অবহেলায় দেশি ফল

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:০৬ এএম | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:০৮ এএম

দেশি ফল। ছবি: সংগৃহীত

দেশি ফল। ছবি: সংগৃহীত

দেশি ফলগুলোতে রয়েছে প্রচুর খাদ্য উপাদান, কিন্তু এগুলো অবহেলিত। প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে বলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি।

অন্যদিকে দেশি ফলের গাছ রোগবালাই ও পরিবেশ প্রতিকূলতায় লড়ে টিকে থাকতে পারে বলে সহজেই আবাদ করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণেও সহায়ক হতে পারে, কিন্তু অসচেতনতার কারণে এসব ফল আর বেশি আবাদ হয় না। 

দেশি ফলে আছে খনিজ লবণ ও আঁশ- যা ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, রাতকানা রোগসহ নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে এবং রোগ নিরাময়ও করতে পারে। দেশি ফলে কম চর্বি, কম ক্যালরি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় এসব ফল মানবদেহের কোষ, টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সজীব রেখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে পারে।

দেশি ফলের পুষ্টিগুণ ও ভিটামিন নিয়ে প্রচার খুব কম হচ্ছে দেশে। বিদেশি ফলের গুণ নিয়ে প্রচার বেশি বলে মানুষ ফল বলতেই আঙুর, কমলা, আপেল মনে করে। এসব ফলেও প্রচুর খাদ্য উপাদান আছে তবে দেশি ফলেও এসবের চেয়ে অনেক বেশি উপাদান রয়েছে। দেশি পেয়ারায় আপেলের চেয়ে ২০০ গুণ বেশি ভিটামিন থাকে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। 

দেশি ফল ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ

দেশি ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। শুধু দেশি ফল নয়, সব ধরনের ফল নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন যাপন করা যায়। দেশের প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ ভিটামিন ‘এ’, ৯০ শতাংশ মানুষ ভিটামিন ‘সি’ এবং ৯৯ শতাংশ মানুষ ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। আমাদের এই পুষ্টি ঘাটতি পূরণে কমদামের দেশি ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ফল আমাদের শরীরে ভিটামিন, আঁশ ও খনিজ উপাদান সরবরাহ করে। ফল কম খাওয়া হয় বলে বাংলাদেশে ভিটামিন, আঁশ ও খনিজ উপাদানের অভাবজনিত কারণে রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, গলগণ্ড, স্কার্ভি ও বেরিবেরি রোগের হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। ফলে খাদ্য উপাদান ও পুষ্টি উপাদান রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও খাদ্য হজম, পরিপাক, বিপাক, খাবারে রুচি বৃদ্ধি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। 

দেশি ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। ফলকে ‘রোগ প্রতিরোধক খাদ্য’ বলা হলেও রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আমরা ফল খাই না। কারণ এ বিষয়ে প্রচার কম। কী কী রোগ প্রতিরোধ করতে পারে সে বিষয়েও অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষই অজ্ঞ। সে কারণে ফলকে খাদ্য হিসেবেও তেমন গুরুত্ব দেই না। পুষ্টিবিদরা একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক লোকের দৈনিক ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়ার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি মানুষ গড়ে ৭৭ গ্রাম ফল গ্রহণ করতে পারে। এই পরিমাণ আমাদের শরীরের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। 

কোন ফলে কী থাকে

ভিটামিন ‘সি’ নামক উপাদানের প্রধান উৎস ফল। অপ্রচলিত দেশি ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ থাকে। পুষ্টিবিদরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের জন্য দৈনিক ৩০ মিলিগ্রাম ও শিশুদের ২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। অপ্রচলিত ফল রান্না না করে কাঁচা বা পাকা অবস্থায় খেলে পুরো ভিটামিন ‘সি’ শরীরে কাজে লাগে। প্রায় সব অপ্রচলিত ফলে কম-বেশি খনিজ উপাদান বিদ্যমান। যেমন- কাউ ফলে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস; খেজুরে ক্যালসিয়াম, আয়রন, কপার, ম্যাগনেসিয়াম ও সালফার; আমড়াতে ক্যালসিয়াম ও আয়রন; তালে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম পাওয়া যায়। 

অপ্রচলিত ফলে প্রচুর পরিমাণে জলীয় অংশ থাকে। এ জলীয় অংশ পানির সমতা রক্ষা, খাবার হজম, পরিপাক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল রাখতে সাহায্য করে। জাম্বুরাতে ৯০ গ্রামেরও বেশি জলীয় অংশ থাকে। জামরুল, জলপাই ও কামরাঙাতে ৮০ গ্রাম থেকে ৯০ গ্রাম জলীয় অংশ থাকে। এছাড়া বেল ও পাকা তালে ৭০ ভাগের কাছাকাছি জলীয় অংশ থাকে।

এছাড়া ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আঁশ থাকে। আঁশসমৃদ্ধ ফল ক্যানসার রোধে সহায়তা করে। কালোজাম, বেল ও আতা ফলের প্রতি ১০০ গ্রামের মধ্যে ২ গ্রামের বেশি আঁশ থাকে। আমড়া ও জামরুলে এক থেকে ২ গ্রাম এবং অন্যান্য ফলে এক গ্রামের কম আঁশ থাকে। আমাদের মোট খাদ্যের শতকরা এক ভাগ আঁশ থাকা উচিত। 

অন্যদিকে ফলে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে বলে ফল খেলে কেউ মোটা হয় না, বরং সুস্থ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম অপ্রচলিত ফলের মধ্যে পাকা তাল, কামরাঙা, বেল ও আতা ফলে ৫০ থেকে ১০০ ক্যালরি শক্তি থাকে। অন্যান্য অনেক ফলে ৫০ ক্যালরির কম খাদ্য শক্তি থাকে। ক্যালরি কম থাকায় ডায়াবেটিস ও মেদবহুল লোকরা অনায়াসে ফল খেতে পারে। অপ্রচলিত দেশীয় হলুদ রঙের ফলে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন (প্রাক ভিটামিন এ) থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন ব্যক্তির দৈনিক ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম ও শিশুদের ২৫০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ খাওয়া প্রয়োজন। 

ফলে অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। ফলের খাদ্য উপাদান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে ১০ থেকে ৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়া ফলে থাকে পরিমাণ মতো ভিটামিন বি২। 

দেশি ফলগুলো অবহেলিত

আম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল, পেয়ারা, বরই, লেবু, কলা, আনারস ও পেঁপে আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল। দেশের প্রায় সর্বত্রই এসব ফল জন্মে। আবার প্রায় ৭০ ধরনের ফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে, এগুলো অপ্রচলিত ফল নামে পরিচিত। এসব ফল অবহেলিত হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের কোনোটায় ভিটামিন, খনিজ, পুষ্টিমান ও ঔষধি গুণ অনেক বেশি।

এসব ফলগুলোকে হার্বাল-আয়ুর্বেদে শাস্ত্রে মূল্যায়ন করা হয় এভাবে- ‘ঋতুভিত্তিক দেশি ফলে, সকল রোগের আরোগ্য মেলে’। এ দেশের অপ্রচলিত ফলের মধ্যে- সফেদা, কামরাঙা, লটকন, দেশি আমড়া, বিলাতি আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, কালোজাম, করমচা, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, আদা জামির, আঁশফল, দেশি গাব, বিলাতিগাব, আতা, শরিফা, কাউফল, খেজুর, জামরুল, আমলকী, টকলেবু, চালতা, ডুমুর, বৈচি, তেঁতুল, বকুল, বেতফল, ফলসা, জামরুল, বিলম্বিত (অথবা বিলিম্বি), অরবরই, লুকলুকি, তৈকুর, ডেউয়া, সাতকরা, পানি ফল, কাগজিলেবু, মহুয়া, চাপালিশ ইত্যাদি। 

নানা কারণে ও আমাদের অসচেতনতায় কিছু কিছু ফল এদেশ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম- বৈচি, লুকলুকি, আদাজামির, কাউফল, চালতা, টাকিটুকি, পানকি-চুনকি, তিনকরা, সাতকরা, আঁশফল। উপক‚লীয় অঞ্চলের একটি গবেষণা অনুযায়ী, পটুয়াখালী জেলার সাতটি উপজেলায় ৪৫ ধরনের অপ্রচলিত ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে প্রতিটি উপজেলাতে গড়ে ৩৬ ধরনের অপ্রচলিত ফল পাওয়া গেছে। 

বছরে ১ কোটি ৪৩ লাখ টন ফল উৎপাদন 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশে ৭.৩৪ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৪৩ লাখ টন ফল উৎপাদন হয়েছে বাংলাদেশে। এর আগের অর্থবছরে প্রায় ৭.২৯ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ২২ লাখ টন ফলের উৎপাদন হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১১৫ গ্রাম ফলের প্রয়োজন। এর বিপরীতে বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক গড় সরবরাহ মাত্র ৭৭ গ্রাম। অর্থাৎ মাথাপিছু দৈনিক ৩৮ গ্রাম ফল কম খাওয়া হয়। 

দেশের অবহেলিত ফলের তালিকা থেকে দেখা যায় যে কমপক্ষে ৪০টিরও কম ফল রয়েছে যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময় পাওয়া যায়। এ সব ফল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে কলা। এরপর তরমুজ, আম, কাঁঠাল ও পেঁপে রয়েছে। ২০২২ অর্থবছরে মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৭৩ শতাংশই এই পাঁচ ফল। এর আগের অর্থবছরেও একই আধিপত্য ছিল এ ফলগুলোর। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh