স্মার্ট বাংলাদেশ

দুর্নীতিই বড় বাধা

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৪৩ এএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বরাত দিয়ে গত ১১ জানুয়ারি সাম্প্রতিক দেশকালের অনলাইন সংস্করণের একটি খবরে বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় দ্বাদশ নির্বাচনে জিতলে আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠনের পর ১১ দফা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। যেখানে ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং মাথাপিছু গড় আয় পাঁচ হাজার ৯০৬ ডলারের উপরে হবে।

জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন ও রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন করা হবে। 

সম্প্রতি মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও যে ২৭ দফার রূপরেখা তুলে ধরেছে, সেখানেও তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, মিডিয়া কমিশন গঠন, সর্বস্তরে আইনের শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনকি দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, বিএনপির আমলেই দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও দেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। 

অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান যাবতীয় সমস্যার কেন্দ্রে আছে দুর্নীতি। শুধু এই একটি জায়গায় রাষ্ট্র যদি শুরু থেকে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি অবলম্বন করতে পারত, তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সংকট মোকাবিলা করা সহজ হতো। 

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য অসংখ্য সেবা অনলাইনে তথা ঘরে বসে পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সুফল পায় না।

সার্ভার ডাউন, ইন্টারনেটের গতি কম, দক্ষ লোকবল নেই, এরকম নানা অজুহাতে নাগরিকদেরকে বাধ্য করে অফিসে সরাসরি যেতে এবং যে কাজ ১০ মিনিটে হওয়ার কথা, সেই কাজের জন্য তাদেরকে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়; যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুশি করা হয় (মানে ঘুষ) ততক্ষণ ওই কাজটি ঝুলে থাকে।

অথচ একজন নাগরিক ওই সেবাটি ঘরে বসে অনলাইনে আবেদন করেই যাতে পেতে পারেন, রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু যারা সার্ভিসটি দেবেন, তারা চান না নাগরিকরা ঘরে বসেই সেবাটি পান। কারণ ঘরে বসে সেবাটি পেলে তার উপরি আয় বন্ধ হয়ে যাবে।

সম্প্রতি একজন বন্ধুর অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। রাজধানীর ধানমন্ডি ভূমি অফিসে তার ফ্ল্যাটের সামান্য কাজের জন্য গিয়েছিলেন, যেটা মূলত ১০ মিনিটের কাজ এবং এর জন্য সরকারি ফি ১০০ টাকারও কম। ফ্ল্যাটের মালিকানা সম্পর্কিত তার দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্রও আছে এবং নিয়ম অনুযায়ী তিনি অনলাইনে আবেদনও করেছিলেন।

অথচ তিনি যতবার এই সেবাটি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, ততবারই সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে অদ্ভুত ও উদ্ভট সব যুক্তিতে। তিনি বুঝতে পারছিলেন এই হয়রানির মূল কারণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ‘খুশি না করা’।

কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের মালিক যেহেতু একজন সৎ ও নীতিবান মানুষ, ফলে তিনি কোনোভাবেই ঘুষ না দেওয়ার বিষয়ে অটল থাকেন। যার পরিণতিতে তাকে ছোট্ট একটি কাজের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি ভ‚মি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি বললে আক্ষরিক অর্থেই ১০ মিনিটের মধ্যে সমস্যাটির সমাধান হয় এবং পুরো কাজটি করতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৭০ টাকা।

এরপর তিনি ওই কাজ করতে আসা আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, এই কাজের জন্য তাদেরকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। অর্থাৎ যার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই; ভূমি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যার জন্য ফোন করতে পারেন না, তাদেরকে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়। এটা শুধু একটি অফিসের চিত্র নয়। নিঃসন্দেহে সারা দেশের চিত্র। 

প্রশ্ন হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা থেকে নাগরিকদের যারা বঞ্চিত করছেন; যারা মনে করেন যে মানুষ বিনা হয়রানি ও বিনা পয়সায় সেবা পেয়ে গেলে তাদের উপরি আয় বন্ধ হয়ে যাবে; যারা এসব উপরি দিয়েই মাসে লাখ বা কোটি টাকা কামান; যারা মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি হন, তাদের দিয়ে কী করে রাষ্ট্র সংস্কার হবে বা সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে। 

একটা সময়ে বলা হতো, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কম, তাই তারা ঘুষ খান। কিন্তু সেই দিনের অবসান হয়েছে। এখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা ও জীবনের নিশ্চয়তা অনেক বেড়েছে। কিন্তু ঘুষ কমা তো দূরে থাক, বিভিন্ন সময়ে যেসব খবর শোনা যায় তাতে মনে হয় দেশের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা ও দেশের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুষের পরিমাণ ও অঙ্কও বেড়েছে। 

প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তোলার কথা বলছে, সেটি কারা বাস্তবায়ন করবেন? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে এখন আরও বেশি স্মার্ট উপায়ে দুর্নীতি করেন; স্মার্ট উপায়ে জনগণের করের পয়সায় পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করে বিদেশে বাড়ি কেনেন; সেকেন্ড হোম গড়ে তোলেন; সন্তানদের বিদেশে পড়ান; সামান্য সর্দি কাশি হলেও বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করেন; পরিবার পরিজন নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যান এবং লাখ টাকার শপিং করেন তাদের দিয়ে? 

হাতে দামি মোবাইল ফোন আর তাতে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকলেই তাকে স্মার্ট সিটিজেন বলা যাবে? স্মার্টনেসের সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করবে? একটি পাসপোর্ট পেতে গেলে কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে গেলেও সাধারণ মানুষকে যে কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের আশেপাশেই আছে। 

সম্প্রতি একজন বিশিষ্ট নাগরিক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, ‘সরকারি অফিসে কোনো কাজের জন্য যাওয়া এখন একটি রুচিহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।’ অনেকেই হয়তো বলবেন, সব সরকারি অফিসের চেহারা এক নয়। কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত ও লক্ষণগুলো কি খুব দৃশ্যমান?

সরকার কি অন্তত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারবে যেখানে গিয়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাহীন এবং সবচেয়ে দরিদ্র একজন মানুষও বিনা হয়রানিতে, বিনা পয়সায়, বিনা তদবিরে দ্রুততম সময়ে সেবাটি পাবেন? যাদের করের পয়সায় তাদের বেতন হয়, সেই মানুষেরা কি এখনো যে কোনো সেবা নিতে গিয়ে উল্টো কর্মচারীর মতো আচরণের শিকার হন না?

সুতরাং ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট আয়তনের দেশে ১৮ কোটি মানুষের বসবাস কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা নিয়ে প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা নয়। এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। সেই দুর্নীতি বন্ধে কোন দলের কর্মপরিকল্পনা কী; স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে তারা কী করবে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে।

শুধু কথার কথা নয় বা কাগজের গরু কেতাবে থাকলেই হবে না, সরকার গঠনের পর সেই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নেও দৃঢ়তা থাকতে হবে। না হলে আওয়ামী লীগের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কিংবা বিএনপির ‘রাষ্ট্র সংস্কার’-এর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়বে; এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে; রাস্তায় আরও বেশি দামি গাড়ি নামবে বটে, আখেরে সাধারণ মানুষ সাধারণের কাতারেই পড়ে থাকবে এবং রাষ্ট্রীয় যে কোনো সেবা নিতে গিয়ে হয়রানি ও ঘুষের দুষ্টচক্রে তাদের আটকে থাকতে হবে। 

অতএব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের সংস্কার লাগবে। ভূমি অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের তসরুপ হয়, সেখানে মেরামত লাগবে। উন্নয়নের নামে যে দেশের নদী খাল ও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে, সেই উন্নয়নচিন্তায় সংস্কার লাগবে। উন্নয়ন মানেই অবকাঠামো; অবকাঠামো মানেই প্রকল্প; প্রকল্প মানেই হাজারো কোটি টাকা এবং টাকা মানেই ভাগ-বাটোয়ারা, এই ভয়াবহ উন্নয়নচিন্তা রাষ্ট্রে দৃশ্যমান অবকাঠামোর সংখ্যা বাড়াচ্ছে বটে, এর দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে দেশের কী উপকার ও ক্ষতি হচ্ছে তার নির্মোহ বিশ্লেষণের জন্যও রাজনীতিবিদ ও নীতিরনির্ধারকদের মগজে মেরামত লাগবে।

সর্বোপরি, অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশাল বিশাল সেতু ও ফ্লাইওভার নির্মাণ হচ্ছে বলে আমরা যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি, তা সবই বিফলে যাবে যদি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব না হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ এগোলো কি পেছালো, তার চেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির ভিকটিম হয়, যেখান থেকে উত্তরণ ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ শুধু কথার কথাতেই থেকে যাবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh