এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৫৯ পিএম
পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। ছবি: সংগৃহীত
চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রথম ধাপে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। এ পদ্ধতিতে পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিক্ষকদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে না পারায় এর শুরুটা খানিকটা এলোমেলো হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২৪ সালে নতুন পাঠ্যক্রম কার্যকর হবে। পঞ্চম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নতুন বই পাবে। আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জের জন্য শিশুদের আরও ভালোভাবে তৈরি করার লক্ষ্যে পাঠ্যক্রম সংশোধন করেছে সরকার। বিদ্যমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকরা।
ফলে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে না পারলে নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল মিলবে না। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে বিদ্যালয়ের সক্ষমতা। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও বিদ্যালয়ের সক্ষমতা না বাড়িয়েই তড়িঘড়ি করে শুরু করা হয়েছে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন। ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের ক্লাসও শুরু হয়েছে। বদলে ফেলা হয়েছে পাঠ্যবই। তবে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় ক্লাসে পড়াতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে। তবে সেটি করতে হলে দরকার পর্যাপ্ত সময় ও প্রস্তুতি। বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ভালো কিছু বয়ে আনবে না। বলা হচ্ছে, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখবে। সেটা করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বিজ্ঞান বিষয়ে হাতে-কলমে শিখতে হলে সব স্কুলে গবেষণাগার সমৃদ্ধ হতে হবে। বিষয়ভিত্তিক দক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। যেহেতু শিক্ষকদের সময় ও শ্রম বেশি দিতে হবে, সে কারণে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুবিধার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। আর এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নইলে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করলেও ফল সেভাবে আসবে না।
কারিকুলাম উন্নয়ন ও পুনর্বিবেচনা বিষয়ক কোর কমিটির সদস্য মোহাম্মদ তারিক আহসানের মতে, পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং গাইড দেওয়া। এক্ষেত্রে এর কোনোটিই করা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনে ৪ লাখ ৩ হাজার শিক্ষক ২ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, ‘নতুন পাঠ্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকায় একটি বড় পরিবর্তন আসবে এবং তাদের প্রশিক্ষণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক পাঠ্যক্রম) এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এখন শিক্ষকদের জন্য অনলাইন প্রশিক্ষণ সামগ্রীর চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে কাজ করছে। এটি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রকাশ হওয়ার কথা আছে।
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক শিক্ষকরা বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ২ ঘণ্টার অনলাইন প্রশিক্ষণটি এখনো সম্পন্ন করা যায়নি। প্রত্যেকের ৫ দিনের প্রশিক্ষণ আগামী ৩ মাসের মধ্যে শেষ হবে। দেরির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা গত এপ্রিলে টাকা পেয়েছি এবং তারপরই রমজান চলে আসে। তাই আমরা সময়মতো এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারিনি।
তবে আমরা মনে করি না যে এটা নিয়ে শিক্ষকদের কোনো অসুবিধা হবে। প্রাথমিক স্তর আগে থেকেই দক্ষতাভিত্তিক ছিল।’ সাধারণত প্রথম বছরে প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তক পরীক্ষামূলকভাবে সংস্করণ করা হয় এবং পরবর্তী বছরের মুদ্রণে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়। তাই প্রয়োজনে বইগুলো সংশোধনের সুযোগ থাকবে বলে জানান হাসান।
মাধ্যমিক স্তরে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো
৬২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়েছে এবং শিক্ষকদের ইতোমধ্যেই একটি গাইড সরবরাহ করা হয়েছে। এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যক্রম) মশিউজ্জামান বলেন, ‘এর ফলে শ্রেণিকক্ষে পাঠ প্রদানে শিক্ষকদের খুব বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।’
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৮ হাজার ৮৭৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৩৭ লাখ শিক্ষক ৮৯ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। নতুন কারিকুলামে দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা হবে না এবং তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের পরীক্ষা হবে না।
প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক শিক্ষকদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের তাদের সংশ্লিষ্ট দুই অধিদপ্তর এই প্রশিক্ষণ দেবে। সারা দেশে প্রায় ৪ লাখ শিক্ষককে এই প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া অনলাইন প্রশিক্ষণে সার্ভার জটিলতায় মাধ্যমিকের প্রায় ১ লাখ শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি।
সব স্কুলে ক্লাস শুরু না হলেও জানুয়ারির ছুটির দিনগুলোয় ফের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এখনো চললেও আগেই শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের পড়াশোনা। ফলে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই কতটা সফলতার সঙ্গে শিক্ষকরা পড়াতে পারবেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘বছরজুড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে। কয়েকটি ধাপে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রথম দিকে শিক্ষকরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও পর্যায়ক্রমে তা আর থাকবে না।
এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫টি বিষয়ে
সংশ্লিষ্ট শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পর ২ ধাপে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং উভয় পর্বের ফলাফল মিলিয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা হবে।
কী থাকছে নতুন শিক্ষাক্রমে
নতুন শিক্ষাপদ্ধতিতে দশম শ্রেণির আগ পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা হবে না। প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষা হলেও সেটি হবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক, নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে। একাদশ শ্রেণিতে যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীকে দশটি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে।
বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপরেই এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আলাদা দুটি বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল।
মূল্যায়ন হবে যেভাবে
চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি অংশের মূল্যায়ন হবে সামষ্টিকভাবে। বাকি পাঁচ বিষয়ের পুরোটাই মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ সামষ্টিক ও ৩০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
সামষ্টিক মূল্যায়নও এখনকার মতো পরীক্ষানির্ভর হবে না। অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমে কাজ পদ্ধতির মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। ফল প্রকাশও এখনকার মতো গ্রেডিং সিস্টেমে হবে না। প্রারম্ভিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও পারদর্শী স্তর এই তিনটি ধাপে ফল প্রকাশ করা হবে।