চাপে অর্থনীতি

রাজনৈতিক সংকটের শঙ্কা

হামিদ সরকার

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:০৩ পিএম

কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ছবি: সংগৃহীত

কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ছবি: সংগৃহীত

অর্থনৈতিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তায় ২০২২ পার হলো। ডলার সংকট এখনো কাটেনি, ভারি মূল্যস্ফীতি, চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকটের শঙ্কায় দেশের অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জ ও চাপের মধ্যে।

নানা পদক্ষেপের পরও আমদানি ব্যয় খুব একটা কমছে না। এখনো প্রতি মাসে পণ্য আমদানিতে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আর এ কারণে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েই চলেছে। আর ৮.৭১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হারে মানুষ অতিষ্ঠ।

অন্যদিকে ২০২৩ সাল বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কঠিন বছর হতে চলেছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ মন্দার মধ্যে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন বছরেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের গতি প্রকৃতির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে এসব চ্যালেঞ্জের ধরন কেমন হবে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। যার সুফল পেয়েছে অর্থনীতি। আবার ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতির উপর।

তবে  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) বাড়তে বাড়তে করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। করোনার মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে।

খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ যাবৎকালে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির একটা শঙ্কাও থেকে যায়। 

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতিই ২০২২ সালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে ছিল। কিছুটা কমে সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির এই হার এখনো ৮.৭১ শতাংশ। খাদ্য খাতে এই মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত খাতে ১০ শতাংশকে ছুঁই ছুঁই করছে। নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৮৫ শতাংশ। ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হয়েছে। এ সময় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর শহরে হয়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

দেখা গেছে, যেসব খাদ্যপণ্য গ্রামে উৎপাদন হয় তার দাম গ্রামেই বেশি, শহরে কম। আর আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল। ওই মাসে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল দেশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে উন্নীত হয় তখন। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে অবশ্য এই সূচক ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। 

গত বছরে ব্যাংক খাতে আলোচিত ঘটনা ছিল ডলার-সংকট। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় এই সংকট আরও তীব্র হয়। তাতে খোলাবাজারে সেঞ্চুরি হাঁকায় ডলার; ছাড়িয়ে যায় ১২০ টাকা। এরপর ব্যাংকেও ডলারের দর সেঞ্চুরি করে। ডলার-সংকট সামাল দিতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তারপরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। এর ফলে কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। 

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই পাঁচ মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই প্রবাসী আয় ১৬০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। আর ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৩ দিনে (১-২৩ ডিসেম্বর) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১২৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স প্রবাহে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি থাকবে কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। 

রপ্তানির সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমনিতেই অর্থনীতি ঝুঁকিতে আছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সাল হলো খুবই শঙ্কাময়। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান বের হবে। যদি দেশে সত্যি সত্যি কোনো সংঘাত দেখা দেয়, বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। আগে যেমন আমরা সস্তায় পণ্য সরবরাহ করতে পারতাম। এখন ভারত ও পাকিস্তানও সেটি করছে। অনেক ক্রেতা সেখানে চলে গেছে। রাজনৈতিক সংঘাত হলে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ আরও কমে যাবে। ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকারত্ব বাড়বে।

অর্থনীতির বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, ২০২২ সাল পৃথিবীর পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল। সেটার ঢেউ থেকে বাংলাদেশ দূরে থাকতে পারেনি। বিশ্বের সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমরা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি। তেল, চাল, ডালসহ যে কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে। জাহাজের ভাড়া বেড়ে যাওয়াতে আমদানিকৃত পণ্যের দামেও প্রভাব পড়েছে।

তার দৃষ্টিতে নতুন বছরেও আমাদের ডলার সংকট মোকাবিলা করতে হবে, এই সংকট তাড়াতাড়ি যাবে না। তেলের দাম কমে আসবে। বাজারে চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা কমেছে। আমনের ফলন ভালো হয়েছে। আরও কিছুটা কমতে পারে। আর আগামী মৌসুমে বোরো ধানটা যদি ভালো হয়, তাহলে অনেকটা চিন্তামুক্ত থাকা যাবে। মূল্যস্ফীতিকে আমরা বাগে রাখতে পারব।

তার বিশ্লেষণ, ডলার সংকট ২০২৩ সালেও থাকবে। গত বছর যেসব এলসি পেমেন্ট হয়নি তার প্রভাব পড়বে ২০২৩-এ। এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। হয়তো অনেকেই অর্থ পাচার বাড়িয়ে দেবেন। অনেকেই অনিশ্চয়তা থেকে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমদানি কমে গেছে, অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে বিনিয়োগ দরকার হবে। আর বিনিয়োগ চাইলে আমদানি বাড়াতে হবে। আর আমদানি বাড়াতে গেলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর প্রতি সরকারকে নিবিড়ভাবে নজর দিতে হবে। এছাড়া রাজস্ব নিয়েও কাজ করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের বিশ্লেষণে, যেসব বিশ্লেষণ বেরিয়েছে তাতে ২০২৩ সাল সংকট মোকাবিলার বছর হবে। সেটা বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। উত্তরাধিকার সূত্রে ২০২২ সালে ইতোমধ্যে চলছে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের সংকট। ২০২২ সালে অর্থনীতি খুব একটা খারাপ অবস্থা ছিল তা না। মূল্যষ্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি উঠেছিল। একটু একটু করে গত তিন মাসে মন্থর গতিতে একটু কমেছে। আর খাদ্য মূল্যষ্ফীতি যা কমেছে তা আরও বেশি কমার আশা করা হয়েছিল। 

তিনি বলেন, ২০২৩ সালে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিগুলো, ইউরোপ মন্দায় যাবে- এটা নিয়ে খুব একটা অনিশ্চয়তা নেই। তবে অনিশ্চয়তা হলো, কত গভীর ও দীর্ঘ হবে? সে অবস্থায় বর্তমানে রপ্তানির যে ৫৩৬ কোটি ডলার, ইউরোপ যদি মন্দায় যায় তাহলে রপ্তানির পারফরম্যান্স ধরে রাখা কঠিন হবে। আমেরিকার অর্থনীতি ইউরোপের মতো দুর্বল না। তাদেরটার আশঙ্কা ইউরোপের তুলনায় কম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট হলে অর্থনীতির যে ইনফরমাল খাত সেটা বিকল হয়ে যায়। তখন দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার অর্থাৎ আরবান ইনফরমাল খাত বিকল হয়ে যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh