স্পিকার নির্বাচনে ট্রাম্পপন্থিদের ভেলকি

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:২০ এএম

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়ার পরই মোটামুটি জানা ছিল, নিম্নকক্ষের সংখ্যালঘু নেতা কেভিন ম্যাকার্থি এবার স্পিকার হচ্ছেন। কিন্তু ১৪ দফা ভোটেও কোনো সুরাহা হয়নি। অবশেষে ১৫তম বারের ভোটাভুটিতে অচলাবস্থার অবসান হয়। স্পিকার নির্বাচিত হন কেভিন ম্যাকার্থি।

১৬৪ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা দেখা যায়নি। কার্যত এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পপন্থিরা তাদের ক্ষমতার একটা শোডাউন দিয়েছেন। তারা বুঝিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প না থাকলেও ট্রাম্পবাদ সহসাই যাচ্ছে না। 

প্রতিনিধি পরিষদের আসনসংখ্যা ৪৩৫। এর মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির সদস্য ২২২ জন ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ২১২ জন। স্পিকার হতে ম্যাকার্থির প্রয়োজন ছিল ২১৮ ভোট। তবে ছয়জন রিপাবলিকান ভোটাভুটির সময় উপস্থিত থাকলেও ভোট দেননি। শেষ পর্যন্ত ২১৬-২১২ ভোটে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হ্যাকিম জেফ্রিসকে পরাজিত করে স্পিকার নির্বাচিত হন ম্যাকার্থি। 

এর মধ্য দিয়ে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার নির্বাচনে গত ১৬৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ভোটাভুটির অবসান হলো। স্পিকার নির্বাচনে একাধিকবার ভোটের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ১৪ বার। এর মধ্যে ১৮৫৫ সালে স্পিকার নির্বাচনে রেকর্ড ১৩৩ বার ভোট হয়েছিল। ১৯২৩ সালে স্পিকার নির্বাচনের ভোটও তিন দিন প্রলম্বিত হয়। তখন নবম দফার ভোটে স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

স্পিকার হলেন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সভাপতি। সভাপতিকে ছাড়া কংগ্রেস কোনো কাজ করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতার সমর্থন ছাড়া স্পিকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কংগ্রেস অচল। গত নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের হাত থেকে হাউসের দখল ছিনিয়ে নিয়েছিল রিপাবলিকানরা। কিন্তু ম্যাকার্থির ‘পথের কাঁটা’ হয়ে ওঠেন তারই দলের নেতা তথা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মূলত ট্রাম্পপন্থি ২০ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতার বাধাতেই স্পিকার নির্বাচিত হতে পারছিলেন না তিনি। 

এবার হাউসে রিপাবলিকানদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তারা মাত্র কয়েকটি আসন বেশি জিতে ডেমোক্র্যাটদের পেছনে ফেলেছে। এই অবস্থায় দলের মধ্যে মধ্যপন্থি ও দক্ষিণপন্থিদের লড়াই একেবারে সামনে এসে পড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এই লড়াই চলছিল। স্পিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তা তীব্র হয়েছে। ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে ডানপন্থিদের এই বিদ্রোহ ব্যক্তিগত বিরোধ ছাড়িয়ে মতাদর্শিক বিরোধে গড়িয়েছে। বিদ্রোহীরা কেন্দ্রীয় সরকারের আকার, কাজ ও কাজের পরিধিকে ব্যাপকভাবে সীমিত করতে চান। আর কংগ্রেস এই কাজ যাতে সহজভাবে করতে পারে, সেভাবেই কংগ্রেসের কার্যপ্রণালিতে সংস্কার আনতে চান তারা। অচলাবস্থা কাটাতে নিজ দলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসেন ম্যাকার্থি। তাদের কিছু দাবি-দাওয়াও মেনে নেন তিনি।

ট্রাম্পপন্থিরা যে আলোচনায়

যেসব আইনপ্রণেতা স্পিকার নির্বাচনের ভোটাভুটিতে ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তারা উগ্র-রক্ষণশীল ‘ফ্রিডম ককাসের’ সদস্য। তাদের অনেকে ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে আসছেন। ২০২০ সালের ওই নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে হেরে যান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কারচুপির অভিযোগ এনে তখন এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, নির্বাচনে তার বিজয় ‘ছিনিয়ে’ নেওয়া হয়েছে।

ম্যাকার্থির স্পিকার পদে বসতে যে ২০ আইনপ্রণেতা বিরোধিতা করছেন, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যান্ডি বিগস। অ্যারিজোনার এই আইনপ্রণেতাকে ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে প্রথম দফায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও তিনি নিজেরটিসহ মোটে ভোট পেয়েছেন ১০টি। বিদ্রোহী ট্রাম্পপন্থিদের অন্যতম ম্যাট রোসেনডেল। গত ৩ ডিসেম্বরই তিনি বলেছেন, বিগত ১০ বছরে প্রতিনিধি পরিষদে যারা রিপাবলিকান পার্টির নেতা ছিলেন, তারা কেউ গ্রহণযোগ্য নন।

তবে এবারের বিদ্রোহে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন এলিস স্টেফানিক। ২০১৪ সালে প্রথম প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। সেই সময় পরিষদের সবচেয়ে কম বয়সী নারী সদস্য ছিলেন তিনি। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির নামকরা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব পলিটিকসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। নিউইয়র্কের আইনপ্রণেতা এলিস স্টেফানিক মধ্যপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে এখন কট্টর ডানপন্থি হিসেবে বেশ সক্রিয় তিনি। সম্প্রতি যারা ট্রাম্পকে জোরালো সমর্থন দিচ্ছেন, তাদের একজন এই নারী।

আলোচনায় ট্রাম্পই থাকছেন

২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রচারে যে সমর্থন তিনি পেয়েছেন; সেই সঙ্গে জাতীয় বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে ট্রাম্প বরাবরই প্রেসিডেন্টের বিপরীতে এক বিকল্প ক্ষমতা চর্চা করে আসছেন। যেমনটা অন্য কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বিতর্কিত হলেও ট্রাম্পের মতো শক্তিশালী ইমেজ রিপাবলিকান দলে অন্য কারও নেই বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার ব্যাপারে ট্রাম্পের প্রার্থিতার বিপরীতে আর তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন জাতীয় নীতির মূলে রয়েছে বিভাজনের রাজনীতি। এর মধ্য দিয়েই ক্ষমতা কাঠামো টিকে রয়েছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্ণবাদী বিভাজন কমিয়ে আনার। আরও প্রতিশ্রুতি ছিল, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবেন। তবে এর কোনোটিই সম্ভব হয়নি। বরং মার্কিন সমাজে বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে। যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটে মার্কিন পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নাগরিকের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে দুটি নীতি অনুসরণ করে। একটি আচরণ নীতি সাদাদের জন্য, একটি কালোদের জন্য।

এই দুটি নীতি সহজাতভাবেই পৃথক ও অসম। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের পীড়নমূলক আচরণ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। দেশটিতে পুলিশিংয়ের মারাত্মক বর্ণবাদী বাস্তবতা এবং পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রাণ হারানোর ঘটনার সমর্থনে মার্কিন নেতৃত্বের দৃঢ় অবস্থান পরিস্থিতিকে আরও শ্বাসরোধকর করে তুলেছে। মার্কিন সংস্থাগুলো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মানবিক আচরণের যোগ্য হিসেবে আমলে নিতে চায় না।

‘শ্বেতাঙ্গদের সেবা ও সুরক্ষা সবার আগে’- এটাই তাদের সামাজিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। যা সামাজিক বিভক্তির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মার্কিন সমাজে গত ৭০ বছরের মধ্যে এ বিভক্তির দেয়াল বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছেন ট্রাম্প ও তার বিভাজনের রাজনীতি, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

কার্যত ক্ষমতায় না থেকেও ট্রাম্প ক্ষমতাচর্চা করে চলেছেন তার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের রাজনীতি ও মার্কিন সমাজে বর্ণবাদী বিভাজন আরও জোরালো হওয়ার কারণে। আর এর মধ্য দিয়েই নিজের ভবিষ্যৎ দেখছেন। ট্রাম্প জনগণের নৈরাশ্য, অনিশ্চয়তা, হুমকি ও ভয়কে জনপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। সমস্যার সমাধান হোক বা না হোক, তিনি এসব সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমর্থকদের মধ্যে আশা জাগাতে সক্ষম। যেটাকে বলা হয়, ‘সাংস্কৃতিক হতাশাবাদের’ সুযোগ নেওয়া। আর এটিই ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh