এম এ আলামিন
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪০ পিএম | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এসেছে প্রায় দেড় বছর হলো। এর আগে দেশটিতে দুই দশক মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসন চলে। মার্কিন আক্রমণের মুখেই ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার ফলেই তালেবানের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়।
এবার ক্ষমতায় এলে উদারনীতি গ্রহণ করা হবে বলে তালেবান জানিয়েছিল। কারণ এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবানের শাসনকালটি কঠোর আচরণের জন্য পরিচিতি পেয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে আগের মতো কড়া শাসনে ফিরে যেতে চায়। পুরুষ অভিভাবক ছাড়া অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য ডিসেম্বরে সাদাফ (প্রকৃত নাম নয়) নামে এক নারীকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে দোররা মারা হয়েছে। সাদাফকে ৩০ বার দোররা মারা হয়। এরপর তিনি জ্ঞান হারান। আল জাজিরাকে সাদাফ বলেন, অভিযোগকারীর ছেলেকে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ক্ষোভ থেকে এমনটা করা হয়েছে।
সাদাফ তাকে বলেছিলেন, ‘ইসলামে একজন নারীর অধিকার কী, সেটা আমি জানি। তাই আমি যদি আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে না চাই, তাহলে কেউ আমাকে জোর করতে পারে না। এ কথাতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করেন।’
সাদাফ আরও বলেন, ‘আমরা জানি না কত দিন এভাবে পালিয়ে থাকতে হবে। তবে আমাদের উদ্ধার পাওয়ার একটি পথ বের করতে হবেই। আফগানিস্তান এখন এক বৃহৎ কারাগার যেখানে তালেবান চাইলে যে কাউকে কোনো কারণ ছাড়া ধরে নিয়েই নির্যাতন করতে পারে।’
গত এক মাসে দেশটিতে ১২ জন নারীসহ ৩৯ জনকে প্রকাশ্যে দোররা মারা হয়েছে। তালেবানের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ‘ব্যভিচার, ডাকাতি, সমকামিতাসহ বিভিন্ন নৈতিক অপরাধের দায়ে তাদের সাজা দেয়া হয়েছে।’ এসব ঘটনা ৯০-এর দশকে তাদের কর্মকা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। এবার ক্ষমতায় এসে আগের ভুলগুলো থেকে তারা শিক্ষা নেবে বলে সবাই আশা করেছিল।
কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। তারা ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর বন্ধ করেছে মেয়েদের ইউনিভার্সিটিতে পড়া। বিশ্ববিদ্যালয়গামী নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক শ্রেণিকক্ষ ও প্রবেশপথের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কোনো কোনো শ্রেণিকক্ষে পর্দা দিয়ে পৃথক করা হয়েছিল ছেলেমেয়েদের বসার জায়গা। মেয়েদের শুধু নারী শিক্ষক বা বয়স্ক পুরুষ শিক্ষক পড়াতে পারতেন।
মাত্র তিন মাস আগে আফগানিস্তানে হাজারো নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। মেয়েদের জন্য অনেক পাঠ্যবিষয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যেমন- পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, অর্থনীতি ও সাংবাদিকতা। এরপরও যতটুকু শিক্ষার সুযোগ ছিল সেই সুযোগটুকুও শেষ পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়। এর জন্য কর্তৃপক্ষ পোশাক বিধি না মানার কথা বলেছে। তালেবানের উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী নেদা মোহাম্মদ নাদিম রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘মেয়েরা এমনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত যেন তারা বিয়েবাড়ি এসেছে।’ ২১ ডিসেম্বর এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়।
এর কয়েক দিন পর দেশি-বিদেশি এনজিওতে নারীদের কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়। এই ক্ষেত্রেও পোশাকবিধির বিষয়টি সামনে আনা হয়। তালেবানের এই সিদ্ধান্তের পর জাতিসংঘ একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রও এর সমালোচনা করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি বিলঙ্কেন বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে নারীদের ভূমিকা প্রধান। এই সিদ্ধান্ত আফগান জনগণের জন্য বিপর্যয়কর হবে।’ সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, তারা তালেবানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে। নারীদের কাজ করার সুযোগ দেয়া না হলে তারা সেদেশ থেকে তাদের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেবে।’
আফগানিস্তানে কর্মজীবী নারীদের বেশিরভাগ এখন কর্মহীন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারী কর্মীদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এসব নারীর জায়গায় পুরুষ কোনো আত্মীয়কে নেয়া হয়েছে। ওয়াহিদা নামের একজন নারী বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘স্কুল নেই, কাজ নেই... আমাদের জন্য অন্তত এমন একটি জায়গা দরকার, যেখানে আমরা মন খুলে সময় কাটাতে পারি, কথা বলতে পারি। সারা দিন ঘরে থেকে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি।’
২০০১ সালে তালেবান বিদায় হওয়ার পর ২০ বছরে আফগান নারীদের একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে মন্ত্রিসভায়ও স্থান করে নিয়েছিলেন। ২১ সালে ক্ষমতা হাতে নিয়ে তালেবান সেই দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে দেয়। শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক মেয়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। ফলে নারী ও কিশোরী মেয়েদের মধ্যে বাড়ছে বিষণœতা ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আফগান নারী ও মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে চলছে। ২৬ শতাংশ মেয়ে ও ১৬ শতাংশ ছেলের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা গেছে ২৭ শতাংশ নারীর মধ্যে। সে তুলনায় ছেলেদের মধ্যে এ হার ১৮ শতাংশ। মেয়েরা জানিয়েছে, দুশ্চিন্তার কারণে তাদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে মিশরের আল আজহার মসজিদের প্রধান ইমাম শায়খ আহমাদ আততাইব বলেছেন, নারীদের উচ্চশিক্ষা বন্ধের যে সিদ্ধান্ত তালেবান নিয়েছে সেটি ইসলামি শরিয়া আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি এর আগে আল আজহার ইউনিভার্সিটির প্রধান ছিলেন। আল আজহারকে সুন্নি ইসলামের অন্যতম কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করা হয়। তিনি বলেন, ইসলামে নারী-পুরুষ সবাইকে জ্ঞান অর্জন করতে বলা হয়েছে। ইজিপ্ট টুডে ও আলআহরাম পত্রিকায় তার ওই বিবৃতিটি প্রকাশ হয়।