গাড়ির নিচে লাশ, ঘাতকের মৃত্যু ও সমাজপতিরা

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:০৭ পিএম

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক প্রাক্তন অধ্যাপক কাকতালীয়ভাবে ওই ইউনিভার্সিটির সামনে দিয়ে যাবার সময় বাইকের পিছনে বসা এক নারীকে ধাক্কা দেয়। সেই নারী গাড়ির নিচে আটকে যায় ও আঘাতকারী গাড়ি না থামিয়ে চালাতেই থাকে পালাবার উদ্দেশ্যে। চারদিকে লোকজন চিৎকার করছিল কিন্তু গাড়ি থামেনি। কয়েকজন মোটরসাইকেলে পিছু নেয়। শেষে নীলক্ষেতের কাছে রাস্তা বন্ধ করে পাবলিক গাড়ি থামায়।

নারীর লাশ যায় হাসপাতালে। চালক/মালিক এবং ড্রাইভারকে পাবলিক পিটায়। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় এবং সে চালান হয় জেলে। নারী হাসপাতালে মৃত ঘোষিত হয়। আর ১৩ জানুয়ারি সেই চালকের মৃত্যু হয় বন্দি অবস্থায়। কেউ কেউ বলছেন আল্লাহর বিচার হয়েছে। হতে পারে, তবে এটা ঠিক যে গাড়িওয়ালা মানুষদের কৃতকর্মের জন্য খুব কম শাস্তি পেতে হয় বাংলাদেশে, তাই মানুষের এত আল্লাহর ওপর আস্থা। 

দুই.

ঘাতকের পরিচয়: জাফর শাহ হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, বয়স ৫৯। ঢাকার এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান যার ওই চাকরির কোনো দরকার ছিল না। শখের চাকরি বলা যায় বিত্তবানের মেধাবী সন্তানের। একসময় হয়তো বিরক্তি এসে যায়, রিজাইন করার প্রয়োজনও মনে হয়নি। জাস্ট চলে গেছে অনুমান করছি। কোন শ্রেণির বাসিন্দা বোঝা যায়। এই শ্রেণির মানুষজনই অন্যদের পাত্তা দেয় না। তারা কি খারাপ লোক? না। তাদের কি পরিস্থিতি এমন করে বানায়? জি হ্যাঁ। আমাদের ঢাকা শহরে এমন মানুষ বহু আছে। এরা বড়লোক ওপরতলার। আমরা চাই আর না চাই এরাই সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক।

তিন.

আমি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা কিসিমের দলিল সংগৃহীত হয়। একবার হঠাৎ করে একটি ফাইল পাই- প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের- যার ভেতর বেশ কিছু চিঠি ছিল। এই চিঠিগুলো হচ্ছে মৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের। অর্থাৎ যুদ্ধে নিহত সৈন্য, যাদের লাশ পাকিস্তানিরা ফেলে রেখে চলে যায়। চিঠিগুলো বেশির ভাগ ছিল লেখা; কিন্তু পাঠানো হয়নি, অর্ধ সমাপ্ত চিঠি। দুই একটা ছিল পুরো লেখা। তিনটি চিঠির কথা মনে আছে। উর্দুতে লেখা, অনুবাদ যুক্ত ছিল।

চার.

স্মৃতির ওপর নির্ভর করে তিনটি চিঠি থেকে উদ্ধৃত করার চেষ্টা করছি।

. ‘আমি ভাইজানকে লিখেছি যে উত্তর দিকের জমিতে আমরা শর্ষে চাষ করব। এটা আমরা দুই ভাই ভাগ করে নেবো। এখানকার অবস্থা ভালো না, কবে বাড়ি যাব জানি না। আমি টাকা পাঠাচ্ছি কথা মতো। জানিও পেলে কিনা।’

. তুমি হচ্ছো বাড়ির সবাইকে খেয়াল করে দেখে রাখার মানুষ। সংসার ঠিক রাখা তোমার দায়িত্ব। আমি জানি আম্মার মেজাজ অনেক খারাপ কিন্তু সে তো মুরব্বি তাই তাকে মানিয়ে চোলো। বাচ্চাদের লেখাপড়াটা সবচেয়ে দরকার। তুমি নিজে তদারকি করবে। 

. আমি এখন ছুটি পাবো না। তার মানে দেশে ফিরে বিয়ে করতে পারবো না। তারা যদি বলে যে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেবে তাহলে ঠিক আছে। যুদ্ধ শেষে ফিরবো।

পাঁচ.

আমি এই তিনটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিলাম কারণ এগুলোর লেখক তারাই যারা এই দেশে গণহত্যা চালায়, ধর্ষণ করে। তাদের মধ্যে আর যাই হোক কোনো মানবিক মাত্রা খুঁজতে যাব না। অথচ এই মানুষগুলো নিজেদের বাড়িতে যে চিঠি লিখেছে তা কত সাধারণ, স্বাভাবিক। এক পরিসরে সে দানব, অন্যটায় সে মানব। মানুষ একই। মানুষের জীবনে নানা পরিসর আছে, সেটাই তাকে দানব আর মানব বানায়। পরিস্থিতিই ভগবান। যদি পাক আর্মি আক্রমণ না করত বাংলাদেশে তবে হয়তো অনেকেই জীবনটা পার করে দিত মানব হিসেবে। 

ছয়.

এবার ফেরা যাক ঢাকায়, আজকে যে মানুষটা গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল তার এই মনোভাবের শুরুটা কই? সে বড়লোক, তার চাকরির দরকার নাই, মতিঝিলে বড় বিল্ডিং আছে, গুলশানে থাকে ইত্যাদি। গাড়ি ছিল বলেই ধাক্কাটা ঘটে, পালাবার চেষ্টাটা হয়। আজ যদি তার বিত্তের সঙ্গে সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা যুক্ত হতো তাহলে তাকে হয়তো জেলেও থাকতে হতো না।

বাংলাদেশে এটা অহরহ ঘটে। তাই এটা নিয়ে কেউ ভাবে না। সাগর-রুনি বা ইদানীং কালের ফারদিন হত্যা মামলায় পুলিশ যে সব কথা বলেছে সেটা প্রায় কেউ বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ যাই ঘটুক না কেন তার অন্য বাস্তবতা আছে শ্রেণি আর ক্ষমতার বিচারে। তবে যে ঘাতক সেও স্বাধীন না। সমাজের নিয়ম তাকে গাড়ি দিয়েছে, চালাতে দিয়েছে এবং কপাল ভালো থাকলে পালাবার সুযোগও দেয়। এটাই সত্য।

সাত.

কিন্তু যে নারী নিহত হলো তার কী ইতিহাস ও পরিস্থিতি? যে যাই বলুক যত জনই চড়ুক, বাইক নিরাপদ যানবাহন নয়। প্রচুর ধাক্কাধাক্কি দুর্ঘটনা হয়। আমার নিকট আত্মীয় বাইকার দুর্ঘটনায় মারাও গেছে। কিন্তু আমাদের এই কফিন বাক্সের মতো শহরে মধ্যবিত্তের জন্য বাইক ক্রমেই হয়ে উঠছে সবচেয়ে চালু যান। তার কোনো অন্য উপায় নাই। সে এতে যেতে বাধ্য, বিপদে পড়তে বাধ্য এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ আঘাতে মারা যেতে বাধ্য। এটা সংখ্যাতাত্ত্বিক নির্ণয়বাদী বাস্তবতা। ১০% এক্সিডেন্ট হবেই, ১% মারা যাবেই। এটা নিয়তি নয় অবধারিত। যে গাড়ি চালাবে সে ধাক্কা দেবে, যে বাইকের পিছনে ওঠে সে মরবে ধাক্কা খেয়ে।

আট.

কিন্তু অবধারিত্বের সীমানা এখানেই শেষ নয়। রোড এক্সিডেন্টের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তার মধ্যে ৮০% হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির। মানে কে মারা যাবে, কে বাঁচবে তাও নির্ধারিত হয় শ্রেণি পরিচিতি দ্বারা। আর গরিব প্রতিবাদও করে না। সেটা করে মধ্যবিত্ত, যদিও সে মরে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কম। আর বড়লোক হয় মারে না হয় গাড়ির মালিক হিসেবে কারও মৃত্যুর সহায়ক হয়। গোটা বিষয়টা সামাজিক বাস্তবতা এবং এটা সামাজিক নির্ণয়বাদ।

নয়.

কোনো মানুষ স্বাধীন নয়। শ্রেণি, সমাজ, পরিস্থিতি নির্মাণ করে তার জীবন মরণের ইতিহাস।

সাহিত্যিক, গবেষক


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh