শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৫৪ পিএম
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে অর্গানিক চাষকেই দায়ী করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
গত বছর মে মাসের কথা- সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে বিক্ষোভে ফুঁসছিলেন সেখানকার জনগণ। রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ও নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়ে দাঁড়ায় নিত্যদিনের ঘটনা।
বহু হতাহতের পর সরকার ও রাজাপাকসে পরিবারের পতন হয়। তবে গত কয়েক বছরের অশান্তির আগুনে দেশটির অর্থনীতি পুরোপুরি ধসে পড়েছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমুখী প্রভাবে পুড়তে হচ্ছে লঙ্কাবাসীকে।
শ্রীলঙ্কায় এখন এক বেলা না খেয়ে বা আধা পেটে দিন কাটাচ্ছে ৭০ শতাংশ পরিবার। খাবার জোটাতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে অনেক শিশু। বাড়ছে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর হার। তৈরি হয়েছে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিও। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে শ্রীলঙ্কা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও নেই কোনো আশার আলো। শ্রীলঙ্কায় কর্মরত সমাজকর্মী মাইকেল ডেভিড জানান, সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাধ্য হয়েই কাজে পাঠাচ্ছেন বাবা-মায়েরা। যাতে নিজেদের খাবার নিজেরাই জোগাড় করতে পারে। এসব শিশুকে স্কুলে আনার জন্য খাবারের একটি প্যাকেজ সরবরাহ করা হচ্ছে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়া এই দেশটিকে ভারত মহাসাগরের মুক্তো বলা হতো। সেই দেশে ২০২০ সাল থেকেই আর্থিক পরিস্থিতিতে ধস নামতে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ২০২০ সালেই ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৯৪ শতাংশ ছিল, ২০২২ সালে এটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১৯ শতাংশে।
শুধু ২০২২ সালেই শ্রীলঙ্কাকে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হতো, এদিকে বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। যে কোনো মুহূর্তে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে দেশটি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে শ্রীলঙ্কার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।
২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজপাকসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে শুরু করে। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ৭.৫ বিলিয়ন ডলার ছিল সেখান থেকে গত ডিসেম্বরে আসে ৩.১ বিলিয়ন ডলার এবং বর্তমানে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে দেশটিতে, যা ২০০৮ সালের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থা এতটাই করুণ যে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে পারেনি, দুটি প্রথম শ্রেণির নিউজপেপার বন্ধ হয়ে গেছে শুধু কাগজের অভাবে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এতটা খারাপ অবস্থায় কোনোদিন পড়েনি শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের মূল্যমান ২৭৬.৯৩ শ্রীলঙ্কান রুপি।
যখন ডলারের বিপরীতে কোনো দেশের মুদ্রার দাম পড়ে যায়, তখন সেই দেশটির আমদানিতে বেশি টাকা লাগে যার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশটির নিজস্ব বাজারে। আবার ঋণ শোধ করতেও অনেক বেশি অর্থ লাগছে। অর্থাৎ ডলারের যে বিনিময় হারে ঋণ নেওয়া হয়েছে, শোধ করতে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ লাগছে। এ রকম প্রচুর ঋণ কয়েকগুণ বেশি হারে শ্রীলঙ্কাকে শোধ করতে হচ্ছে।
গত ১৫ বছর ধরে ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হতে থাকে শ্রীলঙ্কার। দেশটি দেনা সংকটে পড়েছে ২১ শতকে এসে। যখন দাতাদের মধ্যেও রয়েছে পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব। যেমন-ব্ল্যাকরক ইনকর্পোরেশন, মরগ্যান স্ট্যানলির মতো বৃহৎ পশ্চিমা সংস্থাগুলো ১২.৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণদাবি আদায়ে নিজস্ব জোট গঠন করেছে। এটা শ্রীলঙ্কা সরকারের বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া মোট ঋণের অর্ধেক অংশ।
দাতাদের বহুমুখী দ্বন্দ্বের চাপে নাজেহাল, অবরুদ্ধ শ্রীলঙ্কা। এই অবস্থায় দেনার ভার লাঘবে সবচেয়ে বড় ঋণদাতার দিকেই নির্ভর করার কথাও ভাবছে। এজন্য দেনা সংস্থাপনে ‘মোস্ট ফেভার্ড ক্রেডিটর’ নীতি গ্রহণ করতে চায়। এর মাধ্যমে বেইজিংকে ঋণ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবচেয়ে ভালো শর্ত প্রস্তাব করা হবে
। এককালে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতার অবস্থানে ছিল ভারত। তবে এ তালিকায় এখন চীন এক নম্বরে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার নেওয়া মোট ঋণের ৫২ শতাংশই দিয়েছে বেইজিং। কলম্বো চীনকে আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ঋণের একটি বড় অংশ মওকুফ চাইতে পারে।
তবে এই অগ্রাধিকারের আশ্বাসও দেনা নিয়ে আলোচনায় গতি আনতে পারেনি। বিপদের ওপর বিপদ, সম্প্রতি নিউইয়র্কের আদালতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থদাবির মামলা করেছে হ্যামিলটন রিজার্ভ ব্যাংক। সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফের সঙ্গে চুক্তির পরও অব্যাহত থাকবে কলম্বোর দুর্দশা।
সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক বন্ডে ৫০ শতাংশ ছাড়; দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের ২৫ শতাংশ দেনা মওকুফ হলেও আগামী ১০ বছরে শ্রীলঙ্কা সরকারের দেনার বোঝা জিডিপির ১৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বন্ডের বর্তমান সুদহারে। যা বর্তমানে জিডিপির ১২০ শতাংশ বলে জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার গবেষণা সংস্থা ভেরিটে রিসার্চ। নীতি গবেষণা সংস্থাটির প্রক্ষেপণ অনুসারে, বর্তমান বৈদেশিক ঋণের ম্যাচুরিটির মেয়াদ ১০ বছর বর্ধিত করা হলেও এই বোঝা কেবল জিডিপির ১০১ শতাংশে নামবে। সংকট এখানেই শেষ নয়, স্থানীয় মুদ্রায় নেওয়া ঋণ ব্যবস্থাপনাও হবে যথেষ্ট জটিল।
এর মধ্যেও সবকিছু ঠিক থাকলে চা রপ্তানি, টেক্সটাইল ও পর্যটন খাতের সুবাদে বর্তমানে উৎপাদনে যে ১২ শতাংশ সংকোচন দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। ডলারের চাঙ্গাভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ধীরে ধীরে লঘু হতে থাকায় পণ্য সংকটের অবসান হতে পারে, যা মূল্যস্ফীতিকেও কমাবে।
তবে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আস্থা ফিরতে হবে বিনিয়োগকারীদের। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহ বলেছেন, যখন দেশে অর্থনীতি বলেই কিছু নেই, তখন তা সংস্কারের চেষ্টাও বৃথা। একটি সচল আর্থিক ব্যবস্থা অবশ্য রয়েছে। এটিকে দৃঢ় করতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করে হংকংয়ের মতো নির্দিষ্ট বিনিময় হারভিত্তিক কারেন্সি বোর্ড চালু করা যেতে পারে।
আইএমএফের তাগিদে শ্রীলঙ্কার নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইন করা হয়েছে, এতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত একটি স্বাধীন মুদ্রানীতি গ্রহণে সক্ষম কাঠামো গড়ার নীতিমালা রয়েছে। ফলে বর্তমানের অবাস্তব ঋণচুক্তিগুলো হয়তো সংকট কেটে গেলে রক্ষা করতে চাইবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শ্রীলঙ্কার এ অবস্থায় আসার পেছনে রয়েছে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দেশটির রাজাপাকসে সরকার এমন কিছু প্রকল্প শুরু করে যা যথেষ্ট ব্যয়বহুল, অথচ সে তুলনায় তা প্রায় অর্থহীন। কলম্বো পোর্ট সিটি এমনই এক প্রকল্প। শ্রীলঙ্কা তাদের রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্রের বুকে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে একটি শহর তৈরি করছে। ২৫ বছরে এই প্রজেক্টে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়।
এই অর্থের জন্য চীন থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার উচ্চসুদে ধার নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এ ছাড়াও হাম্বানটোটা বন্দর ও শ্রীলঙ্কা একইভাবে লোনের ফাঁদে পড়ে ৯৯ বছরের জন্য চীনা কোম্পানিকে দিতে বাধ্য হয়েছে। ঋণ পরিশোধের জন্য হাম্বানটোটা বন্দরসহ তার পাশের ১৫ হাজার একর জমি নিয়েছে চীন, যেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে।
আগামী ৪০ বছর ধরে এই শিল্পাঞ্চলে চীনা ব্যবসায়ীরা করমুক্ত ব্যবসা করবে। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলার শুধু চীন থেকে নেওয়া। এখান থেকে তেমন লাভ হয়নি শ্রীলঙ্কার। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে কর কমান।
সরকারি কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়। এতে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায়, যার জন্য সরকার বাধ্য হয় বিদেশ থেকে ঋণ নিতে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেও একই নীতি নিয়েছিল; কিন্তু তখন করোনা মহামারি বা যুদ্ধ থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় উৎস তাদের পর্যটন শিল্প। করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির অর্থনীতি। পর্যটন ও বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের থেকে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হতো শ্রীলঙ্কার; কিন্তু করোনার জন্য এসব সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দেশটির অর্থনীতি বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসেবে অর্গানিক চাষকেই দায়ী করা হয়। গত বছর ২৯ এপ্রিল শ্রীলঙ্কা সরকার সব কেমিক্যাল সার আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা চাইছিল শ্রীলঙ্কাকে অর্গানিক চাষের মডেল হিসাবে তুলে ধরতে।
তবে গোটা দেশকে রাতারাতি অর্গানিক চাষের দেশ হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত ছিল চরম ভুল। এর ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে গেল। কারণ রাতারাতি কেমিক্যাল সার উৎপাদন বন্ধ করে দিলে খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কম হওয়ায় রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায়। চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়। শ্রীলঙ্কা আগে চাল আমদানি করত না।
এখন তারা অন্তত ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল ক্রয় করে। সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে চায়ের উৎপাদন অর্ধেক কমে যাতে পারে। অর্গানিক চাষের ফলে দাম বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য চা রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বৈদেশিক রিজার্ভে। চা উৎপাদনে ৮৯ শতাংশ কেমিক্যাল সার দরকার, রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়ে।