ইউক্রেনে ফরাসি ট্যাংক, কী প্রভাব ফেলবে পশ্চিমা দেশগুলোতে

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:০১ এএম

ইউক্রেনকে ‘হালকা ট্যাংক’ দিতে যাচ্ছে ফ্রান্স। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনকে ‘হালকা ট্যাংক’ দিতে যাচ্ছে ফ্রান্স। ছবি: সংগৃহীত

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ গত ৪ জানুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ঘণ্টাখানেক ফোনে কথা বলেন। এরপর ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বলা হয়, ইউক্রেনকে ‘হালকা ট্যাংক’ দিতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি একই দিনে এক টুইটার বার্তায় ‘হালকা ট্যাংক’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। 

৫ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ফ্রান্স ইউক্রেনকে ‘এএমএক্স-১০আরসি’ নামের সাঁজোয়া যান দিচ্ছে; যা ফরাসিরা ‘হালকা ট্যাংক’ নামে আখ্যা দিয়ে থাকে। ফ্রান্সের এই ঘোষণার পর থেকে একদিকে যেমন ট্যাংকের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, তেমনি পশ্চিমা আর কোন কোন দেশ ফ্রান্সের উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা।

ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ফ্রান্সের ‘ল্য মোদঁ’ পত্রিকা বলছে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া যান ১০৫ মিলিমিটার কামান দ্বারা সজ্জিত। এর বর্ম পদাতিক বাহিনীর হালকা অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে পারে।

তবে ট্যাংকের ট্র্যাকের পরিবর্তে এটির রয়েছে ছয়টি রাবারের চাকা। ১৯৮১ সাল থেকে সার্ভিসে আসা ২৪৫টা গাড়ি বর্তমানে ফরাসি সেনাবাহিনীতে ‘জাগুয়ার’ নামের আরেকটা সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে গত চার দশকে এই গাড়ি আরও উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। 

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম-১ অ্যাব্রামস’ ও জার্মানির ‘লেপার্ড-২’ ট্যাংক চাওয়া হচ্ছে। ফ্রান্স এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে ‘সিজার’ স্বয়ংচালিত আর্টিলারি, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও ‘ক্রোটেইল’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। একই সঙ্গে ফ্রান্স নিজ দেশে ২ হাজার ইউক্রেনীয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফরাসি ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া গাড়ি ট্যাংকের মতো অতটা শক্তিশালী বর্ম দ্বারা সজ্জিত নয়। আর এর কামানও অন্যান্য ট্যাংকের ১২০ মিলিমিটার বা ১২৫ মিলিমিটার কামানের চাইতে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ক্ষমতার। ১৬ টন ওজনের এই ‘হালকা ট্যাংক’ ভালো রাস্তায় প্রায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম।

অপরদিকে মার্কিন ‘অ্যাব্রামস’ ট্যাংক প্রায় ৭০ টন ওজনের এবং সেগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে সচল রাখার জন্য বেশ জটিল সাপ্লাই চেইনের প্রয়োজন হয়। ‘এএমএক্স-১০আরসি’ যান বিপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করার জন্য তৈরি হয়নি। বরং শত্রুর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে দ্রুত সরে পড়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।

তবে অন্যান্য সাঁজোয়া যানের সঙ্গে ‘এএমএক্স-১০-আরসি’র পার্থক্য হলো, যেখানে অন্যান্য গাড়ি ৩০ মিলিমিটার বা ৪০ মিলিমিটার কামান বহন করে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ বহন করে ১০৫ মিলিমিটার কামান। এই কামান ট্যাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে সক্ষম; আর এই কামানের জন্যই ফরাসিরা হয়তো এগুলোকে ‘হালকা ট্যাংক’ বলছে। 

১৯৭০-এর দশকের প্রযুক্তির এই ‘হালকা ট্যাংক’ ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে ফ্রান্স ও ইউক্রেন উভয়েই এই যানকে যে ‘হালকা ট্যাংক’ বলছে, তা বেশ গুরুত্ববহ। পশ্চিমা দেশগুলো এখনো অ্যাব্রামসের মতো ট্যাংক ইউক্রেনকে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এর ফলে ইউক্রেনকে সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংকের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।

ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সাঁজোয়া যান দিতে রাজি হয়েছে। ফ্রান্সের ঘোষণার পরপরই ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘এম-২ ব্র্যাডলি’ ও জার্মানি ‘মারডার’ সাঁজোয়া যান দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এগুলো ফরাসি ট্যাংক থেকে আরও ভারী হলেও এগুলোর কামান তত শক্তিশালী নয়। তবে এগুলো ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম।   

এদিকে পশ্চিমা সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’ বলেছে, ব্রিটেন কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইউক্রেনকে ১০টা ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেওয়ার কথা চিন্তা করছে। ১৯৯৪ সালে সার্ভিসে আসা এই ট্যাংক প্রায় ৬২ টন ওজনের এবং এর রয়েছে শক্তিশালী ১২০ মিলিমিটার কামান। তবে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো এ ব্যাপারে চুপ রয়েছে। এই ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। তবে তা ট্যাংকের ব্যাপারে পশ্চিমা সিদ্ধান্তহীনতাকে পরিবর্তন করতে সহায়তা দেবে।

এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশ, বিশেষ করে জার্মানিকে তার ‘লেপার্ড’ ট্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রকে তার ‘অ্যাব্রামস’ ট্যাংক দিতে প্রভাবিত করা। জার্মানি ছাড়াও পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও স্পেনও ‘লেপার্ড’ ট্যাংক ব্যবহার করে। পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড ইউক্রেনকে এই ট্যাংক দিতে ইচ্ছুক। তবে এগুলো পুনরায় রপ্তানি করতে গেলে জার্মানির অনুমতি প্রয়োজন। জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে এখনো জার্মানি ট্যাংক দেওয়ার কথা চিন্তা করছে না। 

ইউক্রেনকে ফ্রান্সের ‘হালকা ট্যাংক’ এবং ব্রিটেনের সম্ভাব্য ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জার্মানির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ইউক্রেনকে বড় কোনো সহায়তা দেওয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে জার্মানি। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারেও জার্মানি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। ফ্রান্সও নীতিগতভাবে জার্মানির কাছাকাছিই থেকেছে।

তবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফ্রান্সের ইউক্রেনকে ট্যাংক দেওয়ার পক্ষে সমর্থন জার্মানিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলবে; কারণ এতে  রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার প্রতি প্রধানতম হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবে জার্মানি। ইউরোপের ইতিহাস বলে, জার্মানি ও রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি সামরিক অবস্থান ইউরোপকে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেলেছে। জার্মানির উপরে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের এহেন চাপ সৃষ্টি ইইউয়ের অস্তিত্বকে যেমন প্রশ্নের মাঝে ফেলতে পারে, তেমনি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh