সিফাতুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:১৮ পিএম
বিদ্যুৎ। প্রতীকী ছবি
শতভাগ বিদ্যুতায়নে আকাশে উড়তে থাকা বিদ্যুৎ খাতকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে ২০২২ সাল। বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং ও ব্ল্যাক আউট উন্নয়নকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে ধুঁকতে থাকা জ্বালানি খাত ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়েছে।
দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। নজিরবিহীনভাবে তেল-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। যা আগে কখনো দেখেনি দেশবাসী। ৫ আগস্ট ডিজেল ও কেরোসিনে এক লাফে ৪২ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। ৮০ টাকা দরের ডিজেল, কেরোসিন লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়।
অন্যদিকে পেট্রল অকেটেনের দামও বাড়ানো হয় সকল রেকর্ড ভেঙে। অকটেনে লিটারপ্রতি ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা লিটার নির্ধারণ করা হয়। এতে করে বাস ভাড়াসহ পরিবহন খরচও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
শুধু জ্বালানি তেলের দাম নয়, গ্যাসের দামও বাড়ানো হয় অস্বাভাবিক হারে। সার উৎপাদনে ২৫৯ শতাংশ হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, শিল্পে বাড়ানো হয় ১১.৯৬ শতাংশ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। জুনের ১ তারিখ থেকে কার্যকর করা হয় গ্যাসের নতুন দর।
শুধু গ্যাসের দর বাড়িয়ে থেমে থাকেনি, বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের পাইকারি দরও। এখানে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে রেকর্ড করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ইউনিটপ্রতি ৫.১৭ টাকা বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা করা হয়েছে। পাইকারি দর বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করার ১ মাস ৮ দিনের মাথায় দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর করা হয় নতুন দর।
পাইকারি দাম বৃদ্ধির পরপরেই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের উপর ৮ ও ৯ জানুয়ারি শুনানি তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই বিদ্যুতের দাম বাড়তে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতে বছরের সবচেয়ে সমালোচিত বিষয় ছিল গত ৪ অক্টোবর দেশের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা। দুপুর ২টা ৪ মিনিটে ব্ল্যাক আউট হয়ে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল ৫টার পর ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়।
কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে মধ্যরাত গড়িয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। ওই ঘটনার পর ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় ওই ব্ল্যাক আউটের ঘটনা জানার পরই প্রবল সমালোচনায় পড়ে বিদ্যুৎ বিভাগ।
চাহিদা বেড়ে গেলে লাইন বন্ধ করে দিয়ে সামাল দেওয়া হয়, এ জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করে থাকে এনএলডিসি (ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টার)। তারা কেন এটি সামাল দিতে পারল না সেই তোপ দাগেন বিশেষজ্ঞরা। সমালোচনার মুখে কয়েকজন অফিসারকে সাময়িক বরখাস্ত করে দায় সারে বিদ্যুৎ বিভাগ।
অন্যদিকে ২০১৫ সালের পর থেকে ক্রমে উন্নতি হচ্ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। ভোক্তারাও দিনে দিনে নির্ভার হয়ে উঠছিলেন। আইপিএস কিংবা জেনারেটর সেবা থেকে বেরিয়ে বিদ্যুৎ লাইনের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন ২০২১ সালে এসে। সেই ভরসার জায়গায় বড় আঘাত আসে ২০২২ সালে। বছরজুড়েই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হয়েছেন ভোক্তারা। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল বিদ্যুতের লোডশেডিং।
জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিংয়ে যায় বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রথমে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও পরিস্থিতিও মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। প্রথম দিকে বলা হয়েছিল অক্টোবর নাগাদ লোডশেডিং বন্ধ হবে। অক্টোবরে লোকজন যখন লোডশেডিং কমবে আশা করেছিলেন, তখন হঠাৎ করেই বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
কয়েক বছর যাবৎ দিনে টুকটাক লোডশেডিং হলেও রাতে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হতো। এর সঙ্গে অভ্যস্ত গ্রাহকরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না গভীর রাতের লোডশেডিং। সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য শতভাগ বিদ্যুৎ ম্লান হয়ে যায় লোডশেডিংয়ের কারণে।
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিয়ে। বিএনপির পক্ষ থেকেও ব্ল্যাক আউট ও লোডশেডিং নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, প্রশ্নবিদ্ধ উন্নয়নের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। এটাই শেষ নয়, আরও ঘটবে।
জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ব্ল্যাক আউটের সঙ্গে নাশকতার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারা (বিএনপি) যে ভাষায় কথা বলছে, আরও ঘটবে, তাতে করে শঙ্কা করা যেতেই পারে ওই ঘটনার পেছনে তাদের হাত থাকতে পারে। না হলে তারা কীভাবে নিশ্চিত হন আরও এমন ঘটনা ঘটবে।
বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারেনি জ্বালানি খাত। যে কারণে আজকের এই জ্বালানি সংকট বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। ধুঁকতে থাকা জ্বালানি বিভাগ গ্যাস আমদানি করে ঘাটতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তারপরও লেগেই ছিল গ্যাসের ভয়াবহ সংকট।
বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে কখনো অর্ধেক কখনো অর্ধেকের কম সরবরাহ দেওয়া হয়। শিল্প এবং আবাসিকেও গ্যাস সংকট ছিল নিত্যদিনের চিত্র। সংকট মোকাবিলায় সিএনজি ফিলিং স্টেশন ৫ ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
তারপরও সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যায় এলএনজির দাম। সেই ধাক্কা সামাল দিতে অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, শেষ পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার।
এতে গ্যাস সরবরাহ কমে গিয়ে সংকট বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ঠিক কবে নাগাদ গ্যাস সংকট দূর হবে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর মিলছে না। বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমে আসা পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে আমদানি বন্ধ থাকবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
বিপর্যয়ের মুখে থাকা গ্যাস সেক্টরে ৩ এপ্রিল আরেকটি দুর্যোগ নেমে আসে। গ্যাসের সঙ্গে বালি চলে আসায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড বিবিয়ানার ৬টি কূপ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই গ্যাস ফিল্ডটি থেকে অর্ধেকের বেশি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। দৈনিক ১২শ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদিত হওয়া ফিল্ডটির উৎপাদন ৮শ মিলিয়নে নেমে আসে। এতে করে পুরো বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
তখন ছিল রমজান মাস, দেশজুড়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট সামাল দিতে হিমশিম থেকে হয় সংশ্লিষ্টদের। রমজান মাসে ইফতার সেহরিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লোডশেডিংয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন গ্রাহকরা। অবশ্য কয়েক দিন মাথায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপগুলো উৎপাদনে আনতে সক্ষম হয় বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ।