২০২৩ সালে কৃষি কি একই গতিতে চলবে

ড. আবুল হোসেন

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:০৯ পিএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪৩ পিএম

ড. আবুল হোসেন।

ড. আবুল হোসেন।

কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কৃষিতে নিযুক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে দেশে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ছাপ্পান্ন লাখ।

এর মধ্যে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পরিবার বা খানার সংখ্যা এক কোটি ছেষট্টি লাখ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ্যান এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের মধ্যে তেমন তফাত নেই। উল্লেখ্য, কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় আটষট্টি লাখ পরিবার অন্যের জমি বিভিন্ন শর্তে লিজ বা বর্গা নিয়ে চাষ করে। 

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। একটি হিসাব থেকে দেখা যায়, গত দুই দশকে (১৯৯৯-২০১৯) কৃষি উৎপাদন মূল্য প্রতিবছর ৩.৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে (ডেইলি স্টার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২)। সন্দেহাতীতভাবে কৃষি বাংলাদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস এবং সবচেয়ে বড় খাত। বস্তুত বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি একই সূত্রে গাঁথা। 

২০২২ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা 
কৃষি উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা ২০২২ সালে বিশেষ লক্ষণীয়। বিশেষ করে ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ফসলের উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিক‚ল অবস্থা সহনশীল জাত উদ্ভাবনে বেশ সফল ছিল বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সফলতা বেশ দৃশ্যমান। প্রতিকূলতা সহিষ্ণু এ সব ফসলের জাত কৃষিতে ব্যাপক অবদান রেখেছে ২০২২-এ। কৃষি বিষয়ে ই-কথা এবং কৃষি কল-সেন্টারের মাধ্যমে কৃষি তথ্য সেবাও বেড়েছে।

ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণের উদ্যোগ ২০২২-এ চোখে পড়ার মতো। লক্ষণীয় তৎপরতা বেড়েছে মৃত্তিকা জরিপের কাজেও। মাটির স্বাস্থ্য ভালো নেই তাই মৃত্তিকা জরিপের কাজ জরুরিও বটে। মৃত্তিকা সম্পদের শ্রেণিকরণ ও মাটি পরীক্ষার সুবিধাও বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২২-এ। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার তৎপরতা কৃষি মন্ত্রণালয়ের থাকলেও এ ক্ষেত্রে খুব একটা সফলতা নেই। 

কৃষিতে প্রযুক্তি ও গবেষণা
গত দুই দশকে শতভাগ জমি কলের লাঙল দ্বারা চাষ হচ্ছে। চাষ-আবাদ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশে। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষিকেন্দ্রিক শিক্ষা এবং গবেষণার ফলে কৃষি সেক্টরে উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা ১২৯ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত আবিষ্কার করেছে। ৩৭টি গমের জাত আবিষ্কার করেছে। জমি চাষ, ধান-গম মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করছে কৃষকরা। কৃষিতে প্রযুক্তি ও গবেষণা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এত কিছুর পরও বাংলাদেশের কৃষক কি সন্তুষ্ট চিত্তে আছে? 

সারের মূল্য বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা এক কোটি ছেষট্টি লাখ। ধান, গম, ভুট্টা এবং আলু চাষ করে এই কৃষকরা। সার, কীটনাশক, ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের উত্তরোত্তর দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়েছে বহুগুণে। ২০২২-এ কৃষি উৎপাদন উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলাদেশের কৃষক সার, বিষ, ডিজেলের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ২০২১ সালে ৫০ কেজির এক বস্তা ইউরিয়া সারের দাম ছিল ৮০০ টাকা, ২০২২ সালে ১ বস্তার দাম ১১০০ টাকা। এক লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৮ টাকা ২০২১ সালে। আর ২০২২ সালে ১১৩ টাকা। কীটনাশকের দামও বেড়েছে দেড়গুণ। ২০২৩-এ এসে এই মূল্য কতটা বেড়ে যায় কে জানে?

বড়, মাঝারি এবং প্রান্তিক কৃষক কেউই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে লাভ করতে পারছে না। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে। রাজশাহীর একজন আলু চাষি জানান, প্রতি কেজি আলুতে ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা লোকসান হয়েছে ২০২২ সালে। ২০২৩ সালে এসেও এর কোনো ব্যত্যয় চোখে পড়ছে না।

বস্তুত কৃষি উপকরণের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণেই কৃষক লাভবান হতে পারছে না। যদিও সারে ভর্তুকির পরিমাণও বৃদ্ধি করেছে সরকার। ২২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে রাসায়নিক সারে সরকারী ভর্তুকির পরিমাণ। কিন্তু আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে, লাগামহীন ডিজেল ও সারের উচ্চমূল্য দীর্ঘ দিন অব্যাহত থাকলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

তাই কৃষক, কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। কৃষকদের এই দাম বেড়ে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চাবিকাঠি তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মধ্যে নিহিত। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ২০২৩ সালে কৃষি কি একই গতিতে চলবে? এ প্রশ্ন আমার আপনার- সকলের। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh