মানসিক চাপ

কমছে সার্বিক উৎপাদনশীলতা

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৫০ পিএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৫৫ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। গুরুতর মানসিক অসুস্থতায় এদের ৮০ শতাংশ কাজ হারান। মানসিক সমস্যা হলে যে কেউ কাজে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। এ ধরনের কর্মীর কাজে কম মনোযোগ থাকে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটে এবং মনে রাখার সমস্যায় ভোগেন। ফলে তাদের কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের (ডব্লিউএফএমএইচ) প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের হাউস্টোনের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. মেলিসা জোন্স বলেন, ‘উদ্বেগের ফলে ডায়রিয়াও হয়। অনেক সময় নার্ভাস বা নতুন কিছু করার চেষ্টা করলে অনেকের পেট খারাপও হয়ে যায়। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিদের উদ্বেগ ও চাপ বেড়ে গেলে ডায়রিয়া ও মাইগ্রেনের সমস্যা বৃদ্ধি পায়।’ 

মানসিক রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ। পুঁজির বিশ্বায়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আর এতে সৃষ্ট কাজের চাপে কর্মীরা বিষণ্নতাসহ নানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক সময় অতিরিক্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে জোটে কম পারিশ্রমিক, এর মধ্যেই আবার কর্মীরা ছাঁটাইয়ের শিকার হন।

মনোযোগ দিয়ে কাজ করলেও কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনের অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে অনেকে বিষণ্নতায় ভোগেন। ডব্লিউএফএমএইচের প্রতিবেদন অনুসারে, ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন না। ফলে একজনের এক বছরে গড়ে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়ে যায়। 

বিষণ্নতা কর্মক্ষেত্রে চাপ বাড়ায়

দেশে কোনো নির্দিষ্ট গবেষণা না থাকলেও মানসিক সমস্যার চিত্র কম-বেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতোই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতার সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের বড় অংশই কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে থাকেন। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়িত না হওয়া এবং পারস্পরিক খারাপ সম্পর্কও বিষণ্নতার কারণ। নারীরা কর্মক্ষেত্রে বেশি বৈষম্যের শিকার হন, তাদের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগও থাকে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান স্কুল অব ইকোনমিক্স ২০১৪ সালে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ বিষয়ক একটি জরিপ পরিচালনা করে। ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কর্মজীবী নারীদের মানসিক চাপের কারণ ও ফলাফল’ শীর্ষক ওই জরিপে দেখা যায়, ‘৪৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রজনিত মানসিক চাপে ভূগছেন। তারা কম পারিশ্রমিক, চাকরি হারানোর ভয়, বদলির কারণে মানসিক চাপে থাকেন।’ 

ডব্লিউএফএমএইচ বলছে, মানসিক চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মদক্ষতা কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী কর্মীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে নানা নীতি গ্রহণ করা হলেও তাতে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পায় না। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরিতে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সেই উদ্যোগে নিয়োগকর্তা, কর্মী, আইনজীবী, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবারকে যুক্ত করতে হবে বলে ডব্লিউএফএমএইচ সুপারিশ করেছে।

দীর্ঘদিন উদ্বেগে থাকলেও কর্মক্ষমতা কমে 

মানুষ দীর্ঘদিন উদ্বেগের মধ্যে থাকলেও তার কর্মক্ষমতা কমে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ভয় বা বিপদের মোকাবিলা করলে স্ট্রেস হরমোনে ভরে যায় শরীর। তখন অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল নামক দুটি হরমোন ক্ষরণ হতে থাকে। ভয় বা বিপদ হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, পাচনতন্ত্রের কাজ কমিয়ে দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রভাবিত করে। বিপদ চলে গেলে দেহ সাধারণত বিশ্রামের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কেউ উদ্বেগের মধ্যে থাকলে কর্টিসল ও অ্যাড্রিনালিন হরমোন দুটি বেশি পরিমাণে ক্ষরণ হতে থাকে। শরীর তখন বিশ্রাম অবস্থায় ফিরতে পারে না। তখন মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। 

মস্তিষ্কের যে অংশগুলো উদ্বেগ ও বিষণ্নতার সঙ্গে যুক্ত, সে অংশগুলোও শারীরিক ব্যথার উদ্দীপনা গ্রহণের সঙ্গেও যুক্ত। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ব্যথার সংকেতের জন্য দায়ী দুটি নিউরোট্রান্সমিটার (সেরোটোনিন ও নোরপাইনফ্রাইন) উদ্বেগ ও বিষণ্নতা সৃষ্টির সঙ্গেও জড়িত। ফলে মানসিক অসুস্থতায় শরীর প্রভাবিত হয়। অত্যধিক উদ্বেগে থাকলে পেট, পিঠ ও হাত-পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে, একইসঙ্গে তীব্র মাথাব্যথাও শুরু হতে পারে। 

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও লেখক ড. কারলা ম্যানলে বলছেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পেশি টান, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, অনিদ্রা ও অস্থিরতার মতো শারীরিক উপসর্গের অভিজ্ঞতা হতে পারে। তারা ‘ব্রেইন ফগ’ (মস্তিষ্কে কুয়াশা) অনুভব করতে পারেন। এতে ওই ব্যক্তি মনে করতে পারেন যে, তার মস্তিষ্ক অস্পষ্ট ও অচল হয়ে গেছে। এর ফলে কোনো কাজে মনোনিবেশ করা বা তথ্য মনে রাখা সম্ভব হয় না। করোনায় আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ব্রেন ফগে আক্রান্ত ছিলেন। যারা মনোচিকিৎসকদের কাছে এ ব্যাপারটি বলতে পেরেছেন, তারাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং কর্মক্ষেত্রে আগের মতো শ্রম দিতে পেরেছেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, ‘করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার একটা প্রবণতা থাকে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে মস্তিষ্কেও অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়। এতে করে ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ মেডিক্যাল সায়েন্সে এটাকে ‘হাইপ্রোসিক ইনজুরি’ বলে।

স্ট্রোক হলে বা টিউমার হলে ব্রেনের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যখন হাইপ্রোসিক ইনজুরি হয় তখন পুরো ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থাকে তখন বলা হয় ‘ব্রেন ফগ’। ব্রেন ফগ হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, বিষণ্নতা বেড়ে যায়, আচরণের পরিবর্তন ঘটে, আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যায়। 

অধ্যাপক বাহাদুর আলী মিয়া বলেন, ‘এক্ষেত্রে অবশ্যই নিউরোলজি বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক তাকে কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা বাড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া কাউন্সেলিং ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ ব্রেন ফগ হলে মানুষের নাম চট করে মনে করতে নানা পারার সমস্যা হয়।

কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অথবা একটি ফাইল নেওয়ার জন্য অফিসের অন্য একজনের কক্ষে কেউ গিয়েছে; কিন্তু ব্রেন ফগের কারণে কক্ষে যাওয়ার পর সে ভুলে যায় যে কেন এখানে এসেছে। এভাবে কাজের সমস্যা হয়, সঠিক সময়ে কাজ করার জন্য সঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয় না। এ ধরনের সমস্যা হলে দ্রুত নিউরোলজিস্ট অথবা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে বলে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন। 

রোগে আক্রান্ত হলে বিষণ্নতা বাড়ে

যে কোনো কারণে চাপ অনুভূত হলেই বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার প্রবণতা বাড়ে। অসুস্থতার চিকিৎসা স্ট্রেস সৃষ্টি করে থাকতে পারে। ধারণা করা হয় এটাই  সম্ভাব্য কারণ। কিছু ওষুধ (স্টেরয়েড) মস্তিষ্কের কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। এর থেকে বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তা হতে পারে। কিছু কিছু অসুখ- যেমন নিষ্ক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থি মস্তিষ্কের কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। এতেও বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তা হতে পারে। 

নিউরো ও মনোচিকিৎসকরা বলছেন, উদ্বেগের ফলে যে হরমোনগুলো ক্ষরণ হয়ে থাকে সেগুলোকে বিভিন্ন কাজে ব্যয় করতে পারলে সমস্যাগুলোর অনেকটা সমাধান হয়ে যায়। নিয়ম করে ব্যায়াম করতে পারলে বা শুধুই দৌড়াতে পারলে অথবা শারীরিক পরিশ্রম হয় এমনভাবে হাঁটতে পারলে খুব ভালো কাজ দেয়। মানসিক চাপ মোকাবিলা করার আরেকটি উপায় হলো- শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা। এটি করলে মনে প্রশান্তি আসে বলে মনোচিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এছাড়া যে কারণে হতাশা বা উদ্বেগ হয়ে থাকে সেগুলো চিহ্নিত করতে পারলে ভালো। 

তাহলে নিজে নিজেই এক ধরনের সমাধানে আসা যায়। যেসব নেতিবাচক চিন্তা মনের মধ্যে বারবার আসে, সেগুলো লিখে ফেলতে হবে এবং সেগুলোর বিপরীত কাজ বা চিন্তা করতে হবে। চিন্তাটি যদি এমন হয়, ‘এই কাজটি কি আমি বর্তমানে করে উঠতে পারব? গতবার এই কাজটি করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম।’ তাহলে এর বিপরীতে ইতিবাচক চিন্তা হতে পারে, ‘এবার, আমার কর্মপদ্ধতি আরও পরিষ্কারভাবে জানা আছে, এখন আমার অভিজ্ঞতা আরও বেশি। সুতরাং আমি সফল হতে পারি।’ এভাবে ইতিবাচক চিন্তা করলে সফলতা আসতে পারে। 

মনোচিকিৎসকরা  জানিয়েছেন, ইতিবাচক চিন্তা করতে পারলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়। যেমন, যা হয়ে গেছে তা আমাদের হাতে নেই এবং যা ঘটতে চলেছে তার ওপরও আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই- এভাবে চিন্তা করা উচিত। যত আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবব তত উদ্বেগ বেশি হবে। মনোচিকিৎসকরা বলছেন, শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে আমাদের জেনারেল ফিজিশিয়ান দেখাতে হবে।

তিনি বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা করে দেখবেন যে, এই উপসর্গগুলোর পেছনে কোনো শারীরিক কারণ আছে কিনা। যদি রিপোর্টে দেখা যায় শারীরিক কারণ ছাড়াই উপসর্গগুলো হচ্ছে, তখন প্রয়োজনে মনোচিকিৎসক বা নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh