জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৯ পিএম
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্প্রতি ঢাকার শাহীনবাগে অবস্থিত নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়ি যান। তারা রাষ্ট্রদূতের কোনো আত্মীয় নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি সতর্কসঙ্কেত বলে মনে হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে ইদানীং বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় মনে হচ্ছে।
জাতীয় সংসদের নির্বাচন আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ চলতে থাকে। কূটনীতি সম্মানজনক পেশা বলে এখন মেধাবীরা এই পেশাকে প্রথম পছন্দ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে থাকে। কিন্তু ‘কূট’ শব্দাংশটি মূলত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শুধু মেধা দিয়ে কিন্তু কূটনীতি হয় না, চিকন বা বাঁকা বুদ্ধি না থাকলে কূটনীতিতে সফলতা আনা যায় না। রাজনীতিতে কূটবুদ্ধির প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন গ্রিক সম্রাট আলেক্সান্ডারের ভারতবর্ষ অভিযানের অব্যবহিত প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী এবং কূটনীতি বিশারদ চাণক্য বা কৌটিল্য। তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপকও ছিলেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের নিমিত্তে সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে নীতি গ্রহণ করে তার বাস্তবায়নে কূটনীতিকদের গৃহীত কার্যক্রমই কূটনীতি। ১৯৬১ সনের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিকেরা আলাদা কতকগুলো সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তারা যাতে কোনো চাপ ছাড়া স্বাধীনভাবে অন্য দেশে অবস্থান করে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সেজন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কূটনৈতিক রক্ষাকবচ পেয়ে থাকেন। এর আওতায় তারা যে দেশে অবস্থান করেন সেখানে অপরাধ করলে তাদের গ্রেপ্তার বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয় না। এই রক্ষাকবচের আওতায় শুধু ব্যক্তি কূটনীতিক নয়, কূটনীতিবিদের অফিস বাড়িঘরেও তল্লাশি চালানো যায় না। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে অন্য একটি দেশে কনস্যুলেট বা দূতাবাসের যে চত্বর থাকে সেখানে কূটনৈতিক মিশনে নিজের দেশের আইন চলে। এই রক্ষাকবচের সুবিধা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বলেই লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া উইকিলিকস ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা সত্ত্বেও লন্ডন পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি, দূতাবাস থেকে বের হওয়ার পর তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
আমাদের দেশে নির্বাচন এলে বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরা নিজেরা যেমন তৎপর হয়ে ওঠেন, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সক্রিয় করে তোলে। বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের প্রকাশ্য কর্ম তৎপরতা অতীতেও দেখা গেছে, এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নেতারা কূটনীতিকদের বেশি দৌড়াদৌড়ি পছন্দ করেন না; কিন্তু বিরোধী দলে থাকলে তারাই আবার কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেন। একটি সার্বভৌম দেশের সরকার তাদের সব কাজকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট ডেস্কের মুখপাত্র তো প্রায়ই তার আওতাধীন দেশ সম্পর্কে বিবৃতি, রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। অবশ্য কিছু হস্তক্ষেপের প্রয়োজনও আছে, নতুবা স্বৈরশাসকদের লাগামহীন অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। তবে ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরশাসকদের কাছে বিদেশিদের বিবৃতির কোনো মূল্য নেই। রোহিঙ্গা নির্যাতনে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশের আলোচনা, সমালোচনারও তোয়াক্কা করছে না মিয়ানমার। কোনো দেশ সম্পর্কে প্রকাশ্যে মতামত দেয়া থেকে আরেকটি দেশ তখনই সম্পূর্ণ বিরত থাকে যখন দেশ দুটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করে থাকে। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিশরের সামরিক সরকারকে সমর্থন করছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর পৃথিবীর বহু দেশ স্বীকৃতি দিলেও চীন এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনে তাদের স্বার্থের অনুকূল পরিবেশ, পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার পর চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্যে নেতিবাচক মতামত দিতে পারে শুধু সেই দেশগুলোই যারা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যাদের অসহযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হবে। মালদ্বীপের আবদুল্লা ইয়েমিন চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বহুদিন দেশ শাসন করেছেন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শীতল। মালদ্বীপের পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে বেশি। মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের অতি মাখামাখি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পছন্দ করেনি।
শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী না হওয়ার কারণে বা সামরিক শক্তি অন্যের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিতে অক্ষম বলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো মতামত গোপনে বা প্রকাশ্যে দেয়ার অধিকার রাখে না অথবা মতামত দিলে তা গুরুত্ব বহন করে না। আবার এই দুটি ক্ষেত্রে সবল হলে অন্য দেশের মতামত গ্রাহ্য করারও প্রয়োজন হয় না। সর্বোপরি অর্থনৈতিক ভিত শক্ত থাকার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলে আন্তর্জাতিক অনেক চাপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারণে সৌদি আরব কানাডার মতো দেশকেও কেয়ার করেনি। সৌদি নারী অধিকার কর্মীদের মুক্তি চাওয়ায় সৌদি আরব যেভাবে কানাডাকে ধমক দিয়ে ক্ষমা চাইতে বলেছিল তা কূটনীতিতে বিরল; অথচ সৌদি আরবের এমন দাবির বিরুদ্ধে একটি দেশও কিছু বলেছে বলে শুনিনি। কানাডার বিরুদ্ধে সৌদি আরবের গৃহীত একতরফা ব্যবস্থাদি কানাডা নীরবে হজম করতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের দেশে সারা বছর বিদেশি কূটনীতিবিদরা রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, আমলা, সাবেক কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মতবিনিময় করে প্রয়োজনীয় কথা বের করে নেয় এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনে সম্পর্ক গড়ে তোলে। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সব কূটনীতিক গল্ফ খেলতে বা দেখতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মাঠে চলে যেতেন। অন্যদিকে নির্বাচন এলে বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতারা নিজের গরজে দাওয়াত ছাড়াও তাদের কাছে ধরনা দেয়। বিরোধী দল জানে, শত শত দিন রাস্তায় বিক্ষোভ করার চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কাছে থেকে তাদের দাবির পক্ষে একটি বক্তব্য আদায় করা গেলে তা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর। তাই মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি সক্রিয় থেকেও স্বস্তি পাচ্ছে না, কারণ সরকার হটানোর ক্ষমতা বিএনপি এখনো অর্জন করেনি। অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল নিয়ে জোট গঠন করলেও এই প্রচেষ্টা খুব বেশি ফলপ্রসূ প্রতীয়মান হচ্ছে না; কারণ এই সকল দলে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বা তাদের দলের কোনো জনভিত্তি নেই, নিজের দলের পরিচয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হলে প্রায় সবাই শোচনীয়ভাবে জামানত হারাবেন। তাই বিএনপি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। সরকারি দল কূটনীতিকদের সক্রিয়তাকে প্রকাশ্যে পাত্তা না দিলেও ভেতরে ভেতরে উন্নয়ন সহযোগী বিদেশি দূতদের বক্তব্য মূল্যায়ন করছে।
বিরোধী দল শুধু বিদেশি রাষ্ট্রদূতের উপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না; প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন লাভে তারা বিদেশে লবিস্টও নিয়োগ করে থাকে। পাশ্চাত্য হচ্ছে বেনিয়ার জাত, তারা টাকা আয়ে হারাম, হালাল বোঝে না। আমাদের দেশে লবি করা এক ধরনের অনৈতিক কাজ; কিন্তু আমেরিকায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে সেদেশের নীতি প্রণেতাদের প্রভাবিত করা আইনসম্মত। আন্দোলনে সুবিধা করতে না পেরে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা ও মানবতাবিরোধী কাজগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরে আনার জোর প্রচেষ্টা নিয়েছে বিএনপি। বিরোধী দলে থাকাকালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও এমন লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগ উঠেছিল। ইউরোপে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে বাঙালিরাও নিজ নিজ দলের সমর্থনে বিদেশে রাস্তায় বা পার্লামেন্টের সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো জাতীয় ইস্যুতে একমত হতে না পারলেও শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এক ধারাতেই চলতে পছন্দ করে। ভারতের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে দেখি সরকারি এবং বিরোধী উভয় দল মাথা ঘামায়। চীনও আজকাল আর্থিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ফেরত নিতে মিয়ানমারের এত গড়িমসির পেছনে চীন বাংলাদেশের উপর পরোক্ষভাবে চাপ দিচ্ছে না তো? রাষ্ট্রদূতেরা তাদের দেশের রাজনৈতিক অভিলাষ অনুযায়ী আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। ভারতের সঙ্গে যে দলের সম্পর্ক ভালো সেই দলের সঙ্গে চীন বা পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো থাকার কথা নয়। অন্যদিকে যারা চীন বা পাকিস্তানের খয়ের খাঁ তাদের ভারত বিশ্বস্ত ভাবতে পারে না। জঙ্গি দমনে আওয়ামী লীগ কঠোর হওয়ায় পাশ্চাত্যে তাদের কদর বেড়েছে। তবু পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের কথা বলবে, সুশাসনের প্রতিষ্ঠা চাইবে, ফেয়ার নির্বাচনের জন্য চাপ দেবে। মধ্যপ্রাচ্যে আওয়ামী লীগ আগে সুবিধা করতে পারেনি; কিন্তু এখন সৌদি আরবের কূটনীতিতে ভিন্ন মাত্রার আবহ যোগ হয়েছে, সৌদি আরবের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক নির্ধারণে শুধু ধর্ম নিয়ামক হিসেবে এখন আর বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। সম্পর্ক স্থাপনে ধর্ম নিয়ামক হলে সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ইরানকে শাসাত না। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এসব সমীকরণে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে আমাদের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যেও পারস্পরিক চাণক্যনীতি চলবে।