বছরটা মনে থাকবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:০৫ পিএম

ইউক্রেনের একটি ভবনে রাশিয়ার হামলা। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের একটি ভবনে রাশিয়ার হামলা। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধ- কিয়েভ থেকে খেরসন ২০২২ সালের বেশিরভাগ ঘটনারই প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা চলছিল ২০২১ সাল থেকেই।

ন্যাটোর পূর্ব সীমানার বর্ধিতকরণকে ক্রেমলিন রুশ ফেডারেশনের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে। অপরদিকে পশ্চিমারা রুশ দাবি আদায়ে ইউক্রেনের উপর হামলার হুমকিকে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে।

উত্তেজনার কূটনৈতিক সমাধান না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলা করে রাশিয়া। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি কী হতে পারে, তা কেউই অনুধাবন করতে পারেননি। রাশিয়া ভেবেছিল, তারা স্বল্প সময়ের মাঝেই ইউক্রেনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, ইউক্রেন যদি যুদ্ধ না করে রাশিয়ার কাছে নতি স্বীকার করে, তাহলে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়াটা অর্থহীন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনের আবেদন সত্ত্বেও সামরিক সহায়তা দিতে গড়িমসি করে। 

তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায়, যখন ইউক্রেনের কাদায় রুশ ট্যাংক আটকে যেতে থাকে এবং ইউক্রেনীয়রা আশাতীত যুদ্ধক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকে। ঠিক এ সময়েই পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ট্যাংক বিধ্বংসী ও স্বল্পপাল্লার বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ শুরু করে। এতে রাশিয়ার লম্বা সামরিক সাপ্লাই কলামগুলো ইউক্রেনের শিকারে পরিণত হয়। 

ফলে এপ্রিল মাস নাগাদ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আশপাশ থেকে সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় রাশিয়া। এটা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। 

রাশিয়া কিয়েভ থেকে সরে আসার পর নিজেদের যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন এনে ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চল এবং দক্ষিণের খেরসন অঞ্চলে নিজেদের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেন পূর্বাঞ্চলের খারকিভ শহর পুনরূদ্ধার করে। ২১ সেপ্টেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক ভাষণে ঘোষণা দেন যে, প্রয়োজনে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার করবে।

একই সঙ্গে তিনি তিন লাখ নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেন। ১১ নভেম্বর রুশ সেনারা সরে যাওয়ার পর ইউক্রেনের সেনারা দক্ষিণের খেরসন শহরও পুনর্দখল করে। এর মাঝে ৮ অক্টোবর রাশিয়ার কৌশলগত কার্চ সেতুতে ইউক্রেনের হামলার পর ইউক্রেনজুড়ে জ্বালানি ও অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোর উপর ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে মস্কো; যেখানে যুক্ত হয় ইরানে নির্মিত সুইসাইড ড্রোন।

ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আক্রমণকে পুঁজি করে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে উচ্চতর ক্ষমতার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেওয়া শুরু করে। সর্বশেষ ইউক্রেনকে ‘প্যাট্রিয়ট’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের মাঝে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে; যা একটা দীর্ঘ যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

রাশিয়ার উপরে অবরোধ, ইউরোপে জ্বালানির সংকট 

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমারা রাশিয়ার উপরে কঠোর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে; যার ফলে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি, রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে ইউরোপ তীব্র জ্বালানি সংকট ছাড়াও ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির মাঝে পড়ে যায়। জীবনযাত্রার ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ায় পুরো ইউরোপজুড়ে জন-অসন্তোষ দেখা দেয়। 

অর্থনৈতিক দৈন্যকে পুঁজি করে উগ্র ডানপন্থি ও বামপন্থি গ্রুপগুলো রাস্তায় নামে। ইউরোপের এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝেই সেপ্টেম্বর মাসে ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বে ডানপন্থি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা নেয়। অনেকেই মেলোনির দলের ফ্যাসিস্ট ভিতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির মাঝে ভুল দিকনির্দেশনা দেয়ার ফলে অক্টোবরে ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের সরকার মাত্র ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আর ডিসেম্বরের শুরুতে জার্মানিতে একটা ডানপন্থি গ্রুপ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি, নাকি পশ্চিমা জোটের মাঝে ফাটল 

ইউক্রেনকে পশ্চিমা জোট ব্যাপক অস্ত্র সরবরাহ করলেও ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে মতানৈক্য রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের চাপ সত্ত্বেও ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশ রাশিয়ার উপর আগেভাগেই অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পক্ষপাতী ছিল না। এর মাঝে জার্মানি ও ফ্রান্স ছাড়াও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ ছিল- যারা কম দামের রুশ জ্বালানির উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল। যুদ্ধ শুরুর পরও জার্মানি ও ফ্রান্স ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে গড়িমসি করেছে। প্রবল জ্বালানি সমস্যা এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপের মাঝে ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনকে কত দিন সহায়তা দিয়ে যেতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ব্যাপক। 

জার্মানির জ্বালানি সমস্যার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র এলএনজি সরবরাহ করে ইউরোপের উপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে। এছাড়াও ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে শেষ হওয়া উচিত, তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কলহ

নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন ছিল তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। অর্থনৈতিক দৈন্য ও গর্ভপাতকে প্রধান ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে সামান্য এগিয়ে থাকে। অপরদিকে নিম্নকক্ষে রিপাবলিকান পার্টি তাদের ক্ষীণ অগ্রগামী অবস্থানকে ধরে রাখে। কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের এগিয়ে থাকাটা হোয়াইট হাউসে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে।

 তবে নির্বাচন ছাড়াও আলোচনার কেন্দ্রে ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট দলের আইনি লড়াই। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে ডানপন্থিদের হামলায় ট্রাম্প ইন্ধন জুগিয়েছিলেন কিনা, সেই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ ছাড়াও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা, এমনকি আগস্ট মাসে ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের ঝটিকা অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ায়। 

ডেমোক্র্যাটরা ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ট্রাম্পকে অযোগ্য ঘোষণা করার পেছনেই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কলহের জের দৃশ্যমান হয় দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতেও।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh