অসম্পূর্ণ বই উৎসব

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:১৩ পিএম | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:০২ পিএম

 পুরো সেট বই আসতে সময় লাগবে। ছবি: সংগৃহীত

পুরো সেট বই আসতে সময় লাগবে। ছবি: সংগৃহীত

১ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বই বিতরণের মাধ্যমে পালিত হয়েছে বই উৎসব। তবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি।

জানা যায়, এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই দেওয়া হচ্ছে। ভালো মানের মণ্ডের সংকটসহ কিছু কারণে এবার সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে মানসম্মত বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় ২৮ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ২০ শতাংশের মতো বই ছাপাই হয়নি।

ফলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অনেক জায়গাতেই শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পায়নি। এমনকি কোনো কোনো জেলায় দু-একটি শ্রেণিতে গতবারের বই দিয়ে উৎসব করে আবার ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব বই না পৌঁছলেও উৎসবে কমতি ছিল না। শিশুরা নাচ-গান, আবৃত্তি আর উল্লাসে উৎসব রঙিন করে তোলে।

দরপত্রে দেরি করা এবং কাগজের বাজারে অস্থিরতা থাকায় ঠিক সময়ে সব বই স্কুলে স্কুলে পৌঁছাতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানে ছাড় দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রকাশকরা। সরকার তাতে শেষ মুহূর্তে সায় দেওয়ার পর অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো শুরু হয়, তবে সেই কাজও শেষ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো।

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, এবার অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। মেল্ডের (কাগজ তৈরির মণ্ড) দাম বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। জাতীয় স্বার্থে লোডশেডিং করতে হয়েছে। ফলে কিছু কিছু জায়গায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়। ফলে ছাপার মানের কারণে কিছু ভুল বা ‘প্রিন্টিং মিসটেক’ থাকতে পারে। সেগুলো পরে ঠিক করা যাবে। 

মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক খাদিজা ইসলাম সুপ্তি জানান, তাদের স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো বই-ই আসেনি। ক্লাস ওয়ান ও টুয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া যায়নি। অন্যান্য ক্লাসে দুই-তিনটা করে বই এসেছে। পুরো সেট বই আসতে সময় লাগবে।

কবে নাগাদ বই আসবে, সে বিষয়েও আমরা সঠিক জানি না, তাই অভিভাবকদের এ ব্যাপারে জানাতে পারছি না। মগবাজারের বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াসিন কোনো বই পায়নি। এই স্কুলের তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বই পায়নি। ইয়াসিনের বাবা মোহাম্মদ আজহার বলেন, “স্কুল থেকে বলেছে- বই এলে মেসেজ দেবে। ও বইয়ের অপেক্ষায় ছিল, এখন একটু মন খারাপ।”

পল্লবীর লিটল ফ্লাওয়ারস প্রিপারেটরি স্কুলের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী কোনো বই-ই পায়নি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৩টি করে বই পেয়েছে। রাজধানীর বাইরের অনেক শিক্ষার্থীও ২০২৩ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যবই এখনো না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। সাভারের রাজাশন ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুলাইমান হককে বই নিয়ে আসার জন্য বছরের প্রথম দিন সকালে স্কুলে যেতে বলা হলেও সে কোনো বই পায়নি। সুলাইমান বলেন, সকাল ১০টায় স্কুলে বই দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিল না, ছোট ক্লাসেও অনেকে বই পায়নি। বড়রা আবার বই পেয়েছে।

রাজধানীর মণিপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা জানান, তার সন্তান তিনটি বই (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) পেয়েছে। বাকি তিনটি বই গতকাল পায়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ইংরেজি ভার্সনে পড়ুয়া নবম শ্রেণির একজন অভিভাবক জানান, তার সন্তান চারটি বই (জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি) পেয়েছে।

প্রাথমিকের বই উৎসব উদ্বোধন ঘিরে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার কেদারগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ১০ শিশু শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দেওয়া হয়।

কিন্তু অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থল ছাড়লে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দেওয়া বই ফিরিয়ে নেন শিক্ষকেরা। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এখলাছ হোসেন জানান, ‘টোকেন’ হিসেবে অনুষ্ঠানমঞ্চে তাদের হাতে দেওয়া বইগুলো ছিল ২০২২ সালের। যে কারণে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, প্রায় ৮০ ভাগ বই দেওয়া হয়েছে। এ মাসের মধ্যে সারা বাংলাদেশে শতভাগ বই দিতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

নীলফামারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন বলেন, জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৭১৮ জন। এসব শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ করা হয়েছে ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৯টি। এ পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৫০ ভাগ বই হাতে এসে পৌঁছেছে। বাকি বই চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পাব বলে আশা করছি। সেখানে মাধ্যমিকে ৫ শতাংশ বইয়ের ঘাটতি রেখেই বই উৎসব হয়েছে বলে জানান তিনি।

শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে বই উৎসব করা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সেই সঙ্গে আমরা আশা করব, সামগ্রিকভাবে শিশু শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার আরও আন্তরিক হবে। বেশ কিছু বই এখনো বিতরণ করা যায়নি। ছাপাখানা থেকে এসে পৌঁছায়নি। আমরা আশা করব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাবে।

পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিকে ইতোমধ্যে ৭২ শতাংশ বই সারাদেশে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এবার প্রাথমিকের টেন্ডার জটিলতার কারণে বই ছাপানোর কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। প্রাথমিকের যেসব ছাপাখানা বই মুদ্রণের সাথে জড়িত, তাদের সাথে ৩ ডিসেম্বর এনসিটিবিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রীসহ আমাদের মিটিং হয়েছে।

সেখানে কাগজের মানে ছাড় দেওয়ার পরে প্রেস মালিকরা প্রাথমিকের কাজ শুরু করেছে। সেই হিসেবে জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত তারা কাজ শেষ করার সুযোগ পাবে। আর মাধ্যমিকে বই তৈরির কাজ শেষ দাবি করে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় ৩০/৩১ ডিসেম্বর বই গেছে। উপজেলা থেকে বিদ্যালয়ে নিয়ে বই বিতরণ করতে সময় লাগছে। কয়েক দিনের মধ্যেই মাধ্যমিকের বই বিতরণ শেষ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ফরহাদ।

তবে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, শিক্ষার্থীকে সব বই দিতে পুরো জানুয়ারি মাস লেগে যাবে। প্রাথমিকের ৪০ ভাগ বই ছাপানো এখনো বাকি আছে। আর মাধ্যমিকের বাকি আছে ২০-২৫ ভাগ। এ পরিস্থিতির জন্য কার্যাদেশ দেরিতে পাওয়া আর কাগজের সংকটকে দায়ী করেন তিনি।

২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার মোট ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের হাতে নিজ নিজ মাতৃভাষার বই তুলে দেওয়া হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh