে আছে কি না ইন্ডিয়ার মারুতি কারখানাতে একটা বিশাল অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, যেখানে ৩০০ জনের মতো মারা গিয়েছিল। তারা ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়নি এবং এটা যে তাদের ম্যানেজমেন্টের কারণে অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারণে হয়েছে এটাও স্বীকার করেনি। তখন এটা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। আমাদের যে সহকর্মী এটা নিয়ে ছবি বানিয়েছে, সে কিন্তু মারুতির ওই ইস্যুটা নিয়েই ছবি বানিয়েছে।

যেহেতু এটা একটা জাস্টিস ইস্যু। বাইরে থেকে যদি আমরা ফান্ড পাই বা দিয়ে বলে এই বিষয়ে ছবি বানান, বাকি স্বাধীনতা আপনার, সেভাবেও হয়। আবার যদি আপনি তেমন প্রযোজক পান যিনি আপনাকে ওইভাবে স্বাধীনতাটা দেবে-কেউ তো আর এমনি এমনি স্বাধীনতা দেবে না। যে কোনো মাধ্যমে আদায় করে নিতে হয়; যুক্তি, সংগ্রাম বা আন্দোলনের মাধ্যমে। 

সাধারণ মানুষের কাছে তো তথ্যচিত্র/প্রামাণ্যচিত্র এই বিষয়গুলো তেমন পরিচিত বা জনপ্রিয় না। চলচ্চিত্র বলতে বোঝায় কাহিনিচিত্র। ঢাকার কিছু মানুষ হয়তো দেখে বা সচেতন মানুষেরা দেখেন। গবেষকরা দেখেন আবার কিছু মানুষ ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী হয় এ ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে; কিন্তু ঢাকার বাইরে যখন আপনি যান আপনার চলচ্চিত্র নিয়েসেক্ষেত্রে আপনি কীভাবে দেখান, সেমিনারের মাধ্যমে নাকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক?

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমাদের চলচ্চিত্র যেহেতু সিনেমা হলে দেখানো হয় না, তখন আমাদের কী করতে হয়েছে-আমরা ধরুন ঢাকায় পাবলিক লাইব্রেরি, শিল্পকলা একাডেমি ভাড়া নিয়েছি সেখানে দেখিয়েছি। ঢাকার বাইরে গেলে স্কুল-কলেজগুলোর অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে সেখানে দেখিয়েছি। 

আরেকটা বিষয় স্পষ্ট করি, আমি যেটা দেখেছি আমাদের স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা অনেক সময় এসব বিষয় দেখাতে দিতে চান না সরকারি চিঠি না পেলে। সেক্ষেত্রে...

মানজারে হাসীন মুরাদ: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যদি এমন হয় তখন তাদের দেখাতে হয়, বোঝাতে হয় যে এটা দেখলে ছেলেমেয়েরা উপকৃত হবে, কিছু শিখতে পারবে। আমাদের দেশে মনে করা হয় সিনেমা মানে হচ্ছে শুধুই বিনোদন। এখন সিনেমাকে যারা মিডিয়াম অব এন্টারটেইনমেন্ট মনে করে, তারা কী চাইবে? তারা চাইবে একটা ভালো গল্প, ভালো কিছু চরিত্র আর এক ধরনের যৌনতা, হাসি-ঠাট্টা; কিন্তু সিনেমাও যে একটা বইয়ের মতো আপনাকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। আপনি একটা বই পড়ে বললেন আপনি আনন্দ পেয়েছেন। 

এখন এতে কি বুঝব বইটা পড়ে যে তৃপ্তি বা ক্ষুধা সেটা আপনার মিটেছে। এখন ভালো ছবি, কাহিনিচিত্র হোক বা প্রামাণ্যচিত্র আপনাকে শুধু বিনোদনই দেয় না। দিলেও সেটার মাত্রাটা ভিন্ন। একটা পথ হচ্ছে বেশি করে তাদেরকে দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া। আরেকটা পথ হচ্ছে বোঝানো-যারা নীতি-নির্ধারক হোন তারা যদি বোঝেন,-তবে বিষয়টি সহজ হয়। আমার একটা সিনেমা আছে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে। এখন বেগম রোকেয়ার পরিচিত ও তার অবদান সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষজন সবাই কমবেশি জানে।

যখন বলা হয়েছে বেগম রোকেয়ার জীবন-ভিত্তিক একটি ছবি তখন বেশিরভাগ মানুষ এটা দেখতে আগ্রহী হয়েছে, শিক্ষকরাও এটা দেখেছেন। তখন এটা অনেকভাবে দেখানো হয়েছে, এমনকি আমরা রাতের বেলা মাঠে পর্যন্ত এটা দেখিয়েছি। এই যে অবস্থাটা বললাম, এটা হচ্ছে চলচ্চিত্রের একটা বাণিজ্যিক কাঠামোর ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সবসময় একটা নেগোসিয়েশন ও সংগ্রামের ব্যাপার থাকে। কখনো আমরা সফল হয়েছি। কখনো আমরা সংগ্রাম করে গিয়েছি। 

আপনার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে যদি কিছু বলতেন-

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমি তো ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম দেশের বাইরে। আমাদের কোর্স চলাকালে কিছু সিনেমা বানাতে হতো, আবার কোর্স শেষে ডিপ্লোমা করতে হতো। পিএইচডি করতে গিয়ে যেমন থিসিস পেপার লিখে জমা দেন, আমাদেরও তেমন। আমি যেখানে ছিলাম সেখানে বাংলা ভাষার তেমন চর্চা ছিল না। চেক প্রজাতন্ত্রে একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ‘চার্লস ইউনিভার্সিটি’ নামে। 

প্রাগে এটা, প্রাগ কাফকার শহর। এই শহরেই কাফকা বেড়ে উঠেছিলেন। 

মানজারে হাসীন মুরাদ: ওখানে এক ভদ্রলোক ছিলেন তিনি অনেকগুলো ভাষা জানতেন। হিন্দি, উর্দু, বাংলা জানতেন, সংস্কৃত ভাষা জানতেন। জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথসহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই অনুবাদ করেছিলেন। তিনি প্রাগে বাংলা পড়াতেন। আমি তাকে নিয়ে একটা ছবি বানিয়েছিলাম, ছোট পোর্ট্রেটের মতো। ডিপ্লোমা ছিল আর ওটাই আমার প্রথম ছবি।  

দেশে এসে কাজ শুরু করেন কত সালে আর তারপর এখন কেমন কাজ করছেন? 

মানজারে হাসীন মুরাদ: দেশে এসে আমি প্রামাণ্যধর্মী কাজ শুরু করি। ৮৮ সালে আমি দেশে এসেছি প্রথম। ৮৯ সালে প্রথম আমি কাজ শুরু করি যেটা ছিল সুফিয়া কামালের জীবনীভিত্তিক কাজ; কিন্তু সেটা আমি শেষ করতে পারিনি। অনেক সময় লেগেছে। ২০০৫ সালে এসে সেই সিনেমাটা শেষ হয়েছে আমার। এর বাইরে আমি অ্যাড ফিল্ম বানাতাম। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে আমি অ্যাড ফিল্ম বানানো ছেড়ে দিয়ে আমি প্রামাণ্যচিত্র আর প্রামাণ্যধর্মী চলচ্চিত্র বানানো শুরু করি। এখনো সেটাই করছি। 

দেশের বাইরে আপনার প্রামাণ্যধর্মী চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে কোন কোন দেশে?

মানজারে হাসীন মুরাদ: বেশ কিছু জায়গায়-জাপান, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা, আমেরিকা, নেপালসহ আরও বেশকিছু জায়গায় হয়েছে। 

আপনার ছেলেবেলার দিনগুলো নিয়ে বা ওই সময় নিয়ে কোনো ভাবনা রয়েছে কি, যা আপনার কাজের মধ্যে আসতে পারে কিংবা আপনার ইচ্ছে রয়েছে?

মানজারে হাসীন মুরাদ: না, ব্যক্তিগতভাবে আত্মজৈবনিক কোনো ছবি বানানোর কোনো ইচ্ছে নেই। তবে কোনো সাহিত্যিক বা লেখকই হোক না কেন- তাদের কাজের মধ্যে কিছু কিছু আত্মজৈবনিক জিনিস চলেই আসে। সে রকমভাবে হয়তো কোথাও কোনো কিছু না কিছু এসেছে, তবে আমি নিজেকে একটা প্রোটাগনিস্টের জায়গায় দাঁড় করিয়ে কোনো ছবি বানাব না। 

আমি ওই রকম বলিনি, আপনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন সেই সময়টাকে নিয়ে যদি বা আপনার চারপাশের পরিবেশ নিয়ে... আপনি ছেলেবেলা যেমন দেখেছেন-

মানজারে হাসীন মুরাদ: আচ্ছা, সেটা হচ্ছে রোকেয়ার উপর আমি যে সিনেমাটা বানিয়েছি সেটায় কিছু দৃশ্য এসেছে। রোকেয়ার বাড়ি রংপুর আর আমার বাড়িও রংপুর। সেখানকার কিছু দৃশ্যে হয়তো রংপুরের জীবনযাপনের চিত্র এসেছে। গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে আমি যখন সিনেমা বানিয়েছি সেটাতেও এসেছে, যেহেতু আমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

বাংলাদেশে মূলধারার চলচ্চিত্র বলতে যেটা বলা হয়, আমি যেটা বুঝি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কথা। এটার বর্তমান যে অবস্থা সেই অবস্থান থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আপনি দেখেন? প্রামাণ্যচিত্রের অবস্থার অনেক তো উন্নতি হয়েছে মানুষজন এখন চেনে; কিন্তু সেটার যে অবস্থা ছিল তার থেকে ক্রমশ নিচের দিকে যাচ্ছে...

মানজারে হাসীন মুরাদ: যে কোনো কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব যদি আপনার নিয়ত ঠিক থাকে। এগুলো তো সবই মনুষ্য সৃষ্টি। সুতরাং যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় বা সামাজিক ক্ষমতায় আছে তারা এটাকে এভাবে তৈরি করেছে। একটা কথা আমি সরাসরি বলবএকটা জিনিস যদি পচে যায় তখন আর সেটা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমাদের দেশে যেটা হয়েছে, মূলধারা-আমি বলি বাণিজ্যিক ধারা। কারণ মূলধারা বললে আপনার একটা ভুল ধারণা হবে। এটা তো চলচ্চিত্র না। এটায় চলচ্চিত্রের কিছু উপাদান আছে, যে উপাদানগুলো... মনে করুন একটা মানুষের ছবি তুললেন। তখন একজন মানুষের ছবিই দেখবেন। তার জন্য বলা হয় ক্যামেরা সব সময় সত্য কথা বলে। যদি না আপনি তাকে মিথ্যা কথা বলান। আমাদের দেশে শুরুতে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র... তখন তো আর অন্য কোনো চলচ্চিত্র ছিল না।

১৯৪৭ সালের পর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র দেখেন, শুরুটা কিন্তু খারাপ ছিল না। ওই অর্থে নোংরামিও ছিল না, অবাস্তবতাও ছিল না, একটা সাধারণ জীবনকে তখন খুব সুন্দর করে চেনা যেত। তারপর এখানে একটা সমস্যা হলো-মূলত ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে। তাদের হয়তো ভালো অভিনেতা, কারিগরি বিষয়ে দক্ষতা বা নতুন দেশে যে ধরনের মানসিকতার মানুষ থাকা দরকার তা ছিল। এ ছাড়া শরীর প্রদর্শন বা যৌন আবেদনটাও তাদের জন্য সহজ ছিল।

প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সেটা যখন অনুকরণ করা শুরু হলো এদেশে, তখন ওইরকম হলো।এরপর পাক-ভারত যুদ্ধের পর বিদেশি কোনো ছবি বাংলাদেশে দেখানো যেত না। প্রটেকশনে নেওয়া হলো। তার মানে কী... আপনি ব্যবসা করছেন; কিন্তু আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সাধারণত এটা হলে আপনি কী করবেন? ওই সুযোগটা নিয়ে আপনার প্রোডাক্টটাকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করবেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে যারা ফিল্মে এসেছেন তারা তখন মনে করেছে আমার তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, আমি যা দেব দর্শক তাই দেখতে বাধ্য। 

সেই সময়ের ১২/১৩শ সিনেমাহল থেকে এখন দুইশ-আড়াইশ সিনেমাহলে এসে ঠেকেছে। এই সিনেমাহলও তো বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে-

মানজারে হাসীন মুরাদ: হ্যাঁ, আপনি সিনেমাহলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখবেন, তার চেয়ে ইউটিউবে একটা সিনেমা দেখবেন এটা আরও বেটার! তারপর পরিবেশ, যাতায়াত একটা ব্যাপার তো আছেই।

আমি না হয় ইউটিউবে দেখলাম, বাংলাদেশের অন্য মানুষরা তো ইউটিউবে দেখতে পারছে না, বিশেষত যারা গ্রামে থাকেন- 

মানজারে হাসীন মুরাদ: হ্যাঁ, যারা গ্রামে থাকে-তারা সিনেমা দেখছে টেলিভিশনে এবং তারা এই সময়ের সিনেমা দেখে না, তারা দেখে একদম শুরুর দিককার সিনেমা। সুতরাং বাংলাদেশের লোকজন সিনেমা দেখে না তা নয় একেবারে। নানানভাবেই দেখে, কেউ হয়তো ইউটিউবে দেখে, কেউ হয়তো টেলিভিশনে দেখে, কেউ হয়তো সিনেমাহলে দেখে। 

হলে গিয়ে সিনেমা দেখার যে একটা রীতি-ঐতিহ্য এটা তো বন্ধের পথে, ধীরে ধীরে কি এটা বন্ধই হয়ে যাবে?

মানজারে হাসীন মুরাদ: আন্তর্জাতিকভাবেও কিন্তু ঘটনাটা একই রকম। ষাটের দশকে যখন টেলিভিশন আসলো তখন হলমুখী দর্শকের সংখ্যা কমতে শুরু করে। সিনেমাহলে যাওয়ার পেছনে তো কতকগুলো উদ্দেশ্য থাকে একটা হচ্ছে যে, সিনেমাহলে যাবেন, অনেকে মিলে দেখবেন; কিন্তু সিনেমাহলে তো আপনি সবাইকে চেনেন না-এমন পরিবেশে যদি টিকিট কিনতে আপনাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, দশ টাকার টিকিট ১০০ টাকায় কিনতে হয়, তারপরে আমার গরমের মধ্যে ঘামতে থাকেন-তার চেয়ে বাসায় টেলিভিশনে দেখানো হলে আপনি রিল্যাক্স হয়ে দেখছেন। সুতরাং আস্তে আস্তে সিনেমাহলে যাওয়া কমতে শুরু করেছে।

আবার একটা প্রশ্ন থেকে যায় সিনেমা কি ছোটপর্দায় সবটুকু বোঝা যায়? ওই অর্থে সিনেমার যে কারিগরি দিক, নান্দনিক দিক-এটা ছোটপর্দায় বোঝা যায়? আগে যখন বড়পর্দায় দেখানো হতো তখন তার একটা নান্দনিকতা ছিল এখন যখন ছোটপর্দায় চলে এসেছে আপনাকে কষ্ট করে দেখতে হয়। আবার হলের সমস্যাগুলোও প্রকটতর হচ্ছে, ফলে মানুষ হলের চেয়ে ঘরে বসে সিনেমা দেখে স্বস্তি পাচ্ছে।

তাহলে বলা যায় সিনেমাহলের এক সময় বিলুপ্তি ঘটবে?

মানজারে হাসীন মুরাদ: আবার কিছু হয়তো থাকবে, সিলেক্টিভ কিছু সিনেমাহল। বাইরে হচ্ছে না... ভালো ভালো সিনেমাহল। ৫০ সিটের সিনেমাহল, যেখানকার চেয়ার দেখলে আপনি ঘাবড়ে যাবেন। চেয়ার এমন যে একটা অফিসের চিফ-বস বসে এমন। 

আচ্ছা আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সরকারি অনুদানে এখন সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। কাহিনিচিত্রের মতো প্রামাণ্যচিত্রেও এমন অনুদান থাকে কী?

মানজারে হাসীন মুরাদ: নানান ধরনের দেন-দরবার, আন্দোলন, সেমিনারের মাধ্যমে আমরা সরকারকে বোঝাতে পেরেছিলাম যৌক্তিকতা। তখন থেকে কাহিনিচিত্রের পাশাপাশি প্রামাণ্যচিত্রেও অনুদান দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়টা একটা বড় আকারে পরিবর্তন ঘটেছে। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে অনুদান কথাটা কিন্তু চালু করা হয়েছিল কেবল শিল্পসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের জন্য, বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য নয়। এখন দেখা যাচ্ছে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র সেই অর্থে প্রযোজক পাচ্ছে না, তারাও কিন্তু সরকারের কাছে দাবি করছে তাদেরও অনুদান দেওয়া হোক। চলচ্চিত্রের যে কোনো ধারাতেই অনুদান দেওয়া উচিত। পরিমাণে কমবেশি হতে পারে কিন্তু সবধরনের চলচ্চিত্রকেই অনুদান দিতে হবে। আর প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে এর দর্শক সবসময়ই কম।

আপনি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়বেন সেটা যত সহজে বুঝবেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই তত সহজে বুঝবেন না, তার জন্য আপনি কি বলবেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কম শক্তিশালী লেখক বা হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ছোট? বিষয়টা এমনই। আপনার মতো সহজ করেই বলতে চাচ্ছি বিগত বছরগুলোতে সরকারদলীয় সংগঠনের লোকজনরা অনুদান পেয়ে যাচ্ছেন এবং এমনও লোকজন পাচ্ছে যাদের নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমাদের দেশের রাজনীতিতে তো স্বজনপ্রীতি আছেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমাজের অন্যান্য স্তরেও যখন এসব চালু হয়। ফিল্ম তো এর বাইরের কিছু নয়, এটাই স্বাভাবিক। যারা এটার দায়িত্বে আছেন তারা যদি এই ব্যাপারে সচেতন না থাকেন আর তাদের উপর যদি কোনো চাপ সৃষ্টি না করা হয় তাহলে তাদের যেটা ইচ্ছে হয় সেটা তারা করবে। আমার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কতটুকু সফল হব, বলতে পারছি না। 

ফিল্মমেকারদের মধ্যে কারও কারও সরকার পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, যারা সুনাম অর্জন করেছেন তারাও এর পেছনে আছেন কিনা?

মানজারে হাসীন মুরাদ: অবশ্যই, তারা মনে করে তারা পেলেই হলো, বাকিদের দরকার নেই। এসবের জন্য গত মাসেও আমরা শাহবাগে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন করেছি। তাতে আমাদের বলা হয়েছে আমরা শেখ হাসিনা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি। প্রত্যেকটি আন্দোলনে বিরোধীদলীয় কয়েকজন থাকে যারা আপনাকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করবে। আমরা যদি একত্রিত হই তাহলে হয়তো পরিবর্তন হতে পারে।

এমনও তো হতে পারে এমন চলতে চলতে দেখা গেল একসময় অনুদানই বন্ধ হয়ে গেল। 

মানজারে হাসীন মুরাদ: হুম, বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বর্তমান যে অবস্থা এর চেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো। কয়েক দিন আগে আপনিও দেখেছেন হয়তো এক অভিনেত্রী ও আরেকজন প্রযোজক-দুজনই নারী। তাদের বাগ্বিতণ্ডা আমরা শুনলাম, পরিচালক বলছে সরকার থেকে ৭০/৬৫ লাখ টাকা পেয়েছে সেখান থেকে কিছু টাকা খরচ করা হয়েছে। আবার অভিনেত্রী বলছে আমাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা ছিল সেটাও দেওয়া হয়নি। এগুলো হয় কী করে? সরকার তো একটা তদন্ত কমিটি করতে পারত, সেটা তো করল না। সরকার কারো না কারো প্রতি তো নমনীয়। 

গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন চলার সময়ের ঘটনা-এক জন ছড়া জাতীয় কিছু লিখতেন। তাকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়-তিনি সিনেমা দেখেন না কিন্তু সেন্সরবোর্ডে আছেন। একপ্রকার সরকারদলীয় প্রভাবে। এই বিষয়গুলো হতে থাকলে তো শিল্প-সংস্কৃতি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমি চিনি তাকে। এসব তো অহরহ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দেন-দরবার করে কোনো লাভ হবে না। এর বিরুদ্ধে শক্ত করে প্রতিবাদ করতে হবে এবং এটাকে প্রতিবাদে রাখতে হবে। 

এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। আগে থেকেই তো সরকারের প্রতিষ্ঠান আছেই। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নির্মাণে কারিগরি ব্যাপারগুলো কতটুকু এগিয়েছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কতটুকু এগিয়েছে। একটা কাজ করতে হলে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে না, এটা কতটুকু কমেছে? 

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমাদের দেশে সাধারণ মানের প্রযুক্তি দিয়েই সিনেমা নির্মাণ অসম্ভব কিছু নয়। সবকিছুরই একটা চর্চার ও ক্রিয়েটিভিটির প্রশ্ন আছে। চর্চাটা চালু না 

থাকলে প্রাথমিক স্তরে থাকবেই। আমাদের দেশে আগে কখনো টেলিভিশন বা চলচ্চিত্র শিক্ষা চালু ছিল না প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। এখন যেহেতু হয়েছে এটা অবশ্য ভালো। সমাজের সুধীমহল মনে করছেন সিনেমা শিক্ষার প্রয়োজন আছে। আগে তো মনে করা হতো সিনেমাতে আবার কী শেখার আছে? এখন এই জিনিসটা কমে এসেছে।

সমস্যা হচ্ছে পাঠ্যক্রমের কোনো সামঞ্জস্য নেই। একটা ভার্সিটির সঙ্গে আরেকটা ভার্সিটির মিল নেই। দেখা গেল ঢাবিতে যা পড়ানো হয় জাবিতে তা পড়ানো হয় না। এর বড় কারণ প্রতিটা প্রতিষ্ঠান মনে করছে আমি যেটা করছি সেটাই বোধহয় ঠিক।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাদের নিজস্ব কোনো কারিগরি অবকাঠামো নেই। আপনি সমাজবিজ্ঞান পড়তে পারেন কারিগরি অবকাঠামো ছাড়া; কিন্তু ফলিত রসায়ন পড়তে পারবেন না ল্যাব ছাড়া, তফাতটা এখানেই। পাঠদানের জন্য জরুরি সবকিছু যুক্ত করতে হবে। 

‘স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা’ এই টার্মটা বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে ২০০০ সালের পর থেকে। এটায় কতখানি স্বাধীনতা রয়েছে আর একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা কিছু নির্মাণ করলেন নিজ খরচে; কিন্তু উনার সেন্সর, প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তো বাধা আছে। সেক্ষেত্রে কী হয়? 

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমরা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিশ্বজুড়েই এই বিভাজনটা আছে। একটা শ্রেণির চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বা একটা শ্রেণির বিনোদনের কথা চিন্তা করে। মানুষজনকে কেবল বিনোদন দেওয়া মানে হলো আপনি ভালো রসগোল্লা খেলেন, স্বাদ পেলেন ভুলে গেলেন। সেখান থেকে আপনার নতুন কোনো ভাবনা আসলো না। আরেক ধরনের চলচ্চিত্র হচ্ছে যেটা পার্টিসিপেশনের মতো। সেখানে আপনার চিন্তাভাবনার সঙ্গে নির্মাতাদের চিন্তাভাবনার একটা মিল ঘটাতে পারবেন। এতে দুই পক্ষেরই লাভ হতে পারে। যিনি বানিয়েছেন ইনিও লাভবান হবেন আর যিনি দেখছেন তিনি তো হবেনই। এই ধরনের সিনেমাকে আমরা বলছি স্বাধীন সিনেমা। স্বাধীন সিনেমা হতে গেলে কী করতে হবে? যিনি অর্থ দেবেন সেটা সরকার হোক বা অন্য ব্যক্তিই হোক আপনি আপনার কাজটা স্বাধীনভাবে করতে পারবেন। বিচারের ভার দর্শকের হাতে। দ্বিতীয়ত কারো চাপে আপনি আপনার কনসেপ্টটাকে পরিবর্তন করছেন না। আমাদের এখানে তো দুটি চাপ আছে, একটা চাপ হচ্ছে সেন্সরবোর্ড। সেন্সরের জন্য তো নির্মাতারা বানাতে ভয় করে, সেন্সর বলে দিচ্ছে এটা এভাবে করো, এটা ওভাবে করো। সেন্সরবোর্ডকে গণতন্ত্রিক ও নির্মাতা ফ্রেন্ডলি বানাতে হবে। 

বাংলাদেশে সিনেমা বিষয়ক কাগজ তো এখন নেই, ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘দৃশ্যরূপ’ পেয়েছিলাম আমি খুলনাতে বসে। ১৭৫ টাকা দাম ছিল। এই পত্রিকা এখন আর নেই, সিনেমা বিষয়ক পত্রিকার দরকার রয়েছে তো...

মানজারে হাসীন মুরাদ: দরকার তো বটেই, প্রথম কথা হচ্ছে সিনেমা চর্চার জন্য, সিনেমা নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য, বাইরের দেশের নির্মাণ ভাবনা তুলে ধরার জন্য পত্রিকা হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হলো এটা থেকে বিক্রীত অর্থ ঠিকঠাকভাবে আসত না। বা এলেও এমন সময় আসত যখন আরেকটা নতুন সংখ্যা বের করাও পসিবল হতো না। আর লেখক সংকটটাও সমস্যা। 

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী, খুব ভালো ছবি বা সিরিজ আসছে তেমন কি?

মানজারে হাসীন মুরাদ: প্ল্যাটফর্ম যদি আপনি টেকনোলজির হিসাবে বলেন সেটা তো আমি না চাইলেও আসবে। কারণ এটা একটা টেকনোলজিক্যাল উন্নয়ন, সুতরাং এটা দ্বারা অনেক কিছু হবেই। প্রশ্নটা হতে পারে ওটিটির মাধ্যমে কী আসছে। সেটা আমার কাছে মোটেও ইন্টারেস্টিং বা আগ্রহের মতো মনে হয় না। আগের দিনের হল মালিকরা যা করত, এখন এরা এই দায়িত্বটা নিয়েছে যে কী ছবি দেখাবে, কী ছবি তৈরি করবে, কী সিরিজ বানাবে সেটা মানুষজনকে কতটা আনন্দ দেবে সন্তুষ্ট করবে সেটার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।

ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়-এই তিনজনের মধ্যে আপনার কাকে ভালো লাগে এবং কীভাবে?

মানজারে হাসীন মুরাদ: তিনজন একই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় এই তিনজনকে যদি আমরা গুণী চলচ্চিত্রকার বলি তাহলে তিনজনই গুণী।

কিন্তু আপনার কারো প্রতি হয়তো ব্যক্তিগত বিশেষ আকর্ষণ আছে এবং এটা গুণাগুণ সম্পর্কিত না, সেভাবে বললে আমি বলব সত্যজিৎ আমার কাছে নানা অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী এটা না, আমার যেটা মন্তব্য সত্যজিৎ এই মিডিয়ামটাকে একটা উৎকর্ষের জায়গায় নিয়ে গেছে।

যেটা ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যেটা পাওয়া যাবে তাহলে নানা চমক আছে। বুদ্ধিমত্তার চমক। সত্যজিতের সিনেমা যতটা ওয়েল মেকড এটা কোনো সিনেমাতে আপনি পাবেন না। মৃণাল সেন আবার মাঝমাঝি জায়গায়। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষার ক্ষেত্রে বেশ যত্নবান, আবার বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বেশ যত্নবান; সত্যজিতের ক্ষেত্রেও সেটা লক্ষণীয়।

৫০-এর পরের আমাদের দেশের যদি এমন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার নাম আপনাকে বলতে বলা হয় আপনি কার কার কথা বলতে চান, বলবেন?

মানজারে হাসীন মুরাদ: উইথ রিজারভেশন বলব জহির রায়হান। কেননা জহির রায়হানকে আমরা শেষের দিকে যে রাজনৈতিক, সামাজিক সচেতনতার জায়গায় দেখেছি সেই সচেতনতা কিন্তু আগের ছবিতে ছিল না। এবং উনি নানান ধরনের কাজ করেছেন। উনি যেমন ফোক ছবি বানিয়েছেন, ফোক ছবি প্রডিউস করেছেন। উনি সবধরনের সিনেমাই বানিয়েছেন, সবগুলো যে ভালো হয়েছে তা না। উনি বেসিক্যালি কমার্শিয়াল সিনেমার মানুষ। কিন্তু প্রতিভা ছিল বলেই গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা বানিয়েছেন। আর সুভাষ দত্ত কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ।

তারপর যদি বলি কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে তারেক মাসুদ গুরুত্বপূর্ণ। তানভীর মোকাম্মেল, মশিউল ইসলাম, মোরশেদুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে বলব হুমাইরা বিলকিস গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ফরিদ আহমেদ। এই কয়েকটা নাম বলতে পারি আমি। 

বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য চলচ্চিত্র নেই, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন কি?

মানজারে হাসীন মুরাদ: আমাদের দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র কিছু তৈরি আছে, যেমন ধরুন সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’। আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘণ্টা’, তারপর মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ভালো শিশুতোষ চলচ্চিত্র, বা দীপু নাম্বার টু-, এই কয়েকটায়। আমাদের এখানে একটা ধারণা ছিল শিশুদের সিনেমা দেখা যাবে না। বেশিরভাগ বাড়িতে ছোটবেলায় ও কিশোর হওয়ার পরও সিনেমা দেখতে দিত না, সিনেমা খারাপ।

এজন্য শিশুরা অ্যাক্টিভ দর্শক হয়ে ওঠেনি এবং তাদের জন্য সিনেমাও বানানো হয়নি। যারা বানিয়েছেন তারা কমার্শিয়াল সিনেমার জায়গায় কিছুটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলেই বানিয়েছেন। আরেকটা ব্যাপার সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে সরকার বা প্রতিষ্ঠান-যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করে তাদের উচিত ছিল শিশুদের নিয়ে চলচ্চিত্র বানানো। এরপর হচ্ছে সরকার কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য শিশুতোষ চলচ্চিত্র বানাবে এবং সেটা পরিবেশকদের দিতে আগ্রহী করবে-এই উদ্যোগটা নেয়নি। তারা একদমই কাজ করে না।    

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh