অনিন্দ্য হাসান
প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৫০ পিএম | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৫১ পিএম
কাজী আনোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
মৃত্যু বলতে জীবনের সমাপ্তি বোঝায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আজিকে হয়েছে শান্তি, জীবনের ভুলভ্রান্তি, সব গেছে চুকে।’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় লেখেন,
‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন নদে?’
এমন বাস্তবতায় এ বছরও আমরা হারিয়েছি বেশ কজন কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে। স্মৃতিময় সেইসকল গুণীজনকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- অনিন্দ্য হাসান
কাজী আনোয়ার হোসেন: ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি হারিয়েছি সাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনকে। তিনি সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার ও রহস্যভেদী মাসুদ রানার স্রষ্টা। কাজী আনোয়ার হোসেন একাধারে লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক। ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই লেখক। তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাকনাম ‘নবাব’। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন।
কাজী রোজী: ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি কাজী রোজী। কাজী রোজী ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সাহিত্যে স্নাতক ও এমএ পাস করেন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’ পান। কাজী রোজীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো- পথঘাট মানুষের নাম, নষ্ট জোয়ার, আমার পিরানের কোনো মাপ নেই, লড়াই, শহীদ কবি মেহেরুন নেসা, শেখ মুজিবর বাঙালীর বাতিঘর, কবিতায় বলি, কবিতায় জ্বলি ইত্যাদি।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী: গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদায় নিয়েছেন। ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’, ‘যেখানেই সীমান্ত তোমার সেখানেই বসন্ত আমার’, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’-এর মতো বহু কালজয়ী গানের রচয়িতা কাওসার আহমেদ চৌধুরী।
দিলারা হাশেম: সাংবাদিক ও লেখক দিলারা হাশেম আমাদের কাছ থেকে ১৯ মার্চ চিরতরে বিদায় নেন। ভয়েস অব আমেরিকার প্রাক্তন বেতার সম্প্রচারক এবং প্রথিতযশা সাহিত্যিক ছিলেন দিলারা হাশেম। ১৯৩৬ সালের ২১ আগস্ট যশোরে তার জন্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ ১৯৬৫ সালে প্রকাশ হয় এবং ১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘর মন জানালা (১৯৬৫), একদা এবং অনন্ত (১৯৭৫), স্তব্ধতার কানে কানে (১৯৭৭), আমলকির বউ (১৯৭৮), শঙ্খ করাত (১৯৯৫)।
হাসান আরিফ: আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ বিদায় নিয়েছেন ২০২২ সালের নির্দয় এপ্রিলে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন হাসান আরিফ। আশির দশক থেকে নিজে আবৃত্তি করেছেন এবং আবৃত্তিচর্চা ও প্রশিক্ষণে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন। বেশ কিছু আবৃত্তির অ্যালবামও বের হয়েছে তার।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ২০২২ সাল ১৯ মে, আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নেন সাংবাদিক-কলামিস্ট ও সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। যুক্তরাজ্য প্রবাসী স্বনামধন্য এ সাংবাদিক স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশি’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৩০।
শর্মিলী আহমেদ: ২০২২ সালের ৮ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ঢাকাই সিনেমার বরেণ্য অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ। মঞ্চ, টিভি ধারবাহিক, খণ্ড নাটক ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর অভিনয় জীবন শুরু হয় মাত্র চার বছর বয়স থেকে। সেই থেকে প্রায় চারশটি নাটক ও দেড়শটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার: ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’সহ অসংখ্য গানের গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার চিরদিনের জন্য আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছেন।
সমরজিৎ রায়চৌধুরী: ৯ অক্টোবর ২০২২ সাল, খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী চিরবিদায় নেন। চিত্রকলায় অবদানের জন্য ২০১৪ সালে তিনি একুশে পদক পেয়েছেন।
মাসুম আজিজ: ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ। ‘ঘানি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন মাসুম আজিজ।
গোলাম মোস্তফা খান: ১৩ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী গোলাম মোস্তফা খান। নৃত্যশিল্পে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২০ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আলী ইমাম: ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম। ৬ শতাধিক বই লিখেছেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশন (২০০৪-২০০৬) ও অধুনালুপ্ত চ্যানেল ওয়ানের (২০০৭-২০০৮) মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০১) এবং শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২) ছাড়াও অনেক পুরস্কারে ভূষিত আলী ইমাম।