মেট্রোরেলকে ঘিরে আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৪৩ পিএম | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৪৫ পিএম

মেট্রোরেল। ছবি: সংগৃহীত

মেট্রোরেল। ছবি: সংগৃহীত

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভয়াবহ দূষণ, তীব্র যানজট ও অন্যান্য নাগরিক বিড়ম্বনায় ঢাকার মূল অংশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে আগেই। আশেপাশে সৃষ্ট পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোও বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে।

তবে আশার আলো দেখাচ্ছে মেট্রোরেল। আর এ রেলে চড়েই মতিঝিল থেকে উত্তরা পৌঁছানো যাবে মাত্র ৪০ মিনিটে। ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের নাগরিকদের খরচ ও সময় অনেকাংশে কমে আসবে। আবার একে ঘিরে তৈরি হবে নতুন কর্মস্থল।  

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী। উত্তরার বর্ধিত এ অংশটি সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোর একটি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবাসন সমস্যা নিরসনে এটি সাজানো হয়েছে। যদিও মেট্রোরেল পাল্টে দিচ্ছে এর ভবিষ্যৎ; এলিট শ্রেণির কাছেও এখন প্রকল্পটি সমান জনপ্রিয়।

ফলে এ অঞ্চলে আবাসন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নতুন প্রকল্পের জন্য ওই এলাকাকেই বেছে নিচ্ছে। রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে বরাদ্দ পাওয়া প্লটগুলোতে গড়ে উঠছে সুরম্য আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। স্থানান্তর হচ্ছে অনেক অফিস।

সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান। আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল কাছাকাছি দূরত্বে হওয়ায় পুরো এ অংশজুড়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মচঞ্চলতা; যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

জনবহুল ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান পরিবহন সংকট ও দুঃসহ যাটজট নিরসনে নেওয়া কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় তৈরি করা হবে মোট ছয়টি ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ উদ্বোধন দিয়ে দেশের যোগাযোগ খাত প্রবেশ করেছে নতুন এক যুগে। এর বাইরে এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৫: নর্দান ও সাউদার্ন রুট এবং এমআরটি লাইন-৪ নামে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে।

এর মধ্যে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণ হচ্ছে এমআরটি-১ প্রকল্পটি। ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে লাইনটি অবশ্য দুটি অংশে বিভক্ত। একটি অংশ বিমানবন্দর থেকে যাবে কমলাপুর পর্যন্ত, যাকে বলা হবে বিমানবন্দর রুট। দেশের প্রথম পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল হবে এটি। আর দ্বিতীয় লাইনটি নতুনবাজার থেকে যাবে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত, যার নাম পূর্বাচল রুট। এরই ধারাবাহিকতায় মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা শহরকেও মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যোগাযোগের জন্য কম খরচ ও কম সময় নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই বাধাহীন মেট্রোকে ঘিরে এরই মধ্যে উত্তরা, মিরপুর ও পল্লবী এলাকায় গড়ে উঠছে আবাসন হাব। উত্তরা ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর সেক্টর, উত্তরা ওয়েস্ট অ্যাভিনিউ, পঞ্চবটি, মিরপুর ১১ ও ১২; পল্লবী, বিরুলিয়া এলাকায় শতাধিক নতুন আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং প্রতিষ্ঠান।

এর মধ্যে দিয়াবাড়ীর পশ্চিমপাশে উত্তরা ওয়েস্ট অ্যাভিনিউ এলাকায় নতুন প্রায় ১০টি আবাসন প্রকল্পের কাজ চলছে। পল্লবী, মিরপুর-১১ ও ১২, মাটিকাটা ও কালশি এলাকায় চলছে ৩০টিরও বেশি নতুন প্রকল্প। এছাড়াও আরও ২০টি আবাসন প্রকল্পের কাজ চলছে বিরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড ও ঢাকা বোট ক্লাবের আশপাশে। এর সবগুলোই বিস্তৃতি লাভ করছে মেট্রেরেলকে ঘিরে। আবাসন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নতুন এসব আবাসন প্রকল্পে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে নতুন করে লক্ষাধিক লোক বসবাসের সুযোগ পাবে। 

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রতি এক কিলোমিটার পরপর একটি করে স্টেশন হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়াবাড়ী এলাকায় আছে তিনটি স্টেশন। সেগুলো দিয়ে উত্তরা এলাকার প্রায় ২ লাখ যাত্রী প্রতিদিন যাওয়া-আসা করবে বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজলও এমনটা মনে করেন। 

তিনি বলেন, ‘মানুষ চায় যানজটমুক্ত যাতায়াত। তাই মেট্রোরেল ঘিরে আমাদের আবাসন ব্যবসার নতুন দ্বার খুলছে। শুধু উত্তরা, দিয়াবাড়ী, মিরপুর ও পল্লবী কিংবা আশপাশের এলাকায়ই নয়, মেট্রোরেল রুটের স্টেশনগুলো কেন্দ্র করেও অনেক নতুন আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব এলাকায় লাখের বেশি লোকের আবাসন সমস্যার সমাধান হবে।’ 

এদিকে মেট্রোরেল স্টেশনকেন্দ্রিক নতুন আবাসিক এলাকা তৈরি করতে চায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (রাজউক)। এর জন্য একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। মূলত এটি একটি নীতিমালা তৈরির কাজ, যা ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের ট্রানজিট স্টেশনভিত্তিক পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিতসহ যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ বিষয়ে গত ১০ জুন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রাজউক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মধ্যে একটি রেকর্ড অব ডিসকাশন্স স্বাক্ষর হয়। 

এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘এমআরটির উত্তরা সেন্টার ও নর্থ স্টেশন ঘিরে রাজউকের যে কমার্শিয়াল প্লট ছিল, সেগুলোতে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) বাস্তবায়নের জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বাকি যে কমার্শিয়াল প্লটগুলো আছে সেখানে রাজউক তার ২৫০ মিটার রেডিয়াস ধরে একটি টিউডি বাস্তবায়নের জন্য কনসেপচুয়াল ধারণাপত্র প্রস্তুত করেছে। জানুয়ারি মাসেই সব স্টকহোল্ডারের সঙ্গে সভা করে সেটি উপস্থাপন করা হবে, তাদের মতামত নেওয়া হবে। যদি চূড়ান্ত হয়, তখন সেটা বাস্তবায়নের জন্য রাজউক ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যৌথ উদ্যোগে কার্যক্রম গ্রহণ করবে।’

পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটাতে মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পটি বেশ ভালো ভ‚মিকা পালন করবে। তবে এ রেললাইনকে ঘিরে শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এখন থেকেই সঠিক পরিকল্পনার মধ্যে না আনলে সামনের দিনগুলোতে স্টেশনকেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নও (টিওডি) অপরিকল্পিত হতে পারে বলে আমাদের শঙ্কা। তাই আগে থেকেই বিষয়গুলোর দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh