প্রকল্পে সময়ক্ষেপণ

বাড়ছে ব্যয় ও জনদুর্ভোগ

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৩৫ এএম

বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ছবি: সংগৃহীত

বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ছবি: সংগৃহীত

গত কয়েক বছর ধরেই একটি বিষয় তুমুল আলোচনায়। সেটি হলো, সরকারের বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্পই এখন আর নির্ধারিত টাকায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে সময় বাড়ানো হয়। আর তাতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ। তাছাড়া সময় বেশি লাগায় বাড়ে জনদুর্ভোগ। 

গত এক বছরে গণমাধ্যমে বেশি অনিয়মের কথা উঠে এসেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ, শিক্ষা বস্ত্র ও পাট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে যত বেশি ব্যয় বাড়ে, প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমে যায়।  

উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘এলবিসি’ প্রকল্পের কথা বলা যায়। ‘উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি সংক্ষেপে ‘এলবিসি’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের অধীনে বানানো হয়েছে ৭৭টি সেতু। এর অনেকগুলোতে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি সেতুতে পাওয়া ছ দৃশ্যমান ভয়াবহ ত্রুটি। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ছয় বার।

আর তাতে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ কিছুদিন আগে এলজিইডির ‘এলবিসি’ প্রকল্পের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আর তাতে এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন কর্তাব্যক্তিরা!

সূত্র বলছে, ৬২৮ কোটি ১৫ লাখ টাকার এলবিসি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১০ সালের মার্চ মাসে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ছয়বার সময় বাড়ানোর পর বর্তমানে প্রকল্পের নতুন মেয়াদ হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ত্রুটি পাওয়া ২২ সেতুর মধ্যে বেশ কয়েকটির মেরামত করা প্রয়োজন। কয়েকটি সেতুর রেলিংয়ে রড নকশা অনুসারে দেওয়া হয়নি। সিমেন্ট পর্যাপ্ত না দেওয়ায় রেলিং ঝুরঝুরে হয়ে পড়েছে। কয়েকটি সেতুর সংযোগ সড়ক নেই। সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ অর্থহীন হয়ে পড়বে। তথ্যমতে, অনুমোদনের সময় প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ৪৬ মাস। ধাপে ধাপে মেয়াদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রকল্পের শুরু থেকে ১৬০ মাস।

কেন ছয় বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, আটটি ঠিকাদারি চুক্তি বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান, একাধিকবার প্রকল্প সংশোধন এবং নতুন সেতু অন্তর্ভুক্ত করায় প্রকল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। চারবার সংশোধন ও দুবার মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে বাস্তবায়নকাল ৯ বছর ৬ মাস বৃদ্ধি পেয়েছে। 

এলবিসি প্রকল্পে দফায় দফায় অনিয়ম হয়েছে। এর অধীনে ৯০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাস্তবে ৮১ দশমিক ৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। অবশিষ্ট ৮ দশমিক ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু পুরো ১০৩ কোটি টাকাই ব্যয় হয়েছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এখানে আসলে কী ঘটেছে? 

পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি দরপত্রে দাপ্তরিক মূল্যের চেয়ে ২৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি মূল্যে চুক্তি হয়েছে। এই কাজ ঠিকাদারের শেষ করার কথা আড়াই বছরে, কিন্তু শেষ করতে সময় লেগেছে ৮ বছর ৩ মাস। আরেকটি দরপত্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দাপ্তরিক মূল্যের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি মূল্যে চুক্তি করা হয়েছে। অন্য কোনো ঠিকাদার দরপত্র জমা না দেওয়ায় অধিক মূল্যে চুক্তি করতে হয়েছে বলে প্রকল্প অফিস থেকে জানানো হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিক তদারকিতে ঘাটতি পেয়েছে নিরীক্ষক দল। 

এবার চোখ রাখা যাক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি প্রকল্পে। ২০২২ সালের শুরুতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চলমান বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছিল জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব কমিটি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’ শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে।

প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু আড়াই বছরে এই প্রকল্পের জন্য ১টি ফোর হুইলার, ৫টি ডাবল কেবিন পিক-আপ, ১টি মাইক্রোবাস ও ৪১৮টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। ওই প্রকল্পে গাড়ি কেনা ছাড়া আদতে তেমন কোনো কাজ হয়নি।

আর ‘গরুর পিপিআর রোগ নির্মূল এবং খুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প’ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি। ২০২২ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। গত নভেম্বর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি তেমন হয়নি। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের জুনে। ২০২৩ সালের জুনে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। অথচ বেশিরভাগ কাজ হয়নি।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও করুণ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অনুমিত হিসাব কমিটির বৈঠকে রেলওয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে রেলপথ মন্ত্রণালয় তাদের চলমান ৩৯টি প্রকল্পের (অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত হালনাগাদ) তথ্য দিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ওই ৩৯টি প্রকল্পের ১১টির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পে নতুন কাজও যুক্ত করা হয়। শুরুতে এই ১১ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল সব মিলিয়ে ৫১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এখন ব্যয় বাড়িয়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সময় বাড়ার পাশাপাশি এসব প্রকল্পের অনুমিত খরচ বেড়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পেরও একই দশা। ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে মোট ৯৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ সভায় এই প্রকল্পগুলো নিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাতে দেখা যায়, এই ৯৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৮টির সময় এক বা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়ও বেড়েছে। সময় বেশি লাগায় সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে একটি প্রকল্প নেয়। সেটি ছিল দেশের ১ হাজার ৮০০টি মাদ্রাসার উন্নয়ন। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

এই প্রকল্পটি সংশোধনের কারণ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এক প্রতিবেদনে বলেছে, মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে ১ হাজার ৮০০ মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তালিকাভুক্ত ছিল ১ হাজার ৭২১টি। পরে প্রকল্পে আরও ৩৩টি মাদ্রাসার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব মাদ্রাসার উন্নয়নে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন সাংসদদের। কিন্তু ভুলক্রমে নন-এমপিও ১৯টি মাদ্রাসাকেও তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে সেগুলোকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ধরা হলেও প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১৭টি প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পেরই কাজ প্রথমে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে শেষ করতে পারেনি। এগুলো বাস্তবায়নে সময় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পে মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের প্রকল্প চলছে ১১টি। এর মধ্যে নয়টি প্রকল্পেরই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যার দুটিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ের সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্প ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রামীণ সড়ক ও হাটবাজার অবকাঠামো উন্নয়ন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল অনুমোদিত সময়ের চেয়ে সাড়ে চার বছর বেশি লাগে। এতে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়। সূত্র বলছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এগুলো মূলত গ্রামীণ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদন পায়নি আইএমইডি। বাকি ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১০টির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।

আগের অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২৪টি প্রকল্প শেষ হয়। এগুলোর মধ্যে অন্তত ১৩টি প্রকল্পে সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়। আর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সাতটি প্রকল্প চলমান আছে। সাতটি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি ইতোমধ্যে দুই থেকে তিনবার সংশোধন করা হয়েছে। সব কটিতেই ব্যয় বেড়েছে।

আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির জন্য একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থাগুলো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে থাকে। দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের শৃঙ্খলা এবং ফলদায়ক করার জন্য উল্লেখিত দপ্তরগুলোর দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধ করে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে অস্বাভাবিকভাবে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। প্রকল্প নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রকল্পের যথার্থতা এবং উপযোগিতা রয়েছে কি-না, তা স্থানীয় ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিশ্চিত করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh