বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার পুনর্গঠন

এস, এম, লুৎফর রহমান

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৪৮ পিএম | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৩৩ পিএম

এস, এম, লুৎফর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

এস, এম, লুৎফর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা-উত্তর অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও সংস্কারের  উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ পুনর্গঠন।

১৯৭০ সালে সাইক্লোন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ফলে দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ে। ১৯৭০ সালে সাইক্লোনে তৎকালীন মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩.৮০% বিনষ্ট হয়। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কোনো অর্থনৈতিক বা সামাজিক পুনর্বাসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতি। বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা বা স্বর্ণ রিজার্ভ ছিল না।

দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন কাঠামো, আর্থিক কাঠামো, ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। দেশের ভেতরে ব্যাংকের বহু শাখা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, বহু শাখা লুট করা হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাঙালি ব্যাংকারকে। যুদ্ধচলাকালীন এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। 

এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ পুনর্গঠন ছিল দুরূহ কাজ। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নীতিনির্ধারণী কাজ, মুদ্রা ও ব্যাংকিং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। এই অবস্থায় পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক গতি চালু করতে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠন করা হয়। এই আদেশ কার্যকর  হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় মুশফেক-উস-সালেহীন এবং ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ প্রথম গভর্নর নিযুক্ত করা হয় এ. এন. হামিদুল্লাহকে। কোনো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও স্বর্ণ রিজার্ভ ছাড়া এবং পাকিস্তানিদের  রেখে যাওয়া ৩৫৮ কোটি টাকা দায় মাথায় নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের যাত্রা।

পাকিস্তানের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করেছিল এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে জমা দেওয়ার জন্য চাঁদা বাবদ ২০ লাখ ডলার মূল্যের স্বর্ণ কানাডা সরকারের কাছ থেকে ক্রয় করেছিল।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, ফলে স্টারলিং এলাকার সদস্য হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সদস্যপদ লাভ করেছিল; এই তহবিল থেকে নিজস্ব ভাগ বা কোটা এবং প্রত্যাহার বা ড্রইংয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যে ৯৫.০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না। পরবর্তীকালে সেই বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ১৯৭৫ সালের মার্চে হয়েছিল ১৭২.৮৭ কোটি টাকা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে দেখা যায় ব্যাংকের হাতে নগদ টাকা নেই, ব্যাংকে দায় ও সম্পদ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ঋণগ্রহীতাদের অধিকাংশ অবাঙালি যারা স্বাধীনতার আগে বা পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। যে সকল শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়া হয়েছিল তা অধিকাংশ বন্ধ এবং মালিক অনুপস্থিত। এই অবস্থায় ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থায় এই নাজুক অবস্থার সামাল দিতে এবং ১৯৭০ সালে নির্বাচনী ইস্তেহার অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংক জাতীয়করণ হয়। স্বাধীনতার পূর্বে মোট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল ২২টি। এর মধ্যে ৩টি বিদেশ ব্যাংক, ৫টি ভারতীয় ব্যাংক, ১০টি অবাঙালি পাকিস্তানি মালিকানাধীন, ২টি বাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংক এবং ২টি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক। 

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়- ১. গ্রাম অঞ্চলে শাখা সম্প্রসারণ করা। ২. ঋণ বণ্টনের ক্ষেত্রে কৃষি ঋণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন ঋণ প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া। ৩. রপ্তানিমুখী শিল্পে ঋণ প্রদান। ৪. বাণিজ্যিক লাভের চেয়ে সামাজিক লাভ ও সেবা প্রদানে অগ্রাধিকার প্রদান।

এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
১. পাট কলগুলো চালু করার জন্য তাদের স্থায়ী সম্পদের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা, তাদের নতুন বিনিময় হারে রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া হয়।
২. মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাড়ি, জমির বিপরীতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং কোনো জামানত ছাড়া ২৫,০০০.০০ (পঁচিশ হাজার মাত্র) টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়।
৩. ব্যাংকগুলোকে সুস্থ প্রতিযোগিতায় ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়।
৪. পূর্বে গৃহীত ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়।

উল্লেখিত ২২টি ব্যাংকের মধ্যে অবাঙালি পাকিস্তানি মালিকানাধীন ১০টি ব্যাংক এবং বাঙালি মালিকানাধীন ২টি ব্যাংক রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ ১৯৭২ অনুযায়ী জাতীয়করণ করা হয়। উল্লেখিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন ছিল বাঙালি মালিকদের বাকিগুলো ছিল অবাঙালি পাকিস্তানিদের। দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যা আগেই সরকারের মালিকানাধীন ছিল এ দুটির নাম পরিবর্তন করা হয়।

জাতীয়করণের থেকে বাদ দেওয়া হয় ৩টি বিদেশি ব্যাংক এবং ৫টি ভারতীয় ব্যাংককে। ৩টি বিদেশি ব্যাংক হলো
১. আমেরিকান এক্সপ্রেস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক করপোরেশন,
২. ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংক,
৩. চার্টার্ড ব্যাংক।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২টি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার প্রতিষ্ঠা করে । ১. বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা, ২. বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক

১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকার প্রতিষ্ঠা করে, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

উল্লেখিত ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংক দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। দেশের জনসাধারণের নিকট সঞ্চিত অর্থ জমাকরণ এবং জমাকৃত অর্থ উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল করার জন্য ব্যাংকের শাখার পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নেয়।

বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ব্যাংক ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছিল। ১৯৭২ হতে ১৯৭৫ পর্যন্ত কয়েকটি ব্যাংকের চিত্র দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়। 

সোনালী ব্যাংকে (কোটি টাকায়) ১৯৭২ সালে আমানত ১৭৩.১৩, অগ্রিম ৮৫.৩৭, নিট মুনাফা ০.২৪, বৈদেশিক বাণিজ্য ৪২.৪০, বিনিয়োগ ৪৬.৬, শাখার সংখ্যা ২৭ ও জনবল ৪৭০ ছিল। পক্ষান্তরে ১৯৭৫ সালে আমানত ৩৩২.৯৩ অগ্রিম ২১৫.০৫, নিট মুনাফা ৮.০৯, বৈদেশিক বাণিজ্য ৩৯৭.৫৯, বিনিয়োগ ৬৩.৬২, শাখার সংখ্যা ৪০০ ও জনবল ৬৯৮৯ ছিল। 

জনতা ব্যাংকে ১৯৭২ সালে আমানত ১৫৭.৬৯, অগ্রিম ১১৩.২০, নিট মুনাফা ১.৬০, বৈদেশিক বাণিজ্য ৭০.০০, বিনিয়োগ ২০.৪১, শাখার সংখ্যা ২৬১ ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তা দাঁড়ায় আমানত ২৯২.১১, অগ্রিম ২৫৬.৩৪, নিট মুনাফা ৯.৪৩, বৈদেশিক বাণিজ্য ৪৩৮.২৯, বিনিয়োগ ৫৩.৪৫, শাখার সংখ্যা ৩২২ ও জনবল ৪৭৯৩। 

অগ্রণী ব্যাংকে ১৯৭২ সালে আমানত ১৭৩.১৩, অগ্রিম ৮৫.৩৭, নিট মুনাফা ১.১২, বৈদেশিক বাণিজ্য ৩১.৫০ এবং শাখার সংখ্যা ২৪৬ ছিল। যা ১৯৭৫ সালে দাঁড়ায় আমানত ১৪০.৮০, অগ্রিম ১২৬.২৭, নিট মুনাফা ৫.০১, বৈদেশিক বাণিজ্য ৯৮.৯৫, বিনিয়োগ ২৭.৮০ এবং শাখার সংখ্যা ৩০৫। 

রূপালী ব্যাংকে ১৯৭২ সালে আমানত ৬২.৪৭, অগ্রিম ৫২.৭৬, নিট মুনাফা ০.৭০, বৈদেশিক বাণিজ্য ১১.১৮, বিনিয়োগ ১০.০১ ও শাখার সংখ্যা ১৫৯ ছিল। ১৯৭৫ সালে আমানত ১১১.০০, অগ্রিম ৮৯.৬৮, নিট মুনাফা ৫.০১, বৈদেশিক বাণিজ্য ১১৯.০৮, বিনিয়োগ ২৬.০৯, শাখার সংখ্যা ২২৭ ও জনবল ৩৭৪৭ ছিল।

লেখক: এস, এম, লুৎফর রহমান
সাংগঠনিক সম্পাদক,
বঙ্গবন্ধু পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh