দুবাইয়ে শত শত বাংলাদেশির বিলিয়ন ডলারের ‘প্রপার্টি’

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:৫৬ পিএম

দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা। বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনেও বাংলাদেশিদের ব্যক্তি মালিকানায় সম্পদ রয়েছে। ছবি: এএফপি।

দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা। বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ভবনেও বাংলাদেশিদের ব্যক্তি মালিকানায় সম্পদ রয়েছে। ছবি: এএফপি।

‘এমনিতেই নাচুনে বুড়ি। তার ওপর ঢোলে বারি’ প্রবাদ বাক্যটি সেসব বাংলাদেশিদের জন্য ফলে গেছে যারা দেশের বাইরে তথ্য গোপন করে সম্পত্তি অর্জন করেন তাদের জন্য। আরেকটি ভেঙে বললে এমন করে বলতে হয়, অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন যারা তথ্য গোপন করে বা প্রকাশ্যে বিদেশে সম্পদ অর্জনের জন্য মুখিয়ে থাকলেও কোন দেশ বাছাই করবেন তা খুঁজে পান না। এদিকে, আরব দেশ দুবাই সেই দেশ যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও এই পথে পা হেঁটেছেন।

এভাবেই দুবাইয়ে বসবাসকারী নাসির হোসাইন আক্ষেপ করছিলেন প্রতিবেদকের সাথে।

এদিকে,  যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির ব্যক্তি মালিকানায় কোটি কোটি ডলারের ‘প্রপার্টি’ রয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে এসব সম্পদের মোট মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। 

তবে প্রকৃতপক্ষে সেসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশিদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে নাসির হোসাইন জানান, দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাতে শত শত বাংলাদেশি দেদারসে বিনিয়োগ করছেন। তবে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে আরো একটি বিশেষ তথ্য জানিয়েছেন। সেটি হলো, যেসব বাংলাদেশি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দুবাইয়ে বসবাস করছেন তাদরে জীবনযাপন ও সম্পদের পরিমাণও ততটা বিলাসবহুল না যতটা সম্প্রতি সময়ে প্রবেশ করা কতিপয় বাংলাদেশিরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন এবং সম্পদ অর্জন করছেন।

তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেন, যারা বাংলাদেশ থেকে টাকা বিপুল পরিমাণে লুফে নিতে পারছেন তারাই সম্প্রতি বিদেশে গিয়ে দেদারসে টাকা উড়াচ্ছেন এবং সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে, দুবাইয়ে বসবাসকারীসহ বিভিন্ন সূত্রের অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো তথ্য অনুযায়ী, ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির পরিসংখ্যানটি করা হয়েছে সি৪এডিএসের ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে। এরপর গত দুই বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের প্রপার্টি ক্রয়ের প্রবণতা আরো ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন বাংলাদেশিরা। যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করে গেছেন। 

বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের গোপনে কেনা প্রপার্টির অর্থমূল্য এখন কম করে হলেও এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। করোনাকালীন সময়ে যেখানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা গেছে সেই সময়েও দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশী প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা ছিলেন শীর্ষে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি প্রবাসী বলেন, বাংলাদেশের বিত্তবানদের কাছে নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দুবাইকে বিবেচনা করতেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ আকর্ষণ রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন তারা। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে।

এদিকে, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিদেশি ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে দেশটি। আরেক দিকে বাংলাদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ও শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় এখান থেকে দুবাইয়ে অর্থ পাচার বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির হিসাব অনুযায়ী, দুবাইয়ে মোট প্রপার্টির বাজার ব্যাপ্তি ৫৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ আছে বিদেশি মালিকানায়। তথ্য গোপনের কারণে এর মধ্যে সাত শতাংশ প্রপার্টি মালিকের জাতীয়তা নিশ্চিত করা যায়নি। সার্বিকভাবে প্রপার্টি খাতের বিদেশি মালিকের হার চিহ্নিত ২৭ শতাংশের চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে দুবাইয়ে বিদেশিদের মালিকানাধীন প্রপার্টির মূল্য অন্তত ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। দুবাইয়ের অফশোর প্রপার্টির বাজার ব্যাপ্তির দিক থেকে এখন লন্ডনের অফশোর প্রপার্টির বাজারের দ্বিগুণেরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে। যদিও দুবাইয়ের মোট জনসংখ্যা লন্ডনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে বৈধ কোনো উপায়ে বৃহৎ বিনিয়োগে বিদেশে প্রপার্টি কেনার সুযোগ নেই। সে হিসেবে এখানে যে বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে, ধরে নিতে হবে এর সিংহভাগই হয়েছে অবৈধভাবে পাচারের মাধ্যমে। দুবাই এখন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় গন্তব্য হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এ প্রবণতা চালু থাকার দুটি কারণ। প্রথমত, দুবাই সরকারও সেখানে বিদেশ থেকে অর্থ নিয়ে আসাকে উৎসাহ দেয়। তারা নানাভাবে এর সুযোগ দেয়। অর্থের উৎস সম্পর্কেও জানতে চায় না। যেনতেনভাবে এলেও বিদেশি পুঁজিকে তারা উপভোগই করে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশেও এর প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে এখানকার কর্তৃপক্ষ খুব একটা উচ্চবাচ্য করে না। কারণ পাচারকারীরা ধনী ও প্রভাবশালী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, দেশের ধনী পুঁজিপতিদের কাছে একসময় অর্থ পাচারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য ছিল সিঙ্গাপুর ও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। এখন সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে দুবাই। এক্ষেত্রে পাচারের প্রধান মাধ্যম এখন হুন্ডি। আবার বড় ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেও টাকা পাচার করছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh