অচিন গাঁয়ের খোঁজে...

সজল জাহিদ

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:০৮ পিএম

গ্রামের মেঠো পথ। ছবি: সজল জাহিদ

গ্রামের মেঠো পথ। ছবি: সজল জাহিদ

আজকাল শুক্র-শনি এলেই মনের মধ্যে একটা আকুলিবিকুলি শুরু হয়ে যায়, কোথায় যাই, কোথায় যাই! পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে, দিনে গিয়ে আবার দিন ফুরোবার আগেই ফিরে আসার মতো করে কোথাও। শুক্র-শনি আসার আগেই মনে মনে একজন কাউকে খুঁজি, যে মনের মতো হবে, যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারবে, কোনো কিছু নিয়ে কোনো অভিযোগ করবে না, সামনে যা আসবে, যা পাবে তাই উপভোগ করার মানসিকতা থাকতে হবে।

এমন কেউ হবে, যে দরকার হলে মাইলের পর মাইল বা শহর, নগর, বন্দর হেঁটে উপভোগ করতে পারবে বা চাইবে। যদিও আমার তালিকায় এমন বেশ কিছু মানুষই আছে, যারা একই মানসিকতার, কাছাকাছি ভাবনার আর সময়কে নিজের মতো করে উপভোগ করার মতো। কিন্তু তারপরও সবার সঙ্গে সময়ের মিল হয়ে ওঠে না বলে সেভাবে ইচ্ছে হলেই যে কোনো জায়গায় বেরিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাই খুঁজতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় আর অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হয়।

অথচ আজ থেকে প্রায় দু বছর আগেও শুক্র-শনি আমার কাছে তেমন গুরুত্ব পেত না। তখন অপেক্ষায় থাকতাম লম্বা ছুটির, সেমিস্টার ব্রেক বা ঈদের ছুটির। সেই লম্বা ছুটির জন্য বিশাল বিশাল এক একটা প্ল্যান করতাম, কখনো বন্ধু, কখনো সহকর্মী আর কখনো পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু সেই সব দিন আর নেই, আর আসবে কিনা সেও কেউ জানি না।

তাই বলে তো ঘরে বসে থেকে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তাই একটা সময় মাসে বা দুমাসে যার অপেক্ষায় থাকতাম, এখন সেটা সপ্তাহে এসে ঠেকেছে। তাই তো শুক্র-শনি এলেই মনটা আনচান করতে থাকে কোনো নদী, বন, নীরব গ্রাম অথবা লোকালয়হীন চরে গিয়ে সারাদিন কাটানোর জন্য।

তবে আজকাল আর একা একা বের হতে ইচ্ছে হয় না। সঙ্গে কেউ একজন থাকলে ভালো হয়। যার অন্যতম কারণ হলো এই শহর আর তার আশপাশের অঞ্চলগুলোতে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে নানা রকম বিড়ম্বনা, নিরাপত্তার অভাবসহ অনেক কিছুই। তাই সঙ্গে কেউ একজন সমমনা থাকলে সবদিক থেকেই নানারকম সুবিধা পাওয়া যায়। 

দুই সপ্তাহ আগে গিয়েছিলাম গাজীপুর, কাপাসিয়া হয়ে সাইকেল চালিয়ে কিশোরগঞ্জ। পরের সপ্তাহে নানা রকম ব্যস্ততায় কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু গত সপ্তাহে হুট করেই সমমনা এক ভ্রমণসঙ্গী সাইকেলে করে পদ্মার পারে এক অচিন গাঁয়ের খোঁজ দিলেন এবং সেই সঙ্গে প্রস্তাব দিলেন শনিবার ফাঁকা থাকলে সেখানে যেতে পারি দুজন মিলে। আমি রাজি, মনে মনে এমন কাউকেই খুঁজছিলাম। তাই আর দেরি না করে পরের দিনের সকালের ডে প্যাক প্রস্তুত করে, খুব ভোরে বেরিয়ে পড়েছিলাম নামাজ পড়েই।

একজনের বাসা বনেদি ধানমন্ডি আর আমার বাসা নিম্নমধ্যবিত্ত মিরপুর। দুজনের দেখা হবে বসিলার মোড়ে। সেই মতে সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম সারাদিনের জন্য ঢাকা শহরের হর্ন, ধোঁয়া, গরম, জ্যাম আর কোলাহল থেকে একটু দূরে যেতে। মোটামুটি চল্লিশ মিনিটে মিরপুর থেকে সাইকেলে বসিলা। একটু সময়ের মধ্যেই তুষার ভাইয়ের আগমন।

তারপর তার প্ল্যানমতো একটু এগিয়ে সিএনজি স্টেশনে গিয়ে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে নিয়ে, তার মধ্যে নানা কায়দা আর কসরত করে দুটো সাইকেলকেই এক সঙ্গে করে বেঁধে একজন ভিতরে আর একজন সামনে বসে এক অন্য রকম আর নতুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নেওয়া শুরু করলাম।

বসিলা থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে, দোহার উপজেলার পদ্মার তীর ঘেঁষে থাকা ছোট লোকালয় বাহ্রাঘাট। মাঝে পেরিয়েছি কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, কিছুটা মানিকগঞ্জও মনে হয়। চমৎকার মসৃণ পথে, দুপাশের নানা রকম সবুজ আর নানা রকম ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ, কয়েকটি সেতু পেরিয়ে ঠিক সকাল আটটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম পদ্মা নদীর ঘাটে। সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের অচিন গাঁয়ের দিকে যাওয়ার বোট ছাড়বে। পাড়ি দিতে হবে বিশাল পদ্মার অনেকটা।

তারপর নেমে যাব পদ্মার মাঝে জেগে ওঠা চরের এক অচিন আর নিখাদ গাঁয়ের ঘাটে। তারপর সারাদিন আমি আর আমার ভ্রমণসঙ্গী বসব, হাঁটব, গড়াব, ভিজব, গোসল করব, সাইকেল চালাব, নদীর তীরে গাছের ছায়ায় বসে বসে গল্প করব, ঝড় বৃষ্টি উপভোগ করব, আর শেষ বিকেলে আবারো নদী পার হয়ে যে যার ঘরে ফিরব।

এই পরিকল্পনা নিয়ে, পদ্মা ঘাটের ছোট হোটেল থেকে পরাটা আর ডিম ভাজি কিনে নিয়ে, উঠে পড়লাম নৌকায়। ঢেউয়ের দোলায় নাশতা খাব আর মজা করে নৌকার পাটাতনে শুয়ে বসে নদীতে ভেসে চলা, দূরের গ্রাম, অজস্র পানি, মুক্ত আকাশ, হু হু বাতাস উপভোগ করব মনপ্রাণ ভরে! আর নদী পার হওয়ার পর সারাদিনের জন্য তো রয়েছেই নানা রকম নতুন নতুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর গল্প।

অচিন নদীর এপার-ওপার

বেশ হেলেদুলে নৌকায় পদ্মার ঢেউ উপভোগ করে পৌঁছে গেলাম ওপারে। বেশ বড় আর অনেক পুরনো একটা চর। চমৎকার সবুজে ঘেরা, নির্জন একটা জায়গা। শুধু নদীর বাতাস, ঢেউয়ের শব্দ আর পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘাটে নেমে বালুচর পেরিয়ে সাইকেল ঠেলে নিয়ে সরু পথে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছোট্ট একটা মাচা আছে ঘাটের নৌকার মাঝিদের বসার জন্য। সেখান থেকে জেনে নিলাম দিনের শেষ নৌকা কটায় ছাড়বে।

তারপর আমরা অজানা অচেনা গন্তব্যের দিকে সাইকেল চালাতে শুরু করতেই, একটা ছোট দোকান চোখে পড়ল। চা আছে কিনা জানতে চাইলাম। চা হবে জেনে চায়ের জন্য আবার দাঁড়ালাম, কারণ এদিকে সারাদিন আর চায়ের কোনো জায়গা বা দোকান না-ও পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য পাওয়া যাবে না বলাই ভালো। তাই সেই ছোট দোকানে চা খেয়ে সঙ্গে একটা বাড়তি পানির বোতল নিয়ে চলতে শুরু করলাম।

একপাশে বেশ উত্তাল পদ্মা, বালুচরের পরে সবুজের শেড আমাদের কাঁচাপাকা সাইকেল চালানোর পথ আর অন্যপাশে অদূরে গ্রামের পরিত্যক্ত জমি, ডোবা-নালা আর বেশ দূরে কিছু ঘর-বাড়ির অবস্থান বোঝা যাচ্ছে। আলো রোদ ছায়া আর বেশ গরমে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। একদম নিখাদ প্রকৃতি যাকে বলে, চারদিকে শুধু সেসবের ছড়াছড়ি। একটা ছোট্ট বাজারের মতো পড়ল কিছুটা এগিয়ে যেতেই। যার সঙ্গেই লাগোয়া পদ্মা নদীর একদম তীর ঘেঁষে বিশাল এক সবুজ ঘাসের কোমল মাঠ। দেখেই লোভ জাগল সেখানে একটু থামার। থেমে গেলাম ইচ্ছে হতেই। সাইকেলে ভ্রমণের এই এক বিশাল সুবিধা।

যখন, যেখানে ইচ্ছে, থেমে যাওয়া যায়, আবার চলার ইচ্ছে জাগলেই চলতে শুরু করা যায় নিজের খেয়ালখুশি মতো! মাঠে একটু হেঁটে, কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে বাজার পেরিয়ে নিখাদ গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচাপাকা, ইট বিছানো পথে হেলেদুলে চলতে শুরু করলাম। গ্রামের সরু পথ, ধানক্ষেত, গরু-ছাগল এড়িয়ে বেশ সাবধানে সামনে এগিয়ে যেতেই কিছুটা খোলামেলা পথ পেয়ে গেলাম। এখানে গ্রামের শেষ হয়ে চাষাবাদের জমি শুরু হয়েছে। আর ইটের পথ শেষ হয়ে একদম মাটির রাস্তা দুপাশের জমির ঠিক মাঝ দিয়ে।

ডান পাশে হঠাৎই চোখে পড়ল টলটলে জলের বহমান একটা নদী! নদী হয়তো নয়, তবে পদ্মার শাখা-প্রশাখা-যা খালের চেয়ে বেশ চওড়া, তাই নদী বলেই মনে হয়। বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরেও তাই মনে হলো, আহা নদীর পাশে গিয়ে তো একটু বসা যেতে পারে! আবারো যেমন ইচ্ছে হয়েছে তেমন করে ফেললাম। সাইকেল ঘুরিয়ে, জমির আইল দিয়ে চালিয়ে চলে গেলাম পদ্মার সেই শাখা নদীর তীরে।

কী চমৎকার কোমল একটা নদী, মেঠো পথ নেমে গেছে জমির আইল ধরে একদম নদীতে। সহজেই সাইকেল নিয়ে চলে গেলাম একদম নদী ছুঁয়ে দেয় এতটা কাছাকাছি। ধীর লয়ে সে বয়ে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ। গ্রামের কেউ কেউ দলবেঁধে এপার থেকে ওপার গেছে, কেউ ওপার থেকে এপারে। পাশের দুটো জেলে নৌকা নাও ভিড়িয়ে দুপুরের খাবার রান্নায় ব্যস্ত।

কাঠের চুলা থেকে ধূসর কালো ধোঁয়া উড়ছে, করলায় মসলা মাখিয়ে রাখা হয়েছে তেলে মুচমুচে করে ভাজবে বলে, বড় কড়াইতে মাছ ভাজার শব্দ আর ঘ্রাণ ছুটে আসছিল নাকে মুখে। কাছে গিয়ে দুটো কথা বলে অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি ছবি তুলতেই, নদীর ওপারে চোখ চলে গেল। এপার থেকে ওপারটা বড় বেশি সুন্দর আর আকর্ষণীয় মনে হলো!

নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছ, তার শীতল ছায়া, সবুজ ঘাসের গালিচা আর শুয়ে, বসে অলস সময় কাটানোর দারুণ জায়গা। আমি আর আমার ভ্রমণসঙ্গী দুজনেই সম্মত হলাম, এপারে আর না এগিয়ে ওপারে গিয়ে, নদীর ওই ছায়াঘেরা গাছের সঙ্গে অলস সময় কাটাব। তারপর পরে সাইকেল নিয়ে গ্রামের বাকিটা দেখব সময় করে। যে ভাবনা সেই কাজ।

একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন যে আমরা যে পথে এসেছি, সেই পথেই কিছুটা ফিরে গিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে হাতের বাঁয়ে চলে গেলেই নদীর ওপার চলে যাওয়া যাবে। ছোট একটা কালভার্ট আছে তাই নদী পার হওয়া নিয়ে ভাবনা নেই। আর দেরি না করে ঝটপট রোদের তাপ থেকে রেহাই পেতে সাইকেল চালিয়ে কিছুটা উল্টো পথে গিয়ে, তিন রাস্তার মোড় পেরিয়ে অপর পাশে চলে গেলাম। 

সেখানে গিয়ে নদীর উপর কালভার্টের উপরে উঠতেই আমরা থেমে গেলাম। আসলে থেমে যেতে বাধ্য হলাম দুপাশের অদ্ভুত প্রকৃতি দেখে। নদী, বিল আর একটা জলাশয় এক হয়ে এখানে একাকার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বুনো হাঁসের ঝাঁক, রাজহাঁসের পাল, সবুজ গুল্মলতার সাজ, আকাশের মেঘ সাদা থেকে তখন ধূসর হয়ে অনন্য করে তুলেছিল চারপাশের গ্রামের প্রকৃতি।

আর বাড়তি পাওনা হয়ে পেয়েছিলাম বৃষ্টির আগের শীতল হাওয়ার পরম পরশ। সাইকেল চালানো বাদ দিয়ে, সাইকেল রেখে আমরা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম সেখানকার সবটুকু সুখ আমাদের গায়ে, পায়ে, মুখে আর স্মৃতিতে ধারণ করে নিতে।

নিস্তব্ধতার মাঝে, চারপাশের খাল, বিল, নদী আর জলাশয়ের পাশের, গাছ ঘাস লতাপাতা আর হাঁসেদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম এমন অদ্ভুত নীরব, নির্জন আর নিরাপদ গাঁয়ে পথ হারিয়ে নিজেদেরকে খুঁজে ফিরে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। সে এক অদ্ভুত আর অবাক করা রোমাঞ্চ আমাদের উপহার দিয়েছিল অচেনা সে গ্রামের মাঠ, ঘাট আর ঝোপঝাড়।

ঝোপঝাড়ে হারিয়ে যাওয়া...

অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছিলাম এক অচিন নদীর তীরে। মেঘলা আকাশ আর শীতল বাতাস গায়ে মেখে শান্ত হয়ে তারপর আবারো এগিয়েছিলাম সামনের দিকে। দুপাশে জলাশয় আর মাঝখানে একটা ধবধবে সাদা মাটির পথ। উঁচু নিচু আর কিছুটা অসমতল। যে কারণে পাহাড়ি পথ না হয়েও চলতে হচ্ছিল ঢেউ খেলে। কয়েক মিনিট এগিয়ে সামনে বেশ কিছুটা উঁচুতে উঠি এগিয়ে যেতে থাকলাম। বেশ সোজা পথেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

কিন্তু যেতে যেতে হুট করেই হাতের বাঁয়ে আখক্ষেত আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটা সরু পথের মতো এঁকেবেঁকে চলে যেতে দেখা গেল। জঙ্গলের মধ্যের সেই সরু পথ দেখে মাথায় খেয়াল চাপল, আচ্ছা এমন সোজা পথে আরাম আয়েশে না চালিয়ে একটু অ্যাডভেঞ্চার করলে কেমন হয়! চলেন জঙ্গলের ভেতরের ওই সরু পথ দিয়ে নদীর তীরে গিয়ে গাছের ছায়ায় হ্যামক দুলিয়ে শুয়ে থাকি! 

আমার এ অদ্ভুত প্রস্তাবে পার্টনারও রাজি হয়ে গেল! ব্যস, ভাবনার বাস্তবায়ন করতে নদীর তীরে হ্যামক ঝুলিয়ে গাছের ছায়ায় আরাম করব বলে অচেনা সেই জঙ্গলের সরু পথে নেমে গেলাম সাইকেল নিয়ে। শুরুতে বেশ মজাই আর রোমাঞ্চকর লাগছিল অমন পথে সাইকেল চালাতে। বিশাল বিশাল ঘাস, লতাপাতা ছেয়ে থাকা পথ, মাঝে মাঝে জমে থাকা পানি কাদা মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া। বেশ ১০/১৫ মিনিট যাওয়ার পরও নদীর দেখা মিলছে না বলে ভাবলাম আর একটু সামনে এগিয়ে দেখা যাক। সাইকেল আর চালানোর কোনো পথ নেই সামনে। তাই সাইকেল হাত দিয়ে ঠেলে এগোতে লাগলাম। কিন্তু না, সামনের ঘাস, গাছ, লতাপাতা এত ঘন আর বড় যে পায়ে হেঁটেও এগিয়ে যাওয়া মুশকিল, চালানো তো অসম্ভব। 

তখনো যদি একই পথে ফিরে আসি তবু রক্ষা হয় বা হতো, কিন্তু না অ্যাডভেঞ্চার করার খায়েশ জেগেছে মনে তাই পুরনো পথে ফিরে না গিয়ে, আরও কিছুটা ঘুরো পথে, আইলের পাশের খুব সরু পথ ধরে নদীর দেখা পেতে আর একটা দুটো গাছের ছায়ার খোঁজে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে নদীর অবয়ব বোঝা গেলেও যতই কাছে যাই নদী যেন ঠিক আগের মতোই দূরে থেকে যাচ্ছে! কোনো রকমে সেই ঘাস লতাপাতা জঙ্গলের পথে এগিয়ে যেতে যেতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু তবু মনের মতো করে গাছের ছায়া আর হ্যামক ঝুলানো যাবে এমন নদীর তীরের দেখা পেলাম না।

তাই বাধ্য হয়ে ফেলে আসা বড় মাটির পথ খুঁজে পেতে চাইলাম। কিন্তু যে পথে এসেছি সেটা অনেকটা পথ আর নানা রকম ঝামেলার, তাই সেই পথে না গিয়ে সামনে গিয়েই সেই পথের দেখা পেতে চাইলাম। আইল ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতে একটা ট্রাক্টরের দেখা পেলাম, কয়েকজন মিলে আখের ক্ষেতে কাজ করছে।

কিন্তু সেটা বেশ দুর্গম বলে ট্রাক্টরের রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে অনেকটা সামনে চলে গেলাম। এরপর আবার হুট করেই সামনে আর কোনো রাস্তা নেই! আবারও ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ঠাসা চারদিক! এত বড় বড় ঘাস, গাছ আর লতাপাতা যে সাইকেল চালানো দায়। তবু আইলের পাশ ধরে একটা আম বাগানের কাছে গিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া হলো। পানি দিয়ে তৃষ্ণা আর ক্লান্তি দূর করা হলো, তারপর আবারও কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে এক কৃষকের দেখা পেলাম।

তার কাছে রাস্তা বা নদীর তীরে যাওয়ার দিক জেনে নিয়ে নদীর দিকেই এগোতে লাগলাম। এবার আর নদীর তীরে হ্যামক ঝুলিয়ে শুয়ে থেকে আরাম করার জন্য নয়, এবার নদীর ওপার গিয়ে সকালের পথে, পদ্মার তীরে দেখে আসা গাছের ছায়ায় বসার জন্য। কিন্তু একবার অ্যাডভেঞ্চারে নামলে প্রকৃতিও বুঝি অ্যাডভেঞ্চারের মজা বোঝাতে চায়, তাই তো কোনো রকমে হাঁপিয়ে গিয়ে নদীর তীরে পৌঁছতে পারলেও সেখানে কোনো নৌকা, মাঝি বা খেয়ার দেখা মিলল না কিছুতেই! আর এত এত প্রখর রোদ ছিল যে দাঁড়িয়ে থাকাও দায় হয়ে গিয়েছিল। একটাও গাছ ছিল না যে তার ছায়ায় দাঁড়ানো যায় কিছু সময়। বাধ্য হয়েই আবারও সাইকেল নিয়ে পিছনের দিকে ফিরে আসতে হয়েছিল। 

বেশ কিছুটা পিছনে ফিরে এসে আবার একজন কৃষকের সঙ্গে দেখা হয়। তার কাছ থেকে মাটির পথের দিশা নিয়ে, ঘাস, গাছ, লতাপাতার জঙ্গলের পথ চলতে শুরু করেছিলাম। এই পথে দেখা পেয়েছিলাম দারুণ দুটি ঘোড়ার, যারা সবুজ মাঠে মনের সুখে ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছিল। একটু পরেই পেয়ে গিয়েছিলাম সমতল আম বাগানের দেখা, যে বাগানের মধ্যে ঢুকতেই অদূরে দেখা পেয়েছিলাম অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলা মাটির সেই অচিন গ্রামে যাওয়ার পথ।

আর এদিক ওদিক না গিয়ে সেই মাটির মেঠো পথ ধরে সোজা চলে গিয়েছিলাম আর একটা নদী বা খালের পাড়ে। যেখানে বাঁধা ছিল একটা খেয়া নৌকা, কিন্তু তাও নদীর অপর পারে! তবে আমাদের দেখে, অদূরের দোকান থেকে হাঁক দিয়ে আনা হয়েছিল নৌকার মাঝিকে। যার খেয়া নৌকায় করে টলটলে জলের খাল পেরিয়েছিলাম দুজনে দুটো সাইকেল নিয়ে। 

খেয়া পার হতে হতেই জেনেছিলাম, আমাদের খুঁজে পেতে চাওয়া সেই অচিন গ্রাম নাকি এই নদীর ওপারেই আর একটু সামনে এগোলেই! 

এই সেই অচিন গাঁ!

টলটলে জলের ঝলমলে খাল পার হলাম কচকচে সবুজে ঘেরা চারপাশে চোখ বুলিয়ে। ঝোপঝাড়ে পথ হারিয়ে এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে খাল পেরিয়ে, নৌকা থেকে কোনো রকমে সাইকেল তুলেই কাছের দোকানের সঙ্গে লাগোয়া গাছের ছায়ায় খালি গা হয়ে এলিয়ে পড়লাম। অথচ দোকানের সঙ্গে আছে বাঁশের মাচা, মাথার উপরে ছাউনি। সেসবের দিকে কোনো খেয়াল ছিল না। পার্টনার একটা সেভেন আপ কিনে নেওয়ার জন্য ডাকাতে সেদিকে খেয়াল হলো। একদম ঠান্ডা একটা সেভেন আপ যে সেই সময় কী পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত তা বলে বোঝানোর নয়। সেভেন আপ নিতে গিয়ে মনে পড়ল নিয়াজ মোর্শেদ ভাইয়ের সেভেন আপের সঙ্গে খাবার স্যালাইন মিশিয়ে আরও বেশি এনার্জি বাড়িয়ে নেওয়ার কথা! সেই সঙ্গে হয় বাড়তি টেস্ট। 

তাই তো দোকান থেকে একটা খাবার স্যালাইন কিনে সেভেন আপে মেশাতে গিয়ে বেশ কিছুটা পড়ে গেলেও আসলেই দুর্দান্ত লেগেছিল সেভেন আপের সঙ্গে খাবার স্যালাইনের মিশ্রণ। এরপর বেশ ভালো লাগা শুরু। তারপরও আরও কিছু সময় আরাম করে আমাদের অচিন গাঁয়ের পথ পেরিয়ে ঘুরো পথে নদী পেরিয়ে ঢাকায় ফেরার হদিস নিয়ে সাইকেলে চেপে বসলাম। কিন্তু সামনে যে এতটা ভয়ানক পথ অপেক্ষা করছে সেটা কেউ বলেনি।

অবশ্য তাদেরও দোষ নেই, কারণ আমরা একটা বাজারের পথ জিগ্যেস করায় তারা সেটাই বলেছে, আর আমরাও সেই পথটা ভুল করে, সোজা পথে চলতে গিয়েই মুশকিল বাড়িয়েছিলাম নিজেদের। সদ্য বালু আর মাটি ফেলে উঁচু করা রাস্তা, যা তখনো চলাচলের উপযুক্ত হয়নি, সেই রাস্তায় গাধার খাটুনি খেটে, মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম প্রায় ৩০ মিনিট ধরে। উফ, সাইকেল কেন, পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্যও সে এক ভয়ানক পথ! আর সেই পথই পাড়ি দিয়েছিলাম সাইকেল নিয়ে, ঘেমে, নেয়ে একাকার হয়ে। 

তবে পথের শেষেই পেয়েছিলাম দারুণ প্রশান্তির দেখা, পেয়েছিলাম সেই অচিন গাঁ! যে গ্রামের দেখা পেতে, যে গ্রামের শীতল বাতাস মেখে, হিমশীতল কলের জলে ভিজতে এতটা পথ সাইকেলে পাড়ি দিয়েছি, রাস্তা ভুল করে কষ্ট করেছি আর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে সেই গ্রামে এসে পৌঁছেছি। একটা ছোট গ্রাম, নাম যার শালিকা, অবস্থান ফরিদপুর জেলায়, কিন্তু যেতে হয় মানিকগঞ্জ হয়ে! আমরা মানিকগঞ্জ হয়ে, পদ্মা পেরিয়ে, পদ্মার চরে জেগে থাকা এই গ্রামে এসেছি, কিন্তু এসে শুনি এটা মানিকগঞ্জের কোনো গ্রাম নয়! এটা নাকি ফরিদপুরে পড়েছে! তার মানে আমরা এখন ফরিদপুর চলে এসেছি! সে তো ঢাকা থেকে বহুদূরে! 

যা-ই হোক গ্রামের মূল লোকালয় থেকেও কিছুটা বিচ্ছিন্ন একটা বাড়ির শান বাঁধানো উঠোনে, গাছের নির্মল ছায়ায় আমাদের আশ্রয় হলো। পাশেই একটা গ্রাম্য দোকান, কয়েকটি উঠতি বয়সী যুবক ক্যারম খেলছে। নানা রকম গাছের ছায়াতলেই একটা টলটলে শীতল জলের কলের দেখা পাওয়া গেল। সেই কলের শীতল জলে হাতমুখ ধুয়ে, গলা ভেজাতে ভেজাতেই মাথায় নতুন খেয়াল চাপল।

আরে,  এমন হিমশীতল কলের তলে মাথা নিচু করে দিয়ে বসে থাকি না, এক হাতে চেপে চেপে ইচ্ছেমতো ভিজি না! যে-ই খেয়াল সেই কাজ। গাছের বেদির সঙ্গে সাইকেল আর ব্যাকপ্যাক রেখে, চুপ করে গিয়ে বসে পড়লাম সেই কলের তলে। এক হাতে হাতল চেপে চেপে অন্য হাত দিয়ে নিজেকে ভেজালাম সাধ মিটিয়ে! আহা, সেই কাঠ ফাটা গরমে, অমন শীতল জলের পরশ, যে কোনো প্রার্থিত প্রেমিকার চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত! 

কী ভেজাটাই না ভিজলাম, কত সময় ধরে যে ভিজলাম, কী পরিমাণ প্রশান্তি যে পেলাম, কতটা যে তৃপ্ত হয়েছিলাম সে বলে বা লিখে বোঝাবার নয় আদৌ! সে শুধু ওই হিমশীতল কলের তলে বসে থেকে, গায়ে, পায়ে, মাথায় আর মুখে অবিরত ঝরঝর করে ঝরে পড়া জল জানে, আর জানে যে ওখানে বসে, অনন্ত সময়ের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিল! সেই শীতল জলের সুখের পরশ এতটাই আঁকড়ে ধরেছিল যে কিছুতেই আর ওখান থেকে সরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল সেই ভরদুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা আর তারপরের রাত জুড়ে শুধু ভিজি, ভিজি আর ভিজিয়েই রাখি নিজেকে অনাগত আগামীর সুখস্মৃতির জন্য!

কিন্তু আমি শুধু একাই ভিজব আর পার্টনার চেয়ে চেয়ে দেখবে তা তো হতে পারে না, তাই তাকে ভেজার সুযোগ দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতেই হলো, সুখ শীতল কলের তল থেকে। এরপর নতুন কাপড় পরে, শান বাঁধানো গাছের তলে ঝিরিঝিরি বাতাসের মাঝে শুয়ে ছিলাম এক প্রহর। চারদিকে সবুজের আচ্ছাদন, ঝিরিঝিরি বাতাস, পাখিদের কিচিরমিচির আর অদূরে বয়ে যাওয়া এক অলস নদী, যার ওপারে সরু মেঠো পথ চলে গেছে কোনো মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত হতে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে ঘুম ঘুম চোখে কাটিয়েছিলাম কতটা সময় মনে নেই ঠিক। চেতনা ফিরেছিল সেই বাড়ির মালিকের আগমনে। 

তার সঙ্গে গল্পে কথায় জেনে নিয়েছিলাম, আরও বেশি ঝামেলা পোহাতে না চাইলে ঘুরো পথে না গিয়ে ফিরতে হবে আমাদের আগের পথেই। কারণ অন্য পথে গেলে নদী পার হওয়ার নৌকা না পেলে আবারো ফিরে আসতে হবে এই পথেই! তাতে সময় যাবে অনেক আর ভাগ্য খারাপ থাকলে আবারো বইতে হবে ডাবল পথের বোঝা। তাই সেই ঝুঁকি না নিয়ে, তার দেখানো পথে, নদীর তীর ঘেঁষে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম মধ্যদুপুরে নদী পার হয়ে সেভেন আপ খাওয়ার সেই দোকানের আঙিনায়! 

আহ, সে কী আফসোস, নদীর পাড় দিয়ে যে পথ যেতে পারতাম মাত্র পাঁচ মিনিটে, সেই পথই পাড়ি দিয়েছিলাম আধা ঘণ্টায়, অমানুষিক কষ্ট করে! হায়, পথ না চিনলে বা ভুল করলে যা হয়! আবারো নদী পেরিয়ে, এবার আর কোনো আঁকাবাঁকা পথে না গিয়ে, সোজা পথে ফিরে এসেছিলাম সকালের সেই খেয়া ঘাটে, পদ্মার তীরে। কিন্তু ততক্ষণে পুরো আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা, চারদিকে ঝড়ো হাওয়া, বালুচরের ধূসর হয়ে যাওয়া আর পদ্মার তার প্রমত্তা রূপ নিয়ে নিজেকে মেলে ধরা! 

এখন তবে কী হবে? কীভাবে পার হব এই প্রমত্তা পদ্মা, কীভাবে মোকাবিলা করব বিশাল বিশাল এক একটা ঢেউয়ের আর কীভাবে টিকে থাকব প্রবল ঝড়ো হাওয়ায়!

আষাঢ়ের আকাশ আর প্রমত্তা পদ্মা!

পদ্মার পাড়ের মূল খেয়া ঘাটে যখন আমরা পৌঁছাই তখন পুরো আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা, সঙ্গে ছিল পুরোপুরি ঝড়ো হাওয়া, বালু ঝড় আর নদীতে তুমুল ঢেউ! আমি না হলেও পার্টনার কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেছে বলে মনে হলো। যদিও এমন প্রমত্তা পদ্মা আর তার প্রবল বাতাসে ওঠা উত্তাল ঢেউয়ের কাছে ঠুনকো সাঁতার তেমন কোনো কাজেই আসবে না, তবু সাঁতার জানা থাকলে সেটা মনে অনেকটা সাহস জোগায়।

যত যা-ই হোক, কিছুটা সময় তো নিজেকে ভাসিয়ে রাখা যাবে বা একটু হলেও সাঁতরে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু যে সাঁতার জানে না তার কাছে সামান্য বাতাস আর অল্প ঢেউই অনেক বড় আতঙ্কের কারণ, ভয়ের তো বটেই। 

আমার পার্টনার যে সাঁতার জানে না সেটা আমার জানা ছিল না। নদীর ঝড়ো হাওয়া, মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশ আর বিশাল বিশাল ঢেউ দেখে খেয়া ঘাটে নৌকায় না উঠে পরে ঝড়, বাতাস কমলে অন্য নৌকায় যাবে বলে প্রস্তাব দেওয়াতে আমি জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে তিনি সাঁতার জানেন না! এটা জেনে আরও বেশি অবাক হলাম এই ভেবে যে সাঁতার না জানা একজন এমন বিশাল আর বেশ ভয়ানক পদ্মা নদী পার হয়ে ওপারের অজানা চরে এসেছে সেটা ভেবে।

যা-ই হোক পরে গেলেও মন্দ হবে না। সেই সময়টা নদীর তীরে বসে বসে দারুণ ঝড় বৃষ্টি আর উত্তাল ঢেউ উপভোগ করা যাবে বলে। শুধু মনে মনে ভাবনা এই যে, নদী পার হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে ওপার থেকে বাহন পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। কারণ পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ আমরা সাইকেল না চালিয়ে যতটা পারি অন্য কোনো বাহনে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যাব।

সাইকেল ঘুরিয়ে, ঘাটের বালুচর ছেড়ে আমরা অদূরেই একটা বাঁধের মতো চওড়া রাস্তার মাথায় ঠিক পদ্মার পাড়ে গিয়ে বসলাম। শুরু হলো তুমুল বাতাস আর কালো মেঘ থেকে ঝরে পড়া দুই এক ফোঁটা করে বৃষ্টি। পার্টনার সবুজ ঘাসের মাঝে হ্যামক বিছিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল আর আমি গাছের গুঁড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে প্রমত্তা পদ্মার, আষাঢ়ের অবাক রূপের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

না, শুধু প্রবল বাতাস, কিছুটা ধূলিঝড় আর দুই-এক ফোঁটা ছাড়া তেমন বৃষ্টি আসেনি বলে আমাদের চমৎকার সেই পদ্মার তীর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়নি। প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঠায় বসে বসে প্রাণ ভরে উপভোগ করেছি পদ্মার পাড়, প্রবল বাতাস, ধূলিঝড় আর বিশাল বিশাল ঢেউ। সেদিনের মতো শেষ খেয়া যখন ছাড়ার সময় হলো, তখন উঠে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। 

নৌকায় ওঠার পর শুরু হলো নতুন রোমাঞ্চ! তখন বাতাসের বেগ কমে গেলেও, বৃষ্টি দুই-এক ফোঁটা করে পড়লেও নদীর ঢেউ আর তার আকার কমেনি কোনো কারণে। বেশ বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল নৌকার চারপাশে। দূরে তখনো আকাশে বেশ কিছুটা কালো মেঘের জমে থাকা, তাই আরো ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কাকে উড়িয়ে না দিয়ে সাবধানতার সঙ্গে নৌকায় বসলাম।

পার্টনার বেশ ভয়ার্ত মুখে, টেনশন নিয়ে আর আমি অযথা টেনশন না করে সময়টা উপভোগ করার জন্য নৌকার পাটাতনের উপর রাখা সিঁড়িতে শুয়ে পড়লাম চোখ বন্ধ করে। যা হয় হোক, যতক্ষণ নৌকা উল্টে না যায় বা ডুবে না যায় ততক্ষণ আয়েশ করে ঢেউয়ের দোলা, পানির ছিটা আর রোলিং উপভোগ করব নিজের মতো করে।

নৌকা ছেড়ে দিলো। হালকা ঢেউটা নদীর গভীরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় আর ঘন ঘন হতে শুরু করল, সেই সঙ্গে নৌকার দোলা আর পানির ছিটা আসা আমাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিজিয়ে দিতে লাগল, শুরু হলো বেশ কিছটা রোলিংও। মজা, ভয়, রোমাঞ্চ আর অজানা একটা আনন্দ মিলেমিশে একটা মিশ্র অনুভ‚তির জন্ম দিলো। কিন্তু আমার পণ, চোখ আমি খুলব না, উঠে আমি বসব না, নিজেকে আমি জোর করব না। যতক্ষণ সব ঠিক আছে, ততক্ষণ এভাবেই শুয়ে থেকে আরাম করব, আর কিছুটা অদ্ভুত আনন্দ উপভোগ করব। 

 ঢেউয়ের দোলা, পানির শীতল ছোঁয়া আর প্রবল বাতাসের প্রলেপ কখন যেন চোখে ঘুম এনে দিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। বেশ আয়েশ করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি নৌকার সামনে বিশাল বড় পাহাড়ের মতো একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল আমাদের উপর। না, নৌকা ঠিক আছে, ডুবে যায়নি, আমিও ঠিক আছি।

কিন্তু কী কারণে যেন চোখ খুলেছিলাম মনে নেই, কিন্তু চোখ খুলে দেখি, আমার পার্টনার নৌকায় নেই! নেই আমাদের সাইকেলও! উঠে নদীতে তাকিয়ে দেখি পার্টনার নদীর মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে আর সাইকেল কোনো একটা দড়ি আর নৌকার গলুইয়ের সঙ্গে ঝুলছে! তাড়াতাড়ি করে নৌকায় থাকা বড় মোটা দড়ি ফেলে দিলাম পার্টনারকে ধরার জন্য। সে দড়ি ধরলে নৌকার মাঝি আর আমি দুজনে মিলে তাকে টেনে তুললাম! এরই মাঝে বড় আর একটা ঢেউ এসে আমাকে ভিজিয়ে দিতেই তড়াক করে উঠে বসলাম। 

না, আমি আসলে ঘুমিয়েই ছিলাম, এতক্ষণ যা ঘটেছে ওটা আসলে স্বপ্ন ছিল! আমি নৌকার পাটাতনে শুয়ে থেকে, ঘুমিয়ে গিয়ে এমন অদ্ভুত ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখলাম। আসলে ততক্ষণে আমরা প্রায় নদীর তীরে চলে এসেছি! এমনিতেই উঠতে হতো, ঢেউয়ে ভিজে গিয়ে উঠে যেতেই হলো।

পাড়ে এসে নৌকা থেকে নেমে পার্টনারকে একটু আগের স্বপ্নের কথা বলতেই তার অনুরোধ, ভাই এসব লেইখেন না! বাসা থেকে তাহলে আর অনুমতি পাওয়া যাবে না! এই শুনে যাও আমার এই নিয়ে লেখার কোনো ভাবনা ছিল না, সঙ্গে সঙ্গে ওই স্বপ্নটাই আমার এই লেখাটার প্লট হয়ে গেল! 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh