আসছে ভোট, বাড়ছে জোট

আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১৬ এএম | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১৭ এএম

দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। ছবি: সংগৃহীত

দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। ছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছর। এর মধ্যেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ভোটের নানা সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। বড় দলগুলো দেশের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপতরাও জোরদার করেছে। একই সঙ্গে কদর বেড়েছে ছোট ও নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। এসব দল নিয়ে তৈরি হচ্ছে জোট-উপজোট।

ভোটের মাঠে এসব দলের প্রভাব না থাকলেও রাজপথে শক্তি দেখাতে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে টানছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোট এলেই জোট বাড়ে, আবার ভোট শেষ জোটও শেষ। এই রীতি দীর্ঘদিন থেকেই চলছে। এসব দল ভোটের মাঠে খুব একটা প্রভাব ফেলতে না পারলেও ‘অনেক দলের সমর্থন আছে’- এ কথা জানান দিতেই কাছে টানে বড় দলগুলো। 

বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। এই দলগুলোই কেবল নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কারও তেমন ভোট নেই। তবে নিবন্ধন বাতিল হওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভোট রয়েছে। এই চারটি দলই বেশিরভাগ ভোট পেয়ে থাকে।

এছাড়া দু-একটি ইসলামভিত্তিক দলেরও নির্ধারিত কিছু ভোট রয়েছে। এর বাইরে আরও প্রায় দেড় শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে যারা দলীয় প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে পারে না। অন্য কোনো নিবন্ধিত দলের প্রতীকে অথবা স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন এসব দলের প্রার্থীরা। এসব নিবন্ধনহীন দল ও ছোট রাজনৈতিক দলগুলোই মূলত ভোটের আগে জোটে ঢোকার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে থাকে। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, রাজনীতিতে ছোট দলকে জোটে টানার বিষয়ে মতাদর্শিক বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এর মধ্যে বড় যে দলের সঙ্গে মতাদর্শগত মিল থাকে ছোট দলগুলো সেখানেই ভেড়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে দলগুলো যুক্ত হয় তারা বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধারণ করে। বিএনপির ক্ষেত্রেও তাদের মতাদর্শের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন দলগুলোই জোটে টানেন তারা।

তিনি আরও বলেন, ছোট দলগুলো অনেক সময় বড় দলগুলোর কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গেলে সমালোচনা করে। এছাড়া এই দলগুলোর খুব বেশি পপুলার সাপোর্ট না থাকলেও এই ব্যক্তিবর্গকে সবাই কমবেশি চেনেন, তাদের কথাবার্তা জনগণ শোনেন। তাই বড় দলগুলো মনে করে, এদের  একটি-দুটি সিট দিয়ে যদি সঙ্গে রাখা যায় তো থাকল।

সমালোচনা যাতে না আসে তার জন্যও অনেক সময় বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে জোটে জায়গা দিয়ে এবং দু-একটি আসন দিয়ে চুপ রাখতে চায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচনে জয়ের পর বড় দলগুলো ছোট দলগুলোর খুব একটা খোঁজ রাখে না। কয়েক বছর পর ক্ষমতাসীন দলের এমন অবজ্ঞার পর ছোট দলগুলো একত্রিত হয়ে আবার সমালোচনা শুরু করে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পুরনো মিত্র ১৪ দলকে নিয়ে রয়েছে মহাজোট। তবে নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল নতুন আরও কয়েকটি রাজনৈতিক মিত্র খুঁজে নিতে পারে। জোটের শরিকদের সঙ্গে টানাপড়েন কমিয়ে আনার পাশাপাশি সমমনা ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে দলটি।

নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়াও ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো জোটে না যাওয়ার ঘোষণা এলেও দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিএনপির সঙ্গে জোট করতে চান বলে জানিয়েছে দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। তবে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ মনে করেন, লাঙ্গল আগের মতো নৌকাতেই নিরাপদ। এমতাবস্থায় গত ১ জানুয়ারি জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে কেন্দ্রীয় সব নেতাই আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই মুহূর্তে কোনো জোটে নেই। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে ২০ দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দিয়েছে বিএনপি। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণ-সমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে বলে দেওয়া হয়, এখন থেকে কেউ যেন ২০ দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। তবে দলটি এবার যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।

পাশাপাশি সরকার গঠন করতে পারলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার করার ঘোষণা দিয়েছে। রাজনীতি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি জোট না করলেও এই ঘোষণার মাধ্যমে রাজনীতিতে দলটির সঙ্গী বাড়ানোর ঘোষণা স্পষ্ট। এর ফলে বিএনপি-জামায়াত জোটের ‘বদনাম’ ঘুচবে। জামায়াত থাকার কারণে যারা বিএনপির সঙ্গে আসার ব্যাপারে দ্বিধায় ছিল তাদের জন্য এবার বিএনপির জোটে থাকা সহজ হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জোটবদ্ধ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সক্রিয় করেনি।

নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের ৮ আগস্ট সাত দলীয় জোটের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব এই মঞ্চের ঘোষণা দেন। জোটভুক্ত দলগুলো হলো- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বিএনপি জোট ভাঙার পর একই বছরের ২২ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘১২ দলীয় জোট’। 

২৮ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ১১টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ আত্মপ্রকাশ করে। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এগিয়ে নিতে ১৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘সমমনা গণতান্ত্রিক জোট’। ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি সাইদুর রহমান, জিয়া নাগরিক সংসদের সভাপতি মাইনুদ্দিন মজুমদার, ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্টের সভাপতি আজিজুল হাইয়ের নেতৃত্বে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আত্মপ্রকাশ হয়। তবে এই জোটে থাকা একটি রাজনৈতিক দলেরও ইসির নিবন্ধন নেই।

একই দিন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বে ১৭টি দল নিয়ে ‘গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চ’ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালুর নেতৃত্বাধীন জোটটি এখনো কোনো দলকে সমর্থন দেয়নি। ছালু জানান, ভোটের মাঠে দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারার বাইরে কেউ নেই। একদল ক্ষমতায় থাকে, অন্যদল ক্ষমতার বাইরে। আমরা জোট গঠন করেছি তৃতীয় একটি শক্তি হওয়ার জন্যই।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বলয়ের বাইরের সমমনা দলগুলো নিয়ে আরও কয়েকটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। পাঁচটি দল নিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, এটি এখনো আলোচনা পর্যায়ে আছে। এই জোটের তিনটি দলের নিবন্ধন আছে। এগুলো হলো গণফোরাম, সিপিবি ও বাসদ (খালেকুজ্জামান)।

২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্য জোট কোনো জোটে নেই। এ দুটি দল নিবন্ধিত। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত মজলিস (ইসহাক) কোনো জোটে নেই। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদের নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে।

সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বাধীন ‘বাম গণতান্ত্রিক জোটে’ এখন চারটি দল রয়েছে। এই জোট বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে আছে। ভোটের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোট বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh