রাজধানীর বাতাস বিপজ্জনক

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:৫১ পিএম

 চলতি মাসেই রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। ছবি: সংগৃহীত

চলতি মাসেই রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। ছবি: সংগৃহীত

নভেম্বর মাসজুড়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর ছিল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। শীতকাল শুরু হতে না হতেই শহরটিতে বায়ুদূষণ দুর্যোগপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও অর্ধেক সরকারি কর্মীকে ঘরে থেকে অফিসের কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এবার সেই দিল্লিকে ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। শহরের বাতাসের গুণমান খুবই খারাপের দিকে। বাতাসে ‘বিষ’ নিয়ে রীতিমতো কপালে ভাঁজ পড়েছে পরিবেশবিদদের। তবু এ নিয়ে কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকারের সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গত ১১ দিনে বিশ্বের দূষিত শহরের মধ্যে ৯ দিনই ঢাকা ছিল শীর্ষে। আর বাকি দুদিনের বেশিরভাগ সময় ছিল দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে। ১০ ও ১১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত একিউআই স্কোর ছিল ১৯০ থেকে ২২০-এর ঘরে। এ দুদিন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানের মধ্যে ছিল ঢাকা।

এরপর থেকে বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে। এরপর ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিনের কয়েক ঘণ্টা জুড়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় একিউআই স্কোর ২০২, ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় ২৬৫, ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ৩৮২ এবং ১৫ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ১০টায় রাজধানীর বায়ুর মান ছিল ৩৩৭।

বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় ২১ ডিসেম্বর বুধবারও বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে  আছে রাজধানী ঢাকা। সকাল ৯টার দিকে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ৩০৮। একই সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ও রাজধানী দিল্লি যথাক্রমে ২৩২ ও ২২৫ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার দুই ও তিনে ছিল। 

এয়ার ভিজ্যুয়াল তথ্যানুযায়ী, কোনো এলাকায় একিউআই স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে ভালো ধরা হয়। স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ হলে তা বিপজ্জনক।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যে মানমাত্রা রয়েছে সেটি হলো ৬৫ মাইক্রো গ্রাম, তার প্রায় তিনগুণের বেশি রয়েছে ঢাকা শহরের বায়ুমানে ধুলা। মূলত যেখানে নির্মাণকাজ ও ইটের ভাটা রয়েছে সেখানে দুষণের মাত্রা দ্বিগুণ। চলতি মাসেই রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। 

তিনি আরও বলেন, ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, চীনের বেইজিং শহরে বায়ুর মান খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছে গেলে সেসব দেশের সরকার বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা জারি করে। নাগরিকদের বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ।

কিন্তু বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো প্রচার নেই। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে রাজধানীসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। সিটি করপোরেশন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পানি ছিটানোর যানবাহন আছে। সেগুলোকে ধুলাদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগানো উচিত। নির্মাণকাজ ও যানবাহনের ধুলা নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, যখন বাতাসের মান ঢাকার মতো এমন খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়, তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে গণ-সতর্কতা জারি করার কথা। কিন্তু এমন কোনো সতর্কতা তারা এখনো জারি করেনি। 

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বড় বড় মেগা প্রজেক্ট থেকে শুরু করে আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে ভবনগুলো তৈরি হচ্ছে বা রাস্তায় যে খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে সব জায়গাতে দেখা যাবে কোথাও কোনো আচ্ছাদন নেই, পুরো কাজ হচ্ছে উন্মুক্ত হচ্ছে। যানবাহনের ধোঁয়াও অনেককাংশে দায়ী।

শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরে থেকেও দূষিত বাতাস বাংলাদেশে আসছে। গত ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বায়ু দূষণমুক্ত করার প্রচেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় দূষণের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। ঢাকায় বায়ুদূষণের উৎস প্রায় ৪ শতাংশ প্রাকৃতিক ও ৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ। প্রায় ২৮ শতাংশ দূষণের উৎস সীমান্তের ওপার থেকে আসা দূষিত বায়ু। দেশের অন্য বিভাগ ও জেলা থেকে আসা দূষিত বায়ুও রাজধানীর বাতাসকে দূষিত করছে। ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে অন্য বিভাগ ও জেলার দূষিত বায়ুর ভূমিকা ৬০ শতাংশের কিছু বেশি।

গবেষকেরা জানান, ভারতের মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাবসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শস্য কাটার পর ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে গাছ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে বিপুল পরিমাণে ধোঁয়া তৈরি হয়। একই সঙ্গে দেশটির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ শিল্পকারখানার ধোঁয়া বাতাসে ভেসে সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের পাঞ্জাবের বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে আসা দূষিত বায়ু। বাংলাদেশের তিনটি শহরে (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা) বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশ ভ‚মিকা ভারত থেকে আসা বায়ুর। বছরের কয়েক মাস আবার উল্টো দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়, যা আবার ভারতে দূষণ তৈরি করে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুদূষণের বড় কারণ অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২ দশমিক ৫ ও পিএম ১০)। বায়ুদূষণজনিত নানা রোগবালাইয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর জন্য ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ঘরের বাইরের বায়ুদূষণ। আর ৩৭ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ঘরের ভেতরের দূষিত বায়ু।

প্রতিবেদনটিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নির্মাণকাজের ধুলা, শিল্পকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়াকে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, রান্না করার জন্য চুলায় জীবাশ্ম জ্বালানির (কাঠ, খড়, গোবর ও পাতা পোড়ানো) ব্যবহারও দূষণ ও মৃত্যু ঘটাচ্ছে।

গত ৪ নভেম্বর প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় বায়ুদূষণ এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে তিনটি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা, শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্টি হওয়া ধুলা। 

এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২ দশমিক ৫-এর বার্ষিক গড় প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান। 

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) ও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে ৪ দেশের সরকারি প্রতিনিধিরা সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভ‚মি ও হিমালয়ের পাদদেশে বাতাসের গুণমান উন্নত করার জন্য কাঠমান্ডু রোডম্যাপ তৈরি করতে গত ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর নেপালে বৈঠক করেন। দুদিনের আলোচনা শেষে ১৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। 

বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আমিরুল কায়সার। তিনি বলেন, ‘৪ দেশের মধ্যে এটিই প্রথম আন্তঃসীমান্ত উদ্যোগ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকায় বায়ুদূষণ কমাতে এটি একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ৪ দেশই ২০৩০ সালের মধ্যে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ এমসিজিতে নামিয়ে আনতে জাতীয় ও আঞ্চলিক উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছে। দেশগুলো নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জামগুলো শেয়ার করতেও একমত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী।’

পরিবেশ ও বনমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেন, এখন সারা বিশ্বেই একই অবস্থা। আমরা এখানে মোবাইল কোর্ট দিয়ে জরিমানা করি। পানি ছিটানো হয়। মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করতে নানা প্রচারণা চালানো হয়। অল্প জনবল নিয়ে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এখানে সবাই বায়ুদূষণ করে, শুধু বন্ধ করার দায়িত্ব আমাদের। সবাই সচেতন না হলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh